এক কাতারে, এক আহারে
ইফতার আয়োজন সাদামাটা। ভুনা কিংবা পাতলা খিচুড়ি আর আখনি। ইফতারে এ দুটি পদই সিলেটিদের সবচেয়ে প্রিয়। খেজুর, শরবত, ছোলা, পেঁয়াজিসহ নানা পদের ইফতারি থাকলেও আখনি-খিচুড়ি থাকবেই। রমজান মাসজুড়ে ইফতার আর সাহ্রি পর্বে সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহে এ আয়োজন থাকে প্রতিবছর। মাজারভক্ত নারী-পুরুষেরা ইফতার বা সাহ্রিতে অংশ নেন। সবাই এক কাতারে। প্রায় ৭০০ বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মুসাফিরদের জন্য এমন আয়োজন চলছে এবারও।
দুপুর গড়ালেই শুরু হয় আয়োজন। একদিকে চলে রান্না, আরেক দিকে জড়ো হন নানা বয়সী মানুষ। তাঁরা সবাই এখানে ‘মুসাফির’। যে ঘরে রান্নাসহ খাবার পরিবেশন চলে, সেটি ‘লঙ্গরখানা’। এ ছাড়া দরগাহ মসজিদেও ইফতার করেন নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মসজিদে ইফতারির ব্যবস্থা দরগাহ থেকে হয় না। রোজাদারদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা ইফতারি ভাগাভাগি করে খাওয়া হয়। নগরের বিভিন্ন স্থান থেকেও লোকজন ইফতারি পাঠান মসজিদে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন সহস্রাধিক রোজাদার ইফতার করেন হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহে।
রান্নায় রান্নায় ৫০ বছর
২২ মে বেলা তিনটা। দরগাহের রান্নাঘরে চলছে এমনই ইফতারি তৈরির প্রস্তুতি। লঙ্গরখানার ঘরে ছোট-বড় ১২টি চুলার মধ্যে ৪টি চুলায় রান্নায় ব্যস্ত ষাটোর্ধ্ব মো. মানিক মিয়া। তাঁর সঙ্গে আছেন ফারুক মিয়া ও মিজানুর রহমান নামের দুই সহযোগী। রান্নাঘরেই আলাপ হয় মানিক মিয়ার সঙ্গে। কিশোর বয়স থেকে এ কাজ করছেন। কথায় কথায় হিসাব কষলেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে দরগাহে রান্নার কাজ করছেন। এর আগে তাঁর বাবাও এ কাজ করতেন। মানিক মিয়া জানান, রমজান মাসজুড়ে দরগাহে ইফতার ও সাহ্রির আয়োজন করা হয়। ইফতারিতে থাকে ভুনা খিচুড়ি, ছোলা। অনেকে খেজুরসহ ফল, মাংস দিয়ে যান। ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের পাতে দেওয়া হয় ইফতারি। এর মধ্যে বৃহস্পতি ও শুক্রবার দরগাহে ভক্তদের ভিড় বেশি থাকায় আয়োজন দ্বিগুণ করতে হয়। ২৫ কেজি পরিমাণ চাল ও ডালের খিচুড়ি রান্না করা হয়।
ব্যস্ততা বাড়ল লঙ্গরখানায়
বিকেল সাড়ে পাঁচটা। রান্নাঘরের ব্যস্ততা শেষ। ব্যস্ততা বাড়ল পাশের লঙ্গরখানায়। খিচুড়ির বড় পাতিল থেকে প্লাস্টিকের থালায় নিতে ব্যস্ত মানিকের দুই সহযোগী ফারুক মিয়া ও মিজানুর। তাঁদের সঙ্গী স্বেচ্ছাসেবী আরও কয়েকজন তরুণ। একজন খিচুড়ির বড় পাতিল থেকে থালায় নিচ্ছেন, অন্যজন সেই থালায় ছোলা তুলছেন; আবার অন্যজন খেজুর দিয়ে থালাগুলো স্তর করে সাজিয়ে রাখছেন। আবদুল মুকিত নামের স্বেচ্ছাসেবী ছয় বছর ধরে মাজারে ইফতার আয়োজনে সহযোগিতা করেন। তাঁর সঙ্গী বাবলু মিয়া ও ইনসান আলী। তাঁরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করছেন। মানুষের সেবা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন বলে জানান তাঁরা।