আসমা ঘুরেছেন ৮৯ দেশ
পুরোনো দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা কখনো কখনো দৈনন্দিন আলাপে চলে আসে মধুর স্মৃতির মোড়কে; সহসা, হাসিমুখে। কাজী আসমা আজমেরীও মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে এমন এক অভিজ্ঞতার কথাই বলছিলেন। ২০১০ সালের কথা। তাঁর পরিব্রাজক জীবনের শুরুর সময়। গেছেন ভিয়েতনামে। ঠিক গেছেন বললে ভুল হয়ে যায়; কারণ, তখনো তিনি দেশটির হো চি মিন সিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে। এমন পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করল পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ—সঙ্গে বিমানের ফিরতি টিকিট নেই কেন?
‘মহা মুশকিল! আমি তো পরিকল্পনা করে গিয়েছি ভিয়েতনাম ঘুরব, সেখান থেকে সড়কপথে যাব কম্বোডিয়া। তাই ফিরতি টিকিটের কথা ভাবিইনি। কিন্তু ভাষাগত দূরত্বের জন্য পুলিশ আমার কথা বুঝতেই চাইলেন না। উল্টো সন্দেহ করল, হাজতে পুরল।’ তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতেই কাজী আসমা আজমেরী আরও একটি কথা বললেন, ‘বিভিন্ন দেশে একা ঘুরতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভালো-মন্দের মুখোমুখি হয়েছি, শিখেছি। সেসব অভিজ্ঞতাই আমাকে গড়ে তুলেছে। তাই হয়তো বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের ৮৯টি দেশ ভ্রমণ করতে পেরেছি।’
নতুন দেশ ভ্রমণের শখ এখনো লালন করেন আসমা আজমেরী, সময় করে বেরিয়ে পড়েন অদেখা কোনো দেশে। ১০ এপ্রিল প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে যখন তাঁর বিশ্বভ্রমণের গল্প শুনছিলাম, তখনো প্রস্তুতি চলছিল পরদিন অস্ট্রেলিয়ায় উড়াল দেওয়ার। সে আলাপেই শুনছিলাম, ভিয়েতনাম পুলিশ তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে যে ছেড়ে দিয়েছিল, সে কথাও।
কাজী আসমা আজমেরী মনে মনে একা ভ্রমণের ইচ্ছেপাখিটা সযতনে পুষতেন ছোটবেলা থেকেই। দেশের বিভিন্ন জায়গা চষে বেড়িয়েছেন। তবে তাঁর বিদেশ ঘোরার ইচ্ছেপাখি ডানা মেলেছিল ২০০৮ সালে। তত দিনে তিনি পড়াশোনা শেষে চাকরি শুরু করেছেন। কাজী আসমা আজমেরী বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় ইবনে বতুতার রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনি পড়ে কল্পনায় নিজেকে তাঁর জায়গায় ভাবতাম। কিন্তু তখন চাইলেই তো বেরিয়ে পড়া যায় না। তাই অপেক্ষায় ছিলাম নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। যখনই তা হলাম, তখনই নিজের স্বপ্নপূরণ যাত্রায় পা বাড়ালাম।’ তবে তারও আগে দেশের সীমানা ছেড়ে থাইল্যান্ডে গেছেন একবার, ২০০৭ সালের সে ভ্রমণে পরিবারের সঙ্গে ছিলেন বলে তাঁর একা ভ্রমণ-তালিকায় জায়গা দিতে চান না।
পুরোদস্তুর পর্যটক জীবনের শুরু ২০০৯ সালে। সে বছর দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল, ভুটানসহ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় পা রাখেন। ২০১০ সালে ঘোরেন মিসর, মরক্কো, তুরস্ক, চীন, ফ্রান্স, ব্রুনেই, বেলজিয়ামসহ ১১টি দেশ। এভাবেই শুরু। সর্বশেষ ২০১৭ সালে গেছেন কিউবায়। সবচেয়ে বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন ২০১৬ সালে। সেবার ঘুরে বেড়িয়েছেন আরব ও ইউরোপের ১৯টি দেশ।
সব দেশেই তিনি ঘুরেছেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে। বললেন, ‘আমি ২০১২ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসে কাজ করেছি কয়েক বছর। চেষ্টা করলে হয়তো ইউরোপীয় পাসপোর্ট পেতাম। কিন্তু কখনো চেষ্টা করিনি, দেশের পাসপোর্টেই নিজের পরিচয় দিতে ভালো লাগে।’
তাঁর বেড়ে ওঠা খুলনা শহরে। কাজী গোলাম কিবরিয়া ও কাজী সাহিদা আহমেদ দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে আসমা বড়। ইকবালনগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও খুলনা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক করেন। একই বিষয়ে এমবিএ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন নিজেই একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করেন।
সেই যে ২০০৮ সালে বেরিয়ে পড়েছেন, আসমা এখনো ছুটে চলেছেন এ দেশ থেকে ও দেশে। তাঁকে হয়তো বছরের শুরুতে হাঁটতে দেখা যায় তপ্ত মরুপথে, আবার বছরের শেষে দেখা যাবে বলিভিয়ার সালার দ্য উইনির লবণ সাগরে। তিনি যেমন বলেন, ‘ইচ্ছে হয় আকাশের শেষ সীমায় যেতে।’ কথায় কথায় তাঁর আগ্রহের উচ্চতা মেপে তাই মনে হয়, একদিন হয়তো বিশ্ব পরিব্রাজক আসমা আজমেরী আকাশের শেষ সীমানাও ছোঁবেন। আপাত লক্ষ্য নিয়ে আসমা বললেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় শততম দেশ হিসেবে রাশিয়া যেতে চাই।’