‘অনেক চাকরি নিয়ে বসে আছি, কিন্তু লোক পাচ্ছি না’

যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেনশিয়াল আর্লি ক‍্যারিয়ার অ‍্যাওয়ার্ড ফর সায়েন্টিস্টস অ‍্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স’–এর জন‍্য মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক এহসান হক। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও অফিস হোয়াইট হাউস থেকে শিগগিরই এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। মোট ৪০০ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী পাবেন এই পুরস্কার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব‍্যবহার নিয়ে কাজ করার জন্য মনোনীত হয়েছেন এহসান হক। বর্তমানে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্ভাবন বিভাগের নেতৃত্বে আছেন তিনি। সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন এই বিজ্ঞানী, ১৭ জানুয়ারি তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন মো. সাইফুল্লাহ

প্রথম আলো:

অভিনন্দন। প্রেসিডেনশিয়াল পুরষ্কারের জন‍্য কীভাবে মনোনীত হলেন?

২০১৭ সাল। আমি তখন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একটা প্রকল্পে কাজ করি। একদিন প্রকল্প পরিচালক বললেন, প্রেসিডেনশিয়াল আর্লি ক‍্যারিয়ার অ‍্যাওয়ার্ড ফর সায়েন্টিস্ট অ‍্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স নামে একটা পুরস্কার আছে, তুমি কি সেটার জন‍্য মনোনীত হতে চাও? মনে পড়ে গেল, শিক্ষকতা–জীবনের প্রথম বর্ষে একটা কর্মশালায় এক লোকের কাছে এই পুরস্কারের কথা শুনেছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই পুরস্কার পাওয়াটা কি খুব বড় ব্যাপার? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নিশ্চয়ই। যদি এই পুরস্কার পাও, তার মানে তোমার ক‍্যারিয়ার দুর্দান্ত গতিতে এগোচ্ছে।’ কথাটা বলার সময় তিনি চিকেন ড‍্যান্সের একটা ভঙ্গি করেছিলেন। ভাবখানা, ‘তুমি কেন এই প্রশ্ন করছ! তুমি তো জীবনেও এটা পাবা না!’

তো প্রকল্প পরিচালককে আমার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলাম। তিনি অনেকগুলো ধাপের কথা বললেন। কোনো একটা যুগান্তকারী আইডিয়া থাকতে হবে, ১৫ পৃষ্ঠার প্রস্তাব লিখতে হবে, সেটা পিয়ার রিভিউয়ের জন‍্য পাঠানো হবে, চারজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর লেখা সুপারিশপত্র লাগবে, ইত‍্যাদি…। সব ধাপ পেরোনোর পর ২০১৮ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে আমার নাম পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো একটা কারণে ২০১৯ সালের পর আর এই পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়নি। এত দিন পর ঘোষণা এল।

প্রথম আলো:

আমরা জানি, আপনি নিয়মিত ট্রায়াথলনে অংশ নেন। ‘আয়রন ম‍্যান’ও হয়েছেন। ট্রায়াথলনে যেমন একটার পর একটা ধাপ পেরোতে হয়, গবেষণায়ও তা-ই। দুটোর মধ‍্যে কি মিল খুঁজে পান?

এটা ঠিক, দুটোর মধ‍্যেই অনেক মিল আছে। একটা বড় মিল হলো, দুটোর ক্ষেত্রেই অনেক শারীরিক কষ্টের মধ‍্য দিয়ে যেতে হয়। ধৈর্যের দরকার হয়। যেমন আয়রন ম‍্যান প্রতিযোগিতা—আমি জানি আমাকে লম্বা সময় দৌড়াতে হবে। দ্রুত দৌড়ালে কোনো কাজ হবে না। এমন একটা গতিতে দৌড়াতে হবে, যেন দীর্ঘ সময় দৌড়াতে পারি। এই যে আগে থেকেই এটা মাথায় রাখা যে সামনে অনেক লম্বা পথ, পথে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে, আমার সাইকেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে, সাঁতার কাটার সময়ে পায়ে টান পড়তে পারে, ব্যথা পেতে পারি, সবকিছু সামাল দিয়েই আমাকে দৌড়টা শেষ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রেও তাই। আমি জানি আমাকে নানা বাধা পেরোতে হবে। দুটাই আসলে শেখায়, হাল ছেড়ে না দিয়ে কীভাবে সামনে এগোনো যায়।

আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার জন্য টানা ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার সাঁতরে, ১৮০ দশমিক ২ কিলোমিটার সাইকেলে এবং ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন এহসান হক
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ট্রায়াথলন জয়ের পুরস্কার, নাকি গবেষণার জন‍্য কোনো স্বীকৃতি, কোনটা আপনাকে বেশি আনন্দ দেয়?

