নাশতা না করেই বের হলাম সময় নেই বলে। পরে মনে পড়ল, পেনসিল নেওয়া হয়নি, রুমে এলাম, পেনসিল নিলাম। এখন পরীক্ষার হলে যাওয়ার পালা। বের হওয়ার পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি খুচরা টাকা নেই। আবার রুমে গেলাম, রুমমেট ভাইয়ের কাছ থেকে ভ্যানভাড়া নিলাম। এবার নিশ্চিন্তে দৌড় শুরু করলাম, কিন্তু গেট পার হতে না হতেই মনে পড়ল, প্রবেশপত্র নিতে ভুলে গেছি। কী আর করার, আবার রুমে গিয়ে প্রবেশপত্র নিলাম।
এদিকে ভাই কিন্তু জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছেন যে পরীক্ষা কয়টায়? আমার উত্তর শুনে রাগত স্বরে বললেন, দ্রুত কর। ঘড়িতে এদিক ১২টার অ্যালার্ম দিচ্ছে, ততক্ষণে পরীক্ষাও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। ভাইয়ের স্নেহমিশ্রিত তাগাদা শুনে দৌড়ে বের হয়ে পড়লাম। দুই মিনিট দৌড়ের সুবাদে দ্রুতই চলে এলাম বঙ্গবন্ধু হলের পকেট গেটে।
ভ্যানশূন্য গেটে ঢুকতেই দেখি যাত্রীশূন্য একটি ভ্যান রাসেল হলের দিকে যাচ্ছে, আমি একটু সামনে দৌড়ে গিয়েই হাঁক ছাড়লাম, ‘মামা’। ভাগ্যও ভালো মামা একডাকেই দাঁড়িয়ে গেলেন, আর দাঁড়াবেন নাই–বা কেন? হাঁপাতে হাঁপাতে দেওয়া সেই ডাকটা ট্রাকের হর্নের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। আমি উঠে বসতে বসতে মামাকে বললাম, ‘কলাভবনে’ যান।
একটু ঠিক হয়ে বসে যখন নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ভাবতে লাগলাম যে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব ইনশা আল্লাহ। কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার ইতি টানতে না টানতেই এমন পরিস্থিতির শিকার হলাম, মনে হলো যেন কোনো এক দুরন্ত ট্রেনকে লাল সংকেত ছাড়াই থামানোর ইঙ্গিত। ভ্যান তখন সাদ্দাম হল অতিক্রম না করলেও পাঞ্জাবি-টুপি পরা ভদ্রলোককে অতিক্রম করে ১০ গজ সামনে চলে গেছে। ঘড়িতে সময় তখন ১২টা বেজে ৭ মিনিট। তার মানে নির্ধারিত সময় থেকে ৭ মিনিট কম লিখতে পারব। ভাবলাম ব্যাপার না, পরীক্ষার হলে যেতে যেতে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট লাগবে। সময় যেখানে ২৪০ মিনিট, সেখানে ১৫ মিনিট কোনো ব্যবধানই তৈরি করতে পারবে না। এসব ভাবনায় যখন আমি মগ্ন, ভদ্রলোক তখন পেছনে আসার ইঙ্গিত করলেন, ভ্যানচালকও তাই করলেন। আমি বললাম, মামা দ্রুত করেন, সময় নেই। ভদ্রলোক আমার ডান পাশেই বসলেন, আমি নম্রতার সঙ্গে সালাম দিলাম। তাঁর প্রশ্নোত্তরে বললাম কলাভবনে যাব।
কিছু কথাও হলো তাঁর সঙ্গে। দুই মিনিটের কথোপকথনের মাধ্যমে স্যার নিজের পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হলেন। জানলাম, তিনি ইংরেজি বিভাগের একজন প্রভাষক। ততক্ষণে আমি কলাভবনের সামনে এসে পড়েছি। নেমে পকেটে হাত দিতেই স্যার বললেন, ‘তুমি যাও।’ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। স্যার বললেন, ‘ভালো করে পরীক্ষা দিয়ো। এরপর নবনির্মিত ভবনের সিঁড়িগুলো দ্রুত টপকাতে থাকলাম। দোতলায় উঠে শরীর থেকে ঘর্মাক্ত ভাব দূর করতে করতে ২০১ নম্বর রুমের সামনে এলাম।
একজন আদর্শ পরীক্ষার্থী হিসেবে যখন নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি, তখনই বুঝতে পারলাম আমার এসব প্রচেষ্টা আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। পরীক্ষা হলে ঢুকব ঢুকব ভাব, এমন অবস্থা দেখে আমি বাক্রুদ্ধ, আশ্চর্যন্বিত ও হতভম্বও বটে। একটু পিছিয়ে দরজার দিকে যখন পুরো নজরে তাকালাম, দেখি সেটা বন্ধ। দরজার সঙ্গে একটি স্টিলের তালাও ঝুলছে।
আমি তো অবাক! আজ পরীক্ষা, পরীক্ষার সময় ১০ মিনিট পার হয়ে গেছে অথচ কাউকে দেখছি না। আমার মাথায় তখন যেন বজ্রপাত হলো—এমন অবস্থা এরপর একজনের ফোন এল। ধরেই বললাম কই তুমি? ও প্রান্ত থেকে বলছে আমি রুমে। বললাম কোন রুমে? রুম তো তালা দেওয়া। আমার মাথায় তখনো খেয়াল আসেনি যে পরীক্ষা চলাকালে ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। ও বলছে, ধুর মিয়া, কিসের তালা দেওয়া, আমি আমার রুমে, তুমি কই? আমি সত্যিটা বলে দিলাম। ও হাসছে আর বলে ছাত্র...পরীক্ষা দিতে আসছে একদিন আগে।
যাই হোক, ওই পরীক্ষাটাই ভালো হয়েছিল, কারণ পরীক্ষার আগের রাতে প্রচুর ঘুমানোর সুযোগ ছিল।
লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে যে অতিরিক্ত মানসিক চাপ মানুষকে সত্য ভুলে যেতে বাধ্য করে। তাই আমাদের উচিত অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে বেরিয়ে আসা এবং একটু সচেতন হওয়া। এ জন্য চাই ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক প্রচেষ্টা। কেননা জীবনে এর প্রভাবে নেতিবাচক অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
রুমান মিয়া: সমাজকর্ম বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।