আড়াই হাজার টাকায় বিয়ের বাজার সেরেছিলেন শিরিন
‘সৈয়দ আলীর ছয়টা পুরি (মেয়ে)। এক লাখ করে টাকা দিলেও ছয় লাখ টাকা লাগব বিয়াত (বিয়েতে)’ ছোটবেলা থেকে এই কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন সানজানা শিরিন। দুই বছর ধরে নিজেই তাই নিজের বিয়ের জন্য টাকা জমাতে থাকেন। ৭ জানুয়ারি জমানো সেই ৭০ হাজার টাকা দিয়েই বিয়ে করেছেন মৌলভীবাজারের একটি চা-বাগানের হাসপাতালের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট সানজানা
প্রথম আলো: বিয়েতে অনেকেই লাখ লাখ টাকা খরচ করছেন। সেখানে আপনার এভাবে বিয়ে করার কারণ কী?
সানজানা শিরিন: আমরা ছয় বোন। ছোটবেলা থেকেই শুনতাম, এতগুলো মেয়ে, এরা শুধু খাবার ধ্বংস করার জন্য দুনিয়ায় এসেছে। বাবার জীবন শেষ হয়ে যাবে। এসব শুনে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, বিয়েতে খুব বেশি খরচ করব না। দুই বছর আগে অনেকটা চিন্তা করেই টাকা জমাতে শুরু করি। তারপর বিয়ের সময় গুনে দেখলাম ৭০ হাজার টাকা হয়েছে। তখনই ঠিক করি বাবা বা বরের কাছ থেকে কোনো টাকা না নিয়েই বিয়ে করব। আর বরের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিনিও আমার মতোই সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। রক্তদান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় অতিরিক্ত খরচের মনমানসিকতা তাঁরও নেই। তাই আমি খুব সহজেই আমার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারি।
প্রথম আলো: অল্প খরচে বিয়ে করার জন্য কোন কোন খাতে কাটছাঁট করতে হয়েছে?
সানজানা শিরিন: বিয়েতে আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দিতে পারিনি। এতে অনেকেই মন খারাপ করেছেন। বিয়ের পর ফেসবুকে কেন তাঁদের দাওয়াত দিতে পারিনি, তা জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছি। বিয়েতে আমাদের অতিথি ছিল ৩০০ জন। এরা হবিগঞ্জের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছোট শিক্ষার্থী এবং এলাকার অন্যান্য ছোট শিশু, যারা কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর মাংস খেতে পায় না। আমি সমাজের বিত্তবান বা ভালো মানুষদের সহায়তায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। ২৬টি ইভেন্ট করেছি। এবার নিজের বিয়ের খাবারের আয়োজন নিজেই করলাম। বিয়ের দিন যে শাড়িটি পরেছি, তা এক বোনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। গয়নাগুলো আমার ভাবির। বিয়েতে আমার কেনাকাটার পেছনে খরচ হয়েছে খুব বেশি হলে আড়াই হাজার টাকা। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার জন্য এটাই ছিল আমার পক্ষ থেকে উপহার। আমি বিয়েতে কারও কাছ থেকে কোনো উপহার নিইনি। এমনকি বরের কাছ থেকেও স্বর্ণের গয়না বা দামি কোনো উপহার নিইনি।
প্রথম আলো: বিয়ের কাবিন কত ছিল?
সানজানা শিরিন: আমাদের বিয়ের কাবিন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। পরিবারের বড়রা এমনকি বিয়ে পড়ানোর কাজিও একটু আপত্তি জানিয়েছিলেন। তবে আমি সবাইকে বলেছি, আমরা স্বামী ও স্ত্রী খুব বেশি বেতনের চাকরি করি না। আর বিয়ের সময়ই ডিভোর্স বা তালাকের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে চাইনি। কাবিন বেশি টাকা রাখার পেছনে ভবিষ্যতে তালাকের বিষয়টিও বড় কারণ হিসেবে কাজ করে।
প্রথম আলো: বরের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে?
সানজানা শিরিন: আমার জন্ম হবিগঞ্জের বড় বহুলা গ্রামে। বর ইসমাইল শিকদারের জন্ম বাগেরহাটের চিতলমারী থানার বড়বাড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে তিনি বগুড়ায় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। ফেসবুকেই বরের সঙ্গে পরিচয়। ফেসবুকে বর আমার ফলোয়ার ছিলেন। রক্তের গ্রুপ জানতে চেয়ে মেসেঞ্জারে নক করেছিলেন। তারপর কথা হতো। গত বছর কুষ্টিয়ায় এক অনুষ্ঠানে প্রথম দুজনের দেখা হয়। তারপর বর নিজেই বিয়ে করতে চান বলে জানিয়েছিলেন।
প্রথম আলো: আপনাদের বিয়ে এবং পরবর্তী ছবিগুলোও তো অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।
সানজানা শিরিন: আমরা স্বেচ্ছায় রক্তদাতা, তা সবাইকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছি। বিয়েতে আমাদের অতিথি ছোট বাচ্চারা খাচ্ছে, তার ছবি ফেসবুকে দিয়েছি। বউ সেজে নিজেই বাচ্চাদের খাবার তদারকি করেছি। পাঁচ হাজার টাকা কাবিন—তাই পাঁচ হাজার টাকার পাঁচটি নোটের একটি বাঁধানো ছবির ফ্রেম নিয়েও ছবি তুলেছি। ২০১৪ সাল থেকে দরিদ্র রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহে নেমেছি। ফেসবুকে রক্ত চেয়ে প্রায় প্রতিদিনই পোস্ট দিই। এক ছোট বাচ্চা, যার থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বাবাকে পাঁচ বছর ধরে বিভিন্নভাবে রক্ত সংগ্রহ করে দিই, আমার বিয়ের পর যদি আর এ কাজ না করি বলে ও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তাকে অভয় দিয়ে একটি ভিডিও শেয়ার করেছি। বিয়ের পর বরের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছি।
প্রথম আলো: আপনার হাতে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া নবজাতকের সংখ্যা কত হলো?
সানজানা শিরিন: আমার হাতে এ পর্যন্ত যমজ বাচ্চাসহ স্বাভাবিক প্রসবে বাচ্চা হয়েছে ৬৫৮টি। ছেলে না মেয়ে, যমজ কি না ইত্যাদি তথ্য দিয়ে আমি স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের সঙ্গে ছবি তুলেও তা ফেসবুকে সবাইকে জানাই।
প্রথম আলো: পরিবারের সদস্যদের কীভাবে সহায়তা করেন?
সানজানা শিরিন: আমিসহ ছয় বোনের মধ্যে দুজনের বিয়ে হলো। এক বোন নার্স, আরেক বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিন বোন পরিবারে সহায়তা করার চেষ্টা করি। নিজের বেতনের টাকা থেকে বোনকে নার্সিং পড়তে সহায়তা করেছি। এখন দুই বোন আর এক ভাইয়ের খরচ দিই। বাবার বয়স হয়েছে, মুদির দোকান আছে একটি। কিছু কৃষিজমি আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই সংসারের অন্যান্য খরচ দেন।