বাড়ি গেলে এখনো বাবার সঙ্গে মাঠে–ঘাটে কাজ করেন কাবাডি দলের অধিনায়ক শ্রাবনী
এ মাসেই এশিয়ান নারী কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জপদক জিতেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। রেইডার হিসেবে খেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন শ্রাবনী মল্লিক। অথচ এ পর্যন্ত আসতে তাঁকে কতই না ঘাম ঝরাতে হয়েছে। অধিনায়ক শ্রাবনীর কাছে সেসবই শুনেছেন মাসুদ আলম
নড়াইলের কেবিএম গার্লস হাইস্কুলে ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন তখন শ্রাবনী মল্লিক। তাঁর পিসতুতো বোন রিমি সরকার একদিন ক্রিকেট খেলতে নিয়ে গেলেন। ক্রিকেটের নিয়মরীতি শ্রাবনীর মনে ধরল না। সেই যে ক্রিকেট মাঠ ছাড়লেন, আর গেলেন না। স্থানীয় কোচ রবি রজিবুলের হাত ধরে হ্যান্ডবল-কাবাডিতে নাম লেখালেন। রজিবুলের কাছ থেকে স্থানীয় আরেক কোচ তরিকুল ইসলামের কাছ পাঠ নিলেন। স্কুলে পড়ার সময়ই বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন বা বিজেএমসির ক্রীড়া দলে যোগ দিলেন শ্রাবনী মল্লিক। ১২-১৩ বছর আগে সেখানেই পুরোদমে কাবাডি খেলা শুরু।
কাবাডির পাশাপাশি অন্য খেলাও খেলতেন। তাঁর ভেতরের শটপুট-প্রতিভা বিজেএমসিতে বিকাশ লাভ করে। এই ক্লাবের হয়ে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় শটপুটে পান সোনা। বিজেএমসির জার্সিতে ঢাকায় জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় এসেই মাতিয়ে দেন। জেতেন সোনা। শটপুটে জাতীয় স্তরে ২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সোনা জিতেছেন।
বিজেএমসিতে স্থায়ী কোনো চাকরি ছিল না। খেলে মাসিক ভাতা পেতেন ছয় হাজার টাকা। একটা সময় বিজেএমসির ক্রীড়া দল বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ আনসারের দলে গিয়ে ভেড়েন শ্রাবনী। আনসারের জার্সিতে শটপুট, কুস্তি, কাবাডি খেলেন। এ যেন একের ভেতর তিন! জাতীয় কুস্তিতে ৭৬ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জেতেন।
২০১৮ সালে জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে প্রথমবার জাতীয় নারী কাবাডি দলের সঙ্গী হলেন। সেবার অবশ্য গেমস থেকে কোনো পদক মেলেনি। ২০১৯ সালে কাঠমান্ডুতে এসএ গেমসের নারী কাবাডি দলেও ছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জেতে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর পর ২০২৫ সালে নারী কাবাডি দলের সঙ্গে কোনো সফর করলেন শ্রাবনী মল্লিক। জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে এখন বাংলাদেশ পুলিশের হয়ে খেলছেন শ্রাবনী। এতক্ষণে বলাই হয়নি, ২০১৪ সালে রোলবলের জাতীয় দলেও খেলেছেন শ্রাবনী।
এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পেছনে তাঁর মনে সুপ্ত একটা বাসনাও ছিল। কৃষক বাবার মুখে হাসি ফোটানো। পেছন ফিরে তুলে আনেন সেসব কথা, ‘আমার বাবা কৃষক। মা গৃহিণী। অনুশীলন করতে যাওয়ার সময় টাকা চাইলে তাঁরা দিতেন। কিন্তু সব সময় তাঁদের ইচ্ছা ছিল, মেয়ে ভালো একটা চাকরি করুক। তাহলে হয়তো তাঁদের এই কষ্টটা আর থাকবে না। কিন্তু আমার কপালে সরকারি চাকরি নাই।’
