বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসা, ব্যবসার সঙ্গে বন্ধুতা
স্কুলজীবন থেকে একসঙ্গে আছেন মীর শাহরুখ ইসলাম ও যাফির শাফিঈ চৌধুরী। গড়ে তুলেছেন বন্ডস্টাইন টেকনোলজি লিমিটেড নামের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে এ বছর একসঙ্গে ‘ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া ২০২২’ তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছেন দুজন। বন্ধু যখন ব্যবসার ‘পার্টনার’ হয়ে ওঠে, তখন কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়? এ প্রসঙ্গে লিখেছেন মীর শাহরুখ ইসলাম
ক্লাস সিক্স, আমাদের বয়স তখন ১২। গোল গোল চশমার আড়ালে সব সময় ভিন্ন কিছু করার অভিপ্রায় নিয়ে চলত আমার বন্ধু যাফির। গভ. ল্যাব স্কুলের প্রথম সারির ছাত্র, ক্লাস ক্যাপ্টেন, বিতার্কিক এবং তুখোড় কুইজার। আর ইয়ে...বিভিন্ন স্কুলে তার ভক্তদের কথা না হয় না-ই বললাম।
আমি অনেকটাই উল্টো। ব্যাকবেঞ্চার। স্কুলজীবনের শেষ দিকে অনেকটা জোর করেই যাফির আমাকে সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িয়ে ফেলে। ঢাকা কলেজে উঠে আরও ‘ডানা মেললাম’। আমার বন্ধু হয়ে গেল সায়েন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আর আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট। একসঙ্গে আয়োজন করলাম দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান উৎসব, যেখানে আমাদের অংশীদার ছিল ইউনেসকো। বানিয়ে ফেললাম একটা রোবট। কলেজ শেষে যাফির ভর্তি হলো বুয়েটে আর আমি আইইউটিতে (ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি)। আর ঠিক তখনই আমাদের প্রযুক্তি নিয়ে বিভিন্ন কাজ করার দক্ষতা বাণিজ্যিক রূপ পেল।
ব্যবসা মানেই টাকাপয়সা, বিনিয়োগ, মতের মিল-অমিল। ব্যবসা শুরুর প্রথম তিন বছরে কম করেও অর্ধশতবার আমরা ব্যবসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আবার সরে এসেছি। আসলে এখনো আমরা শিখছি। আমার মনে হয়, বন্ধুর সঙ্গে কখনো ব্যবসা করা যায় না। বন্ধুকে নিয়ে একসঙ্গে অজানা পথ পাড়ি দেওয়া যায়। যেই পথে রয়েছে চড়াই-উতরাই, লাভ-লোকসান।
কেউ যদি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একটা ব্যবসপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে চান, সে ক্ষেত্রে কী করা উচিত? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা ভাগ করে নিই।
১. প্রথমে বন্ধু, পরে ব্যবসায়ী
বন্ধুত্বের পরিচয় ছাপিয়ে অন্য কোনো পরিচয় যেন মুখ্য হয়ে না ওঠে। মনে রাখবেন, আপনাদের ব্যবসায়িক অর্জনের মূলে থাকতে হবে ‘বন্ধুত্বের রসায়ন’। যেকোনো কাজে মতের অমিল হতেই পারে। কিন্তু মতানৈক্য কখনো যেন বন্ধুত্বে ফাটল না ধরায়। বন্ধুর সঙ্গে খোলাখুলি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে একদিকে যেমন কাজ সহজ হয়ে যাবে, অন্যদিকে দ্রুত ব্যবসায়িক প্রসার হবে।
২. বন্ধুকে অসম্মান করা যাবে না
আলোচনা-পরিকল্পনা-বাস্তবায়নের চাপে হয়তো এমন কোনো কথা বা ভাব প্রকাশ হয়ে যায়, যেখানে আপনার বন্ধু অসম্মানিত বোধ করে। অথবা আপনি হয়তো দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যেটি আপনার বন্ধুর ভালো লাগেনি। ছোট ছোট এই বিষয়গুলোই পরে বড় সমস্যা তৈরি করে। যেকোনো মূল্যে বন্ধুর—যিনি আবার আপনার ব্যবসায়িক অংশীদারও—সম্মান আপনাকে রক্ষা করতে হবে। কোনো বিষয় পছন্দ না হলে সরাসরি সেটি বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করুন। ভেতরে রাগ বা অভিমান পুষে রেখে কখনো ব্যবসা বড় করা যাবে না।
৩. হিসেবে স্বচ্ছতা নিয়ে যাবে বহুদূর
ব্যবসা মানেই টাকাপয়সা। আর যেখানেই অর্থ, সেখানেই অনর্থ। স্বচ্ছতা ব্যবসার সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। আমাদের দেশে অর্থসংক্রান্ত ঝামেলায় হরহামেশাই উদীয়মান ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। মালিকানার দ্বন্দ্ব, বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা—এগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রয়োজনে বন্ধুদের মধ্যে সময় নিয়ে কয়েকবার বসুন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখা উচিত—একজনকে ঠকানোর চেয়ে একসঙ্গে বড় হওয়া বেশি আনন্দের। সিদ্ধান্ত যদি আপনার ভালো না লাগে, সরে আসুন। কিন্তু অসৎ হয়ে নিজেদের বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব নষ্ট করবেন না।
৪. ‘প্যাশন’ যেন অটুট থাকে
ব্যবসায় প্রচুর চাপ থাকে। কিন্তু এই চাপ তখনই উপভোগ করা যায়, যখন আপনার কাজটাই হয়ে যায় আপনার ‘প্যাশন’, আগ্রহের ক্ষেত্র। ঝুঁকি নিন, ঝুঁকি নিতে সাহায্য করুন। কিন্তু কতটুকু ওপর থেকে পড়ে গেলে আপনারা টিকে থাকতে পারবেন, সেটা আপনাদেরই বের করতে হবে। আপনার বন্ধু হয়তো আকাশে উড়তে চায়, আপনি চান অন্য কিছু। কিন্তু বন্ধুর আগ্রহ বা প্যাশনকে কখনোই ছোট করে দেখবেন না। ব্যবসায়িক উন্নতিতে বন্ধুর দুর্দান্ত আইডিয়াগুলোর নিরাপদ ‘টেস্টবেড’ তৈরি করে দেওয়াই ভালো বন্ধুর পরিচয়।
৫. তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাফল্য
আমি আর যাফির একটা মজার কাজ করি। যেকোনো বিষয়ে প্রচুর তর্ক করি। একজন পক্ষে আরেকজন বিপক্ষে। কোনো আইডিয়া যত ভালোই হোক, তার কিছু না কিছু দুর্বল দিক থাকবেই। আমাদের কাজ হলো সেই দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করা। যত বেশি তর্ক-বিতর্ক হবে, আপনার আইডিয়ার সাফল্যের সম্ভাবনা তত বাড়বে। আমাদের জন্য এটি দারুণ কাজ করেছে। যেকোনো আইডিয়ার একটা ‘প্রাথমিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ’ আমরা নিজেরাই তৈরি করে ফেলতে পারি।