‘এ দায় কি দেশের না’
‘মা, আমার পোলার জন্য তুমি অনেক করছ, একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও,’ ২০১৩ সালের নভেম্বরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বারান্দায় ছেলের পাশে বসে চোখের পানি লুকাতে লুকাতে এভাবেই আকুতি জানিয়েছিলেন ফরিদা বেগম। তখন পেট্রলবোমায় রোজ মানুষ পুড়ছে। তেমনই একদিন, ২১ নভেম্বর, পড়ে থাকা একটা ককটেলকে বল মনে করে হাতে নিয়েছিল শাহীনবাগের সিভিল এভিয়েশন উচ্চবিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র তোফাজ্জল। সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণে তার ডান হাতের সব কটি আঙুল উড়ে যায়। ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন মা। ২৪ নভেম্বর প্রথম আলোর শেষ পাতায় ছবিসহ ছাপা হয়েছিল সেই খবর। শিরোনাম ছিল ‘ককটেলে তিন আঙুল হারাল শিশুটি’। প্রথম আলোর সেই খবর পড়ে তোফাজ্জলের পাশে দাঁড়ান সারা দেশের অনেক পাঠক। প্রথম আলোও তোফাজ্জলের চিকিৎসার খরচে সহযোগিতা করে।
তবু এগিয়ে চলা
ছেলের দুর্ঘটনার পর অনেক দিন হাসপাতালে কেটেছে। তারপর ২০১৫ সালে কিশোরগঞ্জে চলে যায় তোফাজ্জলের পরিবার। গ্রামে ফিরেও ফরিদার কষ্টের দিন শেষ হয় না। মাঝবয়সে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংগ্রাম চলতেই থাকে। তোফাজ্জলের বাবা জামালউদ্দিন ঢাকায় রিকশা চালাতেন। তিনিও এখন আর তোফাজ্জলদের সঙ্গে থাকেন না। তোফাজ্জল ও তার মায়ের কোনো খোঁজও নেন না।
কিশোরগঞ্জ সদরের আলহাজ ওয়াজেদুল ইসলাম খান উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তোফাজ্জল। ডান হাতের আঙুল হারিয়ে বাঁ হাতে লেখার অভ্যাস করে। পড়াশোনায় ভালো। শিক্ষকেরাও তাই তার ওপর খুশি। এই স্কুল থেকেই পিইসি, জেএসসির পর এবার এসএসসিতে বসেছিল তোফাজ্জল। ঢাকায় প্রথম আলো অফিসে এসে তোফাজ্জল জানিয়ে গেল, মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ৪৪ পেয়ে এবার সে এসএসসি পাস করেছে। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায় তোফাজ্জল। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য সহযোগিতার খোঁজেই এবার ঢাকায় এসেছে।
ফরিদা বেগম বলেন, ‘স্বামী অন্যত্র ঘর-সংসার পেতেছে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে তোফাজ্জলের পড়ার খরচ চালাই।’ তোফাজ্জল নিজেও কম পরিশ্রম করে না। বাঁ হাত দিয়েই কখনো রাজমিস্ত্রির কাজ, কখনো ফসল তোলার কাজ করে এই কিশোর। কাজ থাকলে দিনে ৩০০ টাকা আয় হয়। তবে ডান হাত অকেজো বলে সব সময় কাজ পায় না। মাথাটা নিচু করে টলমলে চোখ ঢাকতে ঢাকতে তোফাজ্জল বলল, ‘এক হাতে কাজ করি বলে সবাই কাজে নেয় না, ফিরিয়ে দেয়। এক হাতের কারণে পড়াশোনাতেও সমস্যা হয়। অথচ এর পেছনে আমার কোনো দায় ছিল না। এ দায় কি দেশের না?’