আমার কাছে আসলে ট্রায়াথলনটা বেশি ভালো লাগে। কারণ, যখন কোনো ট্রায়াথলনে যাই, কেউ তো আমার জীবনবৃত্তান্ত দেখে না। আমি কী গবেষণা করেছি, কোন পদক পেয়েছি, তাতে আশপাশের কারো কিছু যায় আসে না। ওখানে আরও অনেক অ‍্যাথলেটের মধ‍্যে আমি হারিয়ে যেতে পারি। সবাই সবার বন্ধু। ট্রায়াথলনে মূলত কোনো প্রতিযোগিতা নাই। কেউ কাউকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে না। অধিকাংশ প্রতিযোগীর জন্য প্রতিযোগিতা শুধু নিজের সঙ্গে। সবাই সবাইকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে, চলো চলো, তুমি পারবে…এই যে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা, এটা খুব ভালো লাগে। আরেকটা ব্যাপার হলো, যারা ট্রায়াথলনে আসেন, তাঁরা খুব দুঃসাহসী। তাঁদের অনেকেরই নানা দুঃখ–দুর্দশা থাকে। কেউ হয়তো কোনো হতাশার মধ‍্যে আছেন, কারো হয়তো বিচ্ছেদ হয়েছে, কেউ হয়তো ক‍্যানসারে আক্রান্ত। এই শরীরচর্চার মাধ‍্যমে সে আসলে মুক্তি খুঁজছে। তাঁদের মাঝখানে থাকলে খুব অনুপ্রাণিত বোধ হয়।

প্রথম আলো:

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র বা কর্মক্ষেত্রও তো এমনটাই হওয়ার কথা। যেখানে সবাই সবাইকে অনুপ্রেরণা দেবে, প্রতিযোগিতা না করে নিজের কাজটা নিজে করবে…

আমার মনে হয় এটা এখনো সম্ভব। স্কুল থেকেই তো আসলে আমাদের এই প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি করে দেওয়া হয়। রোল নম্বর, মেধাক্রম, এসব আমাদের শেখায়—অন্যকে আমি সাহায্য করব না, করলে ও যদি আমার চেয়ে এগিয়ে যায়! আমার মনে হয় এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আমি যেমন জীবনে কখনো প্রতিযোগিতার মধ‍্যে থাকতে চাইনি। গবেষণাতেও এমন সব ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি, যা নিয়ে অন্য কেউ কাজ করছে না। যেন কারো সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় না নামতে হয়।

প্রথম আলো:

সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্ভাবন বিভাগটা আপনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখানে আপনাদের কাজটা কী?

এই যে এত গবেষণা হচ্ছে, বিশেষ করে এআই নিয়ে, এগুলো কীভাবে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করি। যেন গবেষণা থেকে মানুষ উপকৃত হতে পারে। আমরা যেমন অটিজম নিয়ে কাজ করছি। অটিজম যখন ধরা পড়ে, দুর্ভাগ‍্যজনকভাবে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। এআইয়ের মাধ‍্যমে, অ‍্যাপ কাজে লাগিয়ে কীভাবে প্রাথমিক অবস্থাতেই অটিজম শনাক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ ধরনের আরও অনেক প্রকল্প আছে। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ গবেষকদের একত্রিত করে, কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

প্রথম আলো:

দেশে আমরা প্রতিনিয়তই এআই নিয়ে কথা বলছি, বুঝতে পারছি যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে আমরা বোধ হয় এখনো ঠিক প্রস্তুত না। আপনার কি মনে হয়, কীভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা-তরুণেরা এই পরিবর্তনের কারিগরদের মধ‍্যে জায়গা করে নিতে পারে?

দুর্ভাগ‍্যজনকভাবে, এটার জন‍্য শুরুতেই একধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ের অবকাঠামো। না হলে সব কাগজে–কলমে থেকে যাবে। ২০ বছর আগে যেমন অধিকাংশ বিশ্ববিদ‍্যালয়ে কম্পিউটার ল‍্যাব ছিল না। এখন সব বিশ্ববিদ‍্যালয়ে আছে। কারণ এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি কম্পিউটার চালানো শিখতে চাই, আমার তো জানতে হবে এটা কীভাবে ব‍্যবহার করতে হয়। ঠিক তেমনি এআইয়ের ক্ষেত্রেও একধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা জানবে, কীভাবে নতুন প্রস্তাবিত কোনো অ‍্যালগরিদমকে বাস্তবায়ন করতে হয়, আরও সমৃদ্ধ করতে হয়। এগুলো বই পড়ে শেখা সম্ভব না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলেমেয়ে নিজে নিজে করছে। কিন্তু এটাকে গতি দিতে হলে ওদের সাহায্য করতে হবে, অবকাঠামো লাগবে।

প্রথম আলো:

বলা হচ্ছে, এআই অনেক চাকরির জন‍্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

