স্রোতের তোড়ে আটকা পড়া একটি পরিবারকে যেভাবে উদ্ধার করেছি

বন্যাদুর্গত এলাকায় উদ্ধার কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা
ছবি: লেখক

দিনভর ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানার পর ঘরে আর বসে থাকতে পারিনি। ২৩ আগস্ট আমরা ১০ জন ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে উঠে পড়ি। সঙ্গে ছিল নিজেদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। দলে সবাই প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করে অভ্যস্ত—কেউ পর্বতারোহী, কেউ সাঁতারু। চারজন আবার বাংলা চ্যানেল–জয়ী। আমরা নিজেদের উদ্ধার তৎপরতার প্রাথমিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আশা নিয়েই রওনা হই।

কুমিল্লার দিকে যেতে যেতে বুঝলাম, এ যাত্রা দীর্ঘ হবে। মহাসড়কে শত শত গাড়ি। পিঁপড়ার গতিতে এগোচ্ছে।

আমরা ফেনী যাচ্ছি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে তাদের পরিবারের খোঁজ জানতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পৌঁছালে একটা ফোনকল পাই। এক ভদ্রলোক উৎকণ্ঠা নিয়ে জানালেন, তাঁর পরিবারের তিনজন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর লালপোল এলাকায় আটকে আছেন। 

আরও পড়ুন
পানির স্রোত থেকে বাঁচতে দড়ি ধরে মহাসড়ক পার হয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে যাওয়ার চেষ্টায় সাধারণ মানুষ
ছবি: লেখক

মহাসড়কের লালপোল থেকেই ফেনী শহরে প্রবেশ করতে হয়। দিনভর শুনছিলাম সেখানে পানির স্রোত বইছে। তাৎক্ষণিক আমি আটকা পড়া নারীকে কল দিই। তিনি জানান, স্রোতের টানে মাইক্রোবাস ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলে তাঁরা গাড়ি থেকে নেমে পেছনের একটি ট্রাকে উঠে বসেছেন। আমি তাঁর অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে জায়গার বিবরণ শুনি।

চৌদ্দগ্রামে আসার পর আমাদের বহনকারী গাড়িটা যানজটে আর এগোতে পারে না। আমরা স্বেচ্ছাসেবী, উদ্ধারকাজে যাচ্ছি জানতে পেরে আশপাশের অনেকে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তাঁদের পরামর্শে আমাদের গাড়ি উল্টো পথে যাত্রা করে। এভাবে ফেনীর মহিপালে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই রাত চারটা বেজে যায়। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে অনেক মানুষের জটলা। অনেকে উড়ালসড়কের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। মহিপালের পর মহাসড়কে বুকসমান পানি। পানির মধ্যেই শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পানির ভেতর দিয়ে আরও সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ আমাদের হেঁটে যেতে হবে। প্রবল স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কাও আছে। কিন্তু কী আর করা।

আরও পড়ুন
আকস্মিক বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ডুবে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অনেক এলাকা
ছবি: লেখক

কোমরে দড়ি বেঁধে প্রথমে আমরা চারজন পানিতে নেমে পড়ি। সামনে কী আছে কেউ জানি না। পরে আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দেন। রাতের অন্ধকারে সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাই। মুঠোফোন বন্ধ। তাই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। এভাবে তিন ঘণ্টা পর লালপোলের পেট্রলপাম্পের কাছে পৌঁছাই।

আটকে থাকা নারী তাঁর অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলেন পেট্রলপাম্পের আশপাশেই আছেন। সেখানে পৌঁছানোর পর ট্রাকে ট্রাকে আমরা খুঁজতে থাকি। একসময় সেই পরিবারকে খুঁজে পাই। তিনজনের একজন শিশু, আর দুজন নারীর একজনের বয়স ৬০ বছর, অন্যজনের ত্রিশের মতো হবে। তাঁরা চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। লালপোলে এসে এ অবস্থায় পড়ে যান। ভয়ে সবাই ট্রাকে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। তাঁরা ছাড়া এদিকে তেমন যাত্রীও ছিল না। সবাই ট্রাকচালক ও তাঁদের সহকারী। বয়স্ক নারীকে নিয়ে বেগ পেতে হলো। পেট্রলপাম্পের পাশের একটি ভবনে নিয়ে গিয়ে আমরা আশ্রয় প্রার্থনা করি। সদয় হয়ে তাঁরা বাসায় তুলে নেন। এত সব ব্যবস্থা করতে করতে সকাল হয়ে গেল। তাঁদের নিরাপদে রেখে আমরা ফেনী শহরের দিকে চলে যাই।

পাঁচ দিন ধরে আমরা ফেনীতে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালাই। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাই মর্মান্তিক। মানবিক বিপর্যয়ের এত ভয়াবহ রূপ দেখতে হবে, কখনো ভাবিনি।

লেখক: পর্বতারোহী।