নবজাতক দেখে আঁতকে উঠল সবাই। দুই পা নেই, ডান হাতেরও অনেকটা অংশ নেই। এমন অঙ্গ ঘাটতি নিয়ে জন্মানো শিশুর খবরটা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। গ্রামের অনেকে কানাকানি করল ‘অপয়া বাচ্চা’ বলে। কেউ কেউ তো বলেই ফেলল, নদীর পানিতে শিশুকে ভাসিয়ে দেওয়ার কথাও! কিন্তু শাহিদার খাতুনের মা জোহরা বেগম আর বাবা রফিউদ্দীন সন্তানকে বুকে আগলিয়ে রাখলেন। গ্রামের মানুষের বঞ্চনা উপেক্ষা করে বড় করতে থাকলেন ভালোবাসায়। সেই শাহিদা এখন স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অনেক প্রতিবন্ধী নারীকেও।
শাহিদা খাতুনের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। পেশাগত কাজে একটি আয়োজনে শিমুলিয়া গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। শাহিদা খাতুন বলেন, ‘ছোটবেলায় গ্রামের মানুষ আমাকে “খোঁড়া”, “নেংড়া” বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। একা একা চলাফেরা করতে পারব, এমন সাহস করতাম না। সহায়তা করত মা, বাবা, সহপাঠীরা। এখন অবশ্য মানুষের মনোভাবে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে না।’
শাহিদা বেগম শোনালেন তাঁর বেড়ে ওঠার গল্প। সে গল্পে প্রথমই এল সিস্টার জোসেফ মেরির নাম।
শিমুলিয়া গ্রামেই খ্রিষ্টান মিশনারি পরিচালিত একটি হস্তশিল্প পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। ভ্যালেরিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস নামের সেই কেন্দ্রে শাহিদার মা হস্তশিল্পের কাজ করতেন। পাশে বসিয়ে রাখতেন শাহিদাকে। সেখানকার সিস্টার জোসেফ মেরি ছোট্ট শাহিদাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তিনিই শাহিদাকে বর্ণ চেনাতেন। একসময় বাঁ হাতে বর্ণ লেখা শেখাতেন। একসময় জোসেফ মেরি সেন্ট লুইস প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন তাঁকে। এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন শাহিদা। পরে শিমুলিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে শহীদ মসিয়ূর রহমান ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। ২০১৫ সালে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এ সময় বাড়িতে টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতেন তিনি।
স্নাতকোত্তর শেষে সরকারি চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে বসে নেই তাঁর মতো নারীদের পাশে দাঁড়ানো। কাশ আর খেজুরপাতার উপকরণ ব্যবহার করে তৈজসপত্র তৈরি করে বিক্রি করতেন শাহিদা। সে কাজটি গ্রামের নারীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন তিনি। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে কয়েকজন প্রতিবন্ধী নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। এমন উদ্যোগের জন্য ২০১৮ সালে ‘শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ শাখায় যশোর জেলা ও ঝিকরগাছা উপজেলা পর্যায়ে শাহিদা খাতুনকে সর্বশ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মানে ভূষিত করা হয়।
বেসরকারি সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশর উদ্যোগে শিমুলিয়া ইউনিয়নের নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে অধিকতর অন্তর্ভুক্ত করে জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ছয় বছর মেয়াদি এসডিডিবি নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ওই প্রকল্পের শিমুলিয়া গ্রামে নারীদের ওঠাবসা করার জন্য একটি ক্লাব রয়েছে। ওই ক্লাবের সভাপতি শাহিদা খাতুন। একই সঙ্গে শিমুলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীদের সমস্যা সমাধান ও স্বাবলম্বী করার জন্য প্রতিবন্ধী নারী ফোরাম রয়েছে। সেই ফোরামেরও সভাপতি শাহিদা খাতুন।
শাহিদা খাতুন বলেন, ‘সরকারি একটি চাকরির জন্য দীর্ঘদিন চেষ্টা করছি। নিজের জন্য চাকরিটা আমার প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কাজ তো চালিয়েই যাচ্ছি।’