যেভাবে চিভেনিং বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজে পড়ার সুযোগ পেলাম
২০২৩ সালে চিভেনিং স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন সারাহ আরজুমান চৌধুরী। যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানে কীভাবে বৃত্তিসহ পড়ার সুযোগ হলো? জানিয়েছেন তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ—পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে ধারাবাহিক সফলতা অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন, চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস বেকন, গণিতবিদ অগাস্টাস ডি মর্গান, রসায়নবিদ রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজ, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে এখানে পড়ালেখা করতে পারা স্বপ্নের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
শুরুর গল্প
চিভেনিং বৃত্তি ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পুরো প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ। তাই এর জন্য প্রয়োজন মানসিক ও কৌশলগত প্রস্তুতি। নিয়মিত চাকরির পাশাপাশি আমাকে এই বৃত্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির আবেদনের জন্য বেশ বড় একটা সময় বরাদ্দ রাখতে হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক শেষ হয় ২০১৭ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই যুক্ত ছিলাম লেখালেখি আর গবেষণার কাজে। বিভিন্ন সংবাদপত্রেও বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছি। স্নাতক শেষেই শুরু হয় চাকরিজীবন। শুরু থেকেই নানা ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সংস্থা ও এনজিওর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার, বই-জার্নাল প্রকাশনা, আইনি সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন কাজে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলাম। প্রতিটি কর্মক্ষেত্র থেকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভের পাশাপাশি পরিচিত হয়েছি দেশ–বিদেশের অনেক মানুষের সঙ্গে।
বৃত্তির খোঁজে
চিভেনিং বৃত্তি সম্পর্কে জানতে পারি ২০১৭ সালে। তখন আমি সবে একটি গবেষণা সংস্থায় নতুন ঢুকেছি। ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারি, চিভেনিং যুক্তরাজ্য সরকারের একটি আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ প্রোগ্রাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী ও ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবেন—এমন যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণদের বৃত্তির মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয় চিভেনিং। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই বৃত্তি যুক্তরাজ্যে বেশ জনপ্রিয়। এর অর্থায়ন করে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) এবং বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন। চিভেনিংয়ে আবেদনের সময় স্নাতক ডিগ্রি এবং অন্তত দুই বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কর্মক্ষেত্রে প্রায় পাঁচ বছর নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করে অবশেষে ২০২২ সালে চিভেনিংয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিই।
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে নভেম্বর—এই সময়ে চিভেনিংয়ের আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়। আমি প্রায় ছয় থেকে আট মাস সময় নিয়ে নানা কাগজপত্র ও আবেদনসংক্রান্ত প্রশ্নাদির উত্তর তৈরি করি। প্রতিবছর চিভেনিং স্কলারশিপের জন্য হাজার হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ে। ২০২২ সালেই মোট ৭১ হাজারেরও বেশি আবেদনপত্র জমা পড়ে, নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৩০০–র মতো আবেদনকারী। এই কঠিন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আবেদনপত্রটি কীভাবে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র আর সৃজনশীল করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
আবেদনপত্র তৈরি