মনে আছে ৮০ বা ৯০-এর দশকে গুলিস্তানের ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিয়ে স্কুলে যেতাম। দেখতাম বহু মানুষ বসে আছে টাইপরাইটার নিয়ে। তাঁদের কাজ টাইপ করা। কম্পিউটার আসার পর কিন্তু এই পেশাটা একরকম হারিয়ে গেছে। তখনো মানুষ একই কথা বলেছিল কম্পিউটার নিয়ে। কিন্তু কম্পিউটার আসার কারণে কিন্তু এমন নয় যে চাকরি কমে গেছে, বরং চাকরি আরও বেড়ে গেছে। ঠিক সে রকম এআইয়ের ক্ষেত্রেও অনেক নতুন ধরনের চাকরি তৈরি হবে এবং হচ্ছে। যেমন একটা চাকরি আছে—প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং। চ‍্যাটজিপিটির মতো একটা প্ল্যাটফর্মে আমি যখন কিছু লিখব, আমার লেখাটা (প্রম্পট) যত ভালো হবে, আমি তত ভালো উত্তর পাব। এই প্রম্পট ভালো লিখতে পারা প্রচুর লোক প্রয়োজন। আমার বিভাগেও আমরা অনেক চাকরির সুযোগ নিয়ে বসে আছি, কিন্তু লোক পাচ্ছি না। আমাদের অনেক লোক দরকার, কিন্তু সে রকম দক্ষ লোক নাই।

প্রথম আলো:

কীভাবে এই দক্ষতাটা আমরা অর্জন করতে পারি? কীভাবে তৈরি হলে চাকরির এই শূন‍্যস্থানগুলো পূরণ করতে পারি?

প্রথম কথা হলো—চোখ-কান খোলা রাখা। নতুন কী কী আসছে, সেসব জানা। আরেকটা ব্যাপার আমার মনে হয়, অনেক কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন কমে যাচ্ছে। যেমন কোডিং। এর চেয়ে যেসব কাজ মানুষ হাত দিয়ে করতে পারে, যেমন মেকানিকস, টেক্সটাইল, প্লাম্বিং (যেমনটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শেখানো হয়) এ ধরনের কাজের আবার নতুন করে দাম বাড়ছে। এআই একটা অস্ত্রের মতো। এই হাতিয়ার তখনই কার্যকর হবে, যখন আমরা এটা কাজে লাগাতে পারব। সে জন‍্য নীতিনির্ধারণে সুযোগ্য মানুষ দরকার, যাঁরা জানেন, কোন ধরনের সমস‍্যার সমাধান করা উচিত এবং কোন সমস্যাগুলোর জন্য এআইয়ের ওপর ঢালাওভাবে বিনিয়োগ করা উচিত। স্কুল–কলেজেও তথ্য, নীতিমালা, সুষ্ঠু প্রয়োগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। খোলা আলোচনা হওয়া উচিত কোন সমস‍্যা সমাধানে এআইয়ের কী ধরনের সাহায‍্য নেওয়া যায়। একটা খুব শক্তিশালী হাতিয়ার নিয়ে আমরা বসে আছি, কিন্তু জানি না কীভাবে এটা কাজে লাগাব, তাহলে তো কোনো লাভ নেই। এখন মেটা, গুগল, সবাই এই হাতিয়ার বানানোর কাজে লেগে পড়েছে। কিন্তু হাতিয়ারের সুষ্ঠু প্রয়োগ কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে খুব কম মানুষই ভাবছে। আমার ধারণা এখানেই অনেক কাজ করার সুযোগ আছে।

প্রথম আলো:

তাহলে তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আমাদের মস্তিষ্ক হলো অলস ছাত্রের মতো—সব সময় শর্টকাট খোঁজে। স্বল্পমেয়াদি চিন্তা করতে খুব ভালোবাসে, কারণ এতে ঝটপট ফল মেলে। তাইতো আমরা অল্প সময়ে যতটুকু কাজ করা সম্ভব, তার চেয়ে বেশি কাজের তালিকা বানাই। আর যখন সেই বিশাল তালিকার সামান্য অংশও শেষ করতে পারি না, তখন মন খারাপ করে হাহুতাশ করি। কিন্তু হওয়া উচিত একদম উল্টোটা! মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার জন্য। ভাবুন তো—এক বছর পরে আপনি কোথায় থাকতে চান? পাঁচ বছর পর কী করতে চান? ১০ বছর পরে আপনার জীবনের চাহিদাগুলো কি এখনকার মতোই থাকবে? যদি না থাকে, তাহলে সেই পরিবর্তনের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। অবশ্য, এটা এত সহজ না। কারণ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলাফল এত ধীরে আসে যে মাঝপথে আমরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। ঠিক যেমন ২০১৪ সালে এক ভদ্রলোকের ‘চিকেন ড্যান্স’ দেখে হতাশ হয়েছিলাম। যদি সেই হতাশায় ডুবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছেড়ে দিতাম, তাহলে আজ আমার ক্যারিয়ারের গতিপথ একেবারেই অন্য রকম হতো। তাই স্বল্পমেয়াদি ফলের পেছনে না ছুটে, দূরদর্শী পরিকল্পনা করুন। আর মস্তিষ্ককে বলুন, ‘ভাই, ধৈর্য ধরো, বড় কিছু পেতে হলে সময় লাগবেই!’