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। লঙ্গরখানার নিচতলায় নারী মুসাফিররা। দ্বিতীয় তলায় পুরুষ মুসাফির। সবাই সারিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট আসনে বসা। প্রবেশপথে মুসাফিরদের নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে থাকা বোরহান উদ্দিন নামের আরও একজন স্বেচ্ছাসেবী জানান, আগে টোকেন দিয়ে ইফতারের আয়োজন করা হতো। এখন টোকেন পদ্ধতি আর করা হয় না। গত বছর থেকে এই পদ্ধতি বন্ধ করা হয়েছে। বোরহানের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে দেখা যায় মাজারের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী থালায় পরিবেশন করা ইফতারি বিশ্রামাগারের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাচ্ছেন।
দ্বিতীয় তলায় মুসাফিরদের হাতে হাতে ইফতারি তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর আগেই মুসাফিরদের হাতে পানির গ্লাস তুলে দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আজানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে ইফতারে অংশ নেন।
মুসাফিরখানায় প্রায় অধিকাংশ নিরন্ন শ্রেণির মানুষ। এর মধ্যে মাজারভক্ত থেকে মুসাফিরদের সঙ্গে এক সারিতে বসে ইফতার করতে বসতে দেখা গেছে অবস্থাসম্পন্ন মানুষজনকে। মাজারভক্ত থেকে এ ইফতারে অংশ নেওয়া ইমন আহমদ জানান, প্রতিবছর মাজারে একদিন ইফতারে অংশ নেন। তাঁর ভাষ্য, সবাই একসঙ্গে এক কাতারে বসে ইফতার, এতে মনে অন্য রকম এক প্রশান্তি মেলে।
সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে মুসাফিরখানায় এসেছেন ফারুক আহমদ। ইফতারের আয়োজন তাঁর দাদার মুখ থেকে শুনেছেন। বললেন, ‘অইজকু (মঙ্গলবার) শহরে কিছু কাজ আছিল। কাজ সেরে মাজারে আইছি। ইফতারি রান্না দেখছি, এক পাতে অংশ নিছি।’
মুসাফিরদের সঙ্গে আছেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী একজন। আবু তাহের নামের ওই তরুণ বলেন, ‘কলেজ বন্ধ থাকায় তিন বন্ধু সিলেটে বেড়াতে এসেছিলাম। মাজারে ঘুরতে এসে জানতে পারি ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন একসঙ্গে এত মানুষ এক জায়গায় ইফতারের আয়োজন করা হয় শুনে অবাক লেগেছে। দেখেছি, ইফতারও করেছি।’
ঐতিহ্যের ইফতারি
দরগাহের অভ্যর্থনা দপ্তর থেকে জানা গেছে, রোজার মাসে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ নারী-পুরুষের ইফতারি তৈরি হয়। বৃহস্পতি ও শুক্রবার আয়োজন থাকে দ্বিগুণ। এই ইফতারি শুধু বিতরণ করা হয় সিলেটের বাইরে থেকে আসা মুসাফিরদের জন্য। এটি দরগাহখানার একটি অন্যতম আয়োজন হিসেবে পরিচিত। দরগাহ পরিচালনায় অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। বংশপরম্পরায় সরাসরি তত্ত্বাবধান করা হয় দরগাহের মোতোয়ালি পরিবার থেকে। কথা হয় বর্তমান মোতোয়ালি সরেকুম ফতেহ আল আমানের সঙ্গে। মুসাফিরদের নিয়ে লঙ্গরখানার এমন আয়োজনের ইতিহাস ৭০০ বছরের পুরোনো বলে তিনিও পরম্পরায় শুনেছেন। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো নথি রাখার রেওয়াজ নেই বলে তা সংরক্ষণের মধ্যে নেই। হজরত শাহজালাল (রহ.) রমজান মাসে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে একসঙ্গে বসে ইফতার করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর অনুসারীরা একইভাবে ইফতার করতেন।
সরেকুম ফতেহ আল আমান বলেন, সেই ঐতিহ্যের ধারায় ইফতার চলছে। ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই, সবাই এক কাতারে বসে পরিবেশন করা একই খাবারে ইফতার করেন। রেওয়াজ অনুযায়ী এ আয়োজন এককভাবে মোতোয়ালি পরিবারের। তবে এতে চাইলে অন্য যে কেউ অংশ নিতে পারেন।