৩০–এর পর যেসব কারণে ওজন বাড়তে থাকে
কার দেহে কতটা মেদ জমবে, দেহের কোন অংশে বেশি মেদ জমবে, এগুলো কিন্তু আরও অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
পাশাপাশি দুটি ছবি। একই মানুষ। তবে বছর দশেকের ব্যবধানে তোলা ছবি দুটির চেহারায় বিস্তর পরিবর্তন। প্রথম ছবিটা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে তোলা, পরেরটা চাকরিজীবনে বছর পাঁচেক পেরোনোর পর। প্রথমটায় ছিমছাম চেহারা, মেদহীন শরীর। দ্বিতীয় ছবিতে চেহারায় বেশ একটা ভারিক্কি ভাব; দেহে বেশ মেদও জমেছে। অথচ আগের চেয়ে খুব যে বেশি খাওয়াদাওয়া হচ্ছে, তেমনটা কিন্তু না। তবু অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ওজন বাড়ার এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে মেদ জমার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষ করে বয়স ৩০ পেরোলেই ওজন বাড়তে থাকে। তাহলে কি ওজনের সঙ্গে বয়সের সম্পর্ক রয়েছে? জেনে নেওয়া যাক বিশেষজ্ঞ মতামত।
অধিকাংশ মানুষেরই ২০-২৫ বছর বয়স পর্যন্ত দেহের গঠনপ্রক্রিয়া চলমান থাকে। এ সময় দেহের বিপাক হার (মেটাবলিজম) বেশি থাকে। এ বয়স পর্যন্ত খাবার থেকে যে ক্যালরি গ্রহণ করা হয়, তার একটা বিরাট অংশ দেহের পেশি ও হাড় গঠন এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পূর্ণতা পাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। ফলে মেদ কম জমে। অন্যদিকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপাক হার ধীর হয়ে আসে। তাই কায়িক পরিশ্রম বা শরীরচর্চা করা না হলে রোজকার স্বাভাবিক খাবার থেকে পাওয়া ক্যালরির অনেকটাই আর খরচ হওয়ার সুযোগ থাকে না। এই ক্যালরি তখন মেদ হিসেবে শরীরে জমা হতে থাকে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকথাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী কনসালট্যান্ট তাসনোভা মাহিন।
আরও জানালেন, কার দেহে কতটা মেদ জমবে, দেহের কোন অংশে বেশি মেদ জমবে, এগুলো কিন্তু আরও অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। বংশগতভাবেই কারও কারও মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। তাই কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়, খুব বেশি না খেলেও মুটিয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিভেদে একই বয়সীদের মধ্যেও বিপাক হার কমবেশি হতে দেখা যায়। পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস এবং কায়িক শ্রম বা পেশার ধরনও গুরুত্বপূর্ণ। কতটা খাচ্ছেন, কী ধরনের খাবার খাচ্ছেন, এগুলো সবই ওজনের নিয়ামক। ভৌগোলিক পরিবেশও একটি প্রভাবক। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে যেমন পেটে চর্বি জমার প্রবণতা দেখা যায়। তবে এসবের পরেও নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে যে কেউ নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।
নারী-পুরুষে ওজন বাড়া–কমার পার্থক্য
হরমোনের কারণেও ওজন এবং শারীরিক গঠনের তারতম্য হয়। টেস্টোস্টেরনের (পুরুষ হরমোন) প্রভাবে ছেলেদের যেমন পেশি হয় সুগঠিত, তেমনি ইস্ট্রোজেনের (নারী হরমোন) প্রভাবে মেয়েদের শরীরে মেদ জমে বেশি। প্রাকৃতিকভাবেই নারীদের ক্ষেত্রে নিতম্ব ও স্তনে মেদ জমার প্রবণতা বেশি। তবে শরীরে মেদ জমতে জমতে একপর্যায়ে ‘ডাবল চিন’ হতে পারে যে কারোরই। আবার বয়স ৫০-৬০ পেরোলে খাবার কম গ্রহণ, হরমোনের মাত্রা হ্রাস এবং নানা রোগের কারণে নারী-পুরুষ উভয়েরই ওজন কমতে পারে।
সবারই চাই নিয়ন্ত্রিত ওজন
বয়স হলে কেন ওজন বাড়ে, তা তো জানা হলো। তাই ২৫ পেরোনোর পর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সচেতন থাকতে হবে সবাইকেই। অসচেতনতায় আস্তেধীরে ওজন বাড়তেই পারে।
রোজ অন্তত ৪৫ মিনিট শরীরচর্চা করুন। ঘরে হোক, ছাদে হোক, পার্কে হোক কিংবা হোক ব্যায়ামাগারে, শরীরচর্চা করতেই হবে। বৃষ্টি, হিমেল হাওয়া কিংবা গরম-ঘাম—কোনো কিছুকেই আমলে নেওয়া যাবে না। সুস্থতার জন্য শরীরচর্চার বিকল্প নেই।
যাতায়াতের পথেও রোজ কিছুটা হাঁটুন।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। চিনির পরিমাণ কমিয়ে দিন। মিষ্টি খাবার কম খান। চায়ে চিনি নেবেন না।
রোজকার খাদ্যতালিকায় শর্করাজাতীয় খাবারের পরিমাণ কম রাখুন। পরিশোধিত (রিফাইনড) শর্করা এড়িয়ে চলুন। লাল চাল ও লাল আটার তৈরি খাবার খাওয়া ভালো।
প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খান।
বিভিন্ন ধরনের বাদাম, ডাল ও বীজজাতীয় অন্যান্য খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন।
চর্বিযুক্ত খাবার এবং অতিরিক্ত তেল দেওয়া খাবার বর্জন করুন।
প্রক্রিয়াজাত খাবার খাবেন না। ফাস্ট ফুড খাবেন না। বেকড খাবার কমিয়ে দিন।
সস, কেচাপ, চাটনি বা আচার এড়িয়ে চলুন।
ওজন কমানোর ভুলেও ওজন বাড়ে
ওজন বাড়লে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। তাই ওজন বেশি থাকলে তা কমানোর চেষ্টা অবশ্যই দারুণ ইতিবাচক এক উদ্যোগ। কিন্তু ওজন কমাতে গিয়ে যদি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেন, তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আদর্শ নিয়ম অনুযায়ী, সপ্তাহে আধা কেজির বেশি ওজন কমানো উচিত নয়। একটু বেশি কমাতে চাইলে বড়জোর এক কেজি। এর বেশি নয়। অতি দ্রুত ওজন কমালে সেই ওজন ধরে রাখা যায় না। কারণ, দ্রুত ওজন কমালে কিছুদিন পর থেকেই খাবার থেকে প্রাপ্ত ক্যালরি দেহে আবারও চর্বি হিসেবে জমা হতে থাকে। তাই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকেই ধীরেসুস্থে ওজন কমান। ওজন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণে এবং ওজন কমাতে আপনার করণীয় সম্পর্কে জানতে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। কিছু রোগেও ওজন বাড়তে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শেরও প্রয়োজন হতে পারে।