আবেদনপত্রে শিক্ষাগত আর চাকরি–সম্পর্কিত প্রাথমিক কিছু প্রশ্ন বাদে নেতৃত্বসংশ্লিষ্ট, নেটওয়ার্কিং আর ভবিষ্যৎ–পরিকল্পনাসংক্রান্ত চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নগুলো বেশ স্পষ্ট, তবে উত্তর নিজ অভিজ্ঞতা থেকে, নিজের মতো করে গুছিয়ে লিখতে হবে। যেমন আপনার নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়ে লেখা রচনায় আপনার নেতৃত্বের বিবরণ যে শুধু আপনার সেক্টরেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, এমন নয়। বরং সেটা ছোটবেলা থেকে আজ অবধি যেকোনো কিছুই হতে পারে। একাডেমিক ও ক্যারিয়ারে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পরবর্তী সময় সেসব সিদ্ধান্ত কীভাবে আপনার ও আপনার চারপাশের পরিবর্তনের অংশ হয়েছে বা প্রভাব ফেলেছে, সেটা আপনার লেখায় উঠে আসতে হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যৎ–পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান, নিজের শিক্ষা দিয়ে কীভাবে পরিবর্তনের অংশ হতে চান, এসব বিষয় খুব যৌক্তিকভাবে ধাপে ধাপে উদাহরণসহ বর্ণনা করতে হবে। অবশ্যই কারও লেখা দেখে কপি করা কিংবা মিথ্যা তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এটা আপনার আবেদনকে দুর্বল করবে। হাতে সময় রেখে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করতে হবে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের কোন প্রতিষ্ঠানগুলোয় আপনি আবেদন করতে চান, তাদের বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পর্কেও আগে থেকে জেনে রাখা ভালো।
আবেদনের জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হবে। একাডেমিক সব সনদের সফটকপি (যেমন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সনদ-নম্বরপত্র, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকের সনদ ও নম্বরপত্র ইত্যাদির স্ক্যানকপি), ইংরেজি ভাষায় দুটি রেফারেন্স লেটার বা সুপারিশপত্র আর মেয়াদ আছে, এমন পাসপোর্ট থাকতে হবে। এ ছাড়া ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার পরীক্ষা আইইএলটিএসে ন্যূনতম স্কোর ৬ দশমিক ৫ থাকতে হবে। আগে আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়া না থাকলে আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই পরীক্ষা দিয়ে দিতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে স্কলারশিপের জন্য নির্বাচিত হলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অফার লেটার’ জমা দিতে হবে। চিভেনিংয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচনের পরবর্তী ধাপ হলো মৌখিক পরীক্ষা, যা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনে। মনে রাখতে হবে, মৌখিক পরীক্ষার পরও অনেকে চূড়ান্ত পর্যায় থেকে বাদ পড়ে যেতে পারেন। তাই মৌখিক পরীক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। চিভেনিংয়ের ওয়েবসাইটে প্রতিটি ধাপ সময়সীমাসহ ফ্লোচার্ট আকারে দেওয়া আছে।
কেমব্রিজের অভিজ্ঞতা
কেমব্রিজে আমার পড়ার বিষয় হলো মাল্টি ডিসিপ্লিনারি জেন্ডার স্টাডিজ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও দক্ষিণ এশিয়ায় এ বিষয়ে কাজ ও গবেষণার সুযোগ আছে অনেক। কেমব্রিজে নানা দেশের বহু শিক্ষার্থী পড়তে আসেন। বহুজাতিক একটি পরিবেশে নিজের তাগিদে পড়ার এবং শেখার সুযোগ আছে। প্রত্যেক শিক্ষক, অধ্যাপক বেশ আন্তরিক। শুধু গৎবাঁধা লেকচার থাকে না। থাকে আলোচনা সভা, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক সেমিনারসহ আরও অনেক কিছু। শিক্ষা এখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আনন্দময়। আমার সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আরও নানা দেশের শিক্ষার্থীরাও আছেন। প্রত্যেকের সংস্কৃতি, আচারবিধি ভিন্ন। প্রত্যেকে এই ভিন্নতাকে সাদরে গ্রহণ করে, উদ্যাপন করে। এ ধরনের বৈচিত্র্য আর সহনশীল পরিবেশ থেকে অনেক কিছু শেখার-জানার আছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় মোট ৩১টি কলেজের সমন্বয়ে গড়া। প্রতিটি কলেজই স্বনিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি কলেজ, লাইব্রেরি, অনুষদ, জাদুঘর, ক্যাম্পাস, প্রশাসনিক ভবন, বাগান, হ্রদ, নৈসর্গিক প্রকৃতি—সবকিছুই যেন শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উর্বরভূমি হিসেবে বিশ্বব্যাপী আলোক বিস্তার করে চলেছে। কেমব্রিজ ছোট শহর। পুরোটাই দেখার মতো। এই শহরের প্রতিটি অলিগলি, ভবন আর অবকাঠামো হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। কেমব্রিজ শহরের প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে শিক্ষা ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। দেখে মনে হয়, পুরো কেমব্রিজ শহর গবেষণাসংশ্লিষ্ট মানুষে ভর্তি। শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে, বেশির ভাগ লোক নিজেদের গবেষণার বিষয় নিয়ে কথা বলছেন।
আমি কেমব্রিজের পোস্টগ্র্যাড কমিটির সদস্য। আমরা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করি। এ ছাড়া সামনে নানা প্রোগ্রামের আয়োজনের সঙ্গেও যুক্ত থাকব। এ ধরনের সম্পৃক্ততা সার্বিক বিকাশে আর নেটওয়ার্কিংয়ে বেশ সহায়তা করে। আজ স্বপ্নের এই ক্যাম্পাসে বসে এইটুকুই বলতে চাই—স্বপ্নকে স্বপ্ন নয়, পরিকল্পনা বানাতে হবে। তৎপর থাকতে হবে। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তাহলে স্বপ্নপূরণের পথে নিজেকে কখন আবিষ্কার করবেন, টেরই পাবেন না।
চিভেনিং বৃত্তির বিস্তারিত জানা যাবে এই ওয়েবসাইট থেকে।