আনসারেও মাসিক ভাতা পেতেন। এ নিয়ে শ্রাবনী বলেন, ‘২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আনসারে থাকাকালে চাকরি স্থায়ী হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু হলো না। যদিও স্যাররা অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন, চাকরি দেবেন। কিন্তু তাঁরা কথা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। পরে পুলিশে এলাম। এখানেও একটা চাকরির জন্যই আসা এবং এখানেও ভাতায় আছি। স্যাররা বলেছেন, ‘‘আবেদন করো’’, করেছি।’
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বড় দুই ভাই যাঁর যাঁর মতো আছেন। দুজনই বিবাহিত। একজন টাইলস মিস্ত্রির কাজ করেন। আরেকজন ভারতে থাকেন। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন শ্রাবনী খেলোয়াড়ই হতে চেয়েছিলেন। নিজেই বলেন, ‘খেলোয়াড়দের সবারই ইচ্ছা থাকে বড় খেলোয়াড় হবে। কিন্তু তার পাশাপাশি সরকারি চাকরিটাও তো দরকার। গায়ে, পায়ে জোর আছে যত দিন...তত দিন খেলোয়াড়, তারপর? যখন কোনো সমস্যা হবে, কেউ দেখবে না।’
দুঃসহ দিনগুলো
২০২১ সালে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে শ্রাবনীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। সেসময় ওষুধের পার্শ্বপতিক্রিয়ায় তাঁর ওজন বেড়ে হয়ে যায় ৯৫ কেজি। অসুস্থ অবস্থায় নবম বাংলাদেশ গেমস খেলেন।
গতবছরও অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর দুয়ারে চলে যান। দেড় মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। প্রথমে আনসার হাসপাতাল, পরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ঘুম হতো না। ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতেন। সেসব দিনের কথাও তুলে আনেন শ্রাবনী, ‘ওষুধ খেয়ে আরও দুর্বল হয়ে যাই। আমার বাঁচারই আশা ছিল না। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন মাস তিনেক বাঁচতে পারি। মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। মানসিক চাপ ছিল। কারও সঙ্গে কথা বলতাম না। মা–বাবা বলতেন একটু হাসো, কথা বলো। রাত–দিন তাঁরা পাশে বসে কাঁদতেন। তাঁদের একটা মাত্র মেয়ে আমি। অনেক তপস্যার পর পেয়েছেন। অসুস্থ থাকার সময় তিন মাস তরল খাবার চলে একটানা। কিছুই খেতে পারিনি। এভাবে আমার ওজন ২৩-২৪ কেজি কমে যায়।’
এরপরও মানসিক চাপ বাড়লে ডাক্তারের কাছে যেতে হতো। খেলায় ফিরতে যেটি ছিল তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সেই চ্যালেঞ্জ জয় করে খেলায় ফিরেছেন শ্রাবনী। দেশকে গর্বিত করেছেন। আজ পেছনের কথাগুলো ভাবতে তাঁর ভালো লাগে। গ্রামে খেলার পোশাক পরলে অনেকে অনেক কথা বলত। তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। এ নিয়েও কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু লোকের কথা শোনেননি। মা-বাবার সমর্থন পেতেন। তাঁরা বলতেন, ‘তুমি যেটা করতে চাও, করো। কিন্তু এমন কোনো কাজ করবে না, যেটাকে লোকে খারাপ বলে। তোমার রাস্তায় অবিচল থাকবে।’
বাবা-মায়ের উপদেশ মেনে চলেছেন শ্রাবনী। চলেছেন বলেই আজ তিনি সফল। আর এই সফল জীবনে নিজের শিকড়কে ভুলে যাননি। শ্রাবনী বলেন, ‘বাড়ি গেলে আজও আমি বাবাকে কৃষিকাজে সহায়তা করি। মাঠে-ঘাটে কাজ করি। ধান, পাট, শর্ষে চাষ করেন বাবা।’
বাবা রতন মল্লিক আজ সুখী। তেহরানে বাংলাদেশ নারী কাবাডি দলের ব্রোঞ্জ জেতার পর মেয়েকে বলেছেন, ‘আমি জানতাম তুমি পারবে।’
শ্রাবনী পেরেছেন। কিন্তু তাঁর আক্ষেপটা রয়েই গেছে, ‘একটা সরকারি চাকরি তো আমার আজও হলো না!’