‘টুয়েলভথ ফেল’ মনোজের সঙ্গে সাদিকুরের যেখানে মিল
তুমুল আলোচনায় এখন টুয়েলভথ ফেল। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণ মনোজ কুমার শর্মা কীভাবে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) কর্মকর্তা হলেন, তা নিয়েই ছবির গল্প। আমাদের দেশেও নিশ্চয়ই কারও কারও জীবনের ঘটনা মনোজের সঙ্গে মিলে যায়। পড়ুন এমন একজন সাদিকুর রহমান–এর লেখা।
পঞ্চম শ্রেণিতে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার পর রোল ৮০ নিয়ে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম, তখন ইংরেজি কোনো শব্দই আমি পড়তে পারতাম না। গণিত শুধু যোগ–বিয়োগ পারতাম। বড় বোনের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় আমার কঠোর পরিশ্রম।
সপ্তম শ্রেণিতে রোল হয় ২। অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে যাই। দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথমই ছিলাম।
এসএসসিতে ৪.৮৮ জিপিএ নিয়ে ত্রিশালের সরকারি নজরুল কলেজে ভর্তি হই, কিন্তু কলেজে উঠে পড়ালেখা এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলাম। বন্ধুবান্ধের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই সময় কাটত।
২০১০ সালের জুলাই মাস। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন নিশ্চিত ফেল ধরে নিয়েই ব্যাগ গুছিয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য কোনো কোম্পানিতে চাকরি নেব। ফলাফল প্রত্যাশা মতোই হলো। দুই বিষয়ে অকৃতকার্য—পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত।
মা খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। বাবাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। শুধু আমারই কারণে ক্ষুণ্ন হচ্ছিল আমার বাবা শওকত আলী মাস্টারের সুনাম। ২০১১ সালে প্রতিজ্ঞা করি, যেভাবেই হোক এবার পাস করতে হবে। এই দফায় জিপিএ–২.৯০-ই ছিল আমার কাছে বড় পাওয়া।
সংগ্রামের শুরু
পাবলিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরম তোলার যোগ্যতা আমার ছিল না। তাই ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগে যখন ভর্তির সুযোগ হয়ে গেল, খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন। স্নাতকে তৃতীয় বর্ষে যখন পড়ি, হাতখরচ জোগাতে ও বাবার ওপর চাপ কমাতে একটা দোকানের বিক্রয়কর্মীর চাকরি নেই। সেখানে তিন মাস কাজ করে পরে একটা স্পিনিং মিলে চাকরি নিই। সুপারভাইজার। স্নাতকের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময় সেই চাকরিটাও ছেড়ে দিতে হয়।
তৃতীয় বর্ষের লিখিত পরীক্ষার পর জীবনে একটা বড় ট্র্যাজেডি ঘটে। মানসিক সমস্যার কারণে বাইরের জগৎ থেকে আমি একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। সাত–আট মাস ধরে চলে চিকিৎসা। এ সময় আমার কাকা সাইদুজ্জামান, শফিকুল ইসলাম, নবী হোসেন, দুলাভাই ওয়াহিদুজ্জামান ও আমার চাচাতো ভাইয়েরা ভীষণ সাহায্য করেছে। তত দিনে কলেজের তৃতীয় বর্ষের ভাইভা পরীক্ষা শেষ। পরে গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাইভা দিয়ে পাস করি।
২০১৫ সালটাও আমার জন্য বিশেষ। কারণ, এই বছরেই সিজিপিএ–২.৯৪ নিয়ে স্নাতক শেষ করি। বিয়েও হয়েছে এই বছর। পরের বছর আমার প্রথম সন্তান সাদাফের জন্ম হয়। ২০১৭ সালে বাবা একটু আর্থিক সংকটে পড়ে যান। কারণ, আমার বড় ভাই বাক্প্রতিবন্ধী। তাঁর সংসার খরচ, মায়ের চিকিৎসার খরচ বাবাকেই বহন করতে হতো। একরকম বাধ্য হয়েই আমার সব ধরনের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেন বাবা।
আমি যোগ দিই একটা কোচিং সেন্টারে। পরে অবশ্য ত্রিশালেরই চকরামপুর বাজার আমজাদ আলী মডেল স্কুলে মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে একটা চাকরি পেয়ে যাই। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সেখানে চলে যাই। শুরু হয় আসল জীবনযুদ্ধ।
মনোজ ও আমার যেখানে মিল
সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টিউশনি করতাম। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্কুল। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াতাম। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে এতটাই ক্লান্ত লাগত যে বই নিয়ে বসার মতো শক্তি থাকত না। তবু আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম।
এত সংগ্রামের মধ্যে এক বড় স্বস্তি নিয়ে আসে ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাত। সেই রাতেই খবর পাই, প্রাইমারি স্কুল সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। পরের বছরটা অবশ্য শুধু আমার নয়, সারা পৃথিবীর মানুষেরই একরকম স্থবিরতায় কেটেছে। করোনায় সব পরিকল্পনা, রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। ২০২১ সালের শেষ দিকে আমি পুরোদমে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। ৪১তম বিসিএসে নন–ক্যাডারে ইনস্ট্রাক্টর (বাংলা) পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। আর ২০২৩ সালে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে স্থান পাই। এই পুরো সময়টাতে আমার স্ত্রী আফসানা আক্তার কী অকুণ্ঠ সমর্থন, সহায়তা যে আমাকে দিয়েছে, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত টুয়েলভথ ফেল সিনেমাটি আমি দেখেছি। নিজের সঙ্গে মিল পেয়ে ভীষণ ভালো লেগেছে। আমিও তো উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করেছিলাম। যদিও তেমন মেধাবী নই, কিন্তু আমার জীবনের গল্পও কখনো কখনো সিনেমার মতোই মনে হয়েছে।
মনোজের মতোই আমার জীবনেও বড় ভূমিকা রেখেছে জীবনসঙ্গী। মনোজ যেমন অসৎ উপায়ে পাস করতে চায়নি, আমিও। মনোজ যেমন আটার মিলে কাজের পাশাপাশি পড়ত, আমিও টিউশনি করে, স্কুলে পড়িয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে সবচেয়ে বড় মিল বোধ হয় একটাই—আমরা হাল ছাড়িনি।