‘বাচ্চা নিচ্ছ না কেন, কোনো সমস্যা?’—এমন প্রশ্ন করে কাউকে ‘উত্ত্যক্ত’ করছেন না তো
‘আমি তো আপন মনে করেই জিজ্ঞেস করলাম, ও এমন রিঅ্যাক্ট করল কেন!’—কাউকে কোনো প্রশ্ন করার পর কখনো কি আপনার এমন মনে হয়েছে? কিংবা এমন কি কখনো হয়েছে যে আপনি কাউকে কোনো প্রশ্ন করার পর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তিনি চুপ হয়ে গেছেন বা এরপর থেকে আপনাকে এড়িয়ে চলছেন? এমনটা যদি কখনো হয়ে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, তাঁকে আপনি বিব্রতকর কোনো প্রশ্ন করেছিলেন। বাস্তবিক অর্থে, নিজের মন থেকে কাউকে এতটা ‘আপন’ ভেবে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসাটা ঠিক দায়িত্বশীল আচরণ নয়।
সামাজিক আলাপচারিতার সময় অবশ্যই নিজের সীমা খেয়াল রাখুন। প্রশ্ন করে কাউকে ‘উত্ত্যক্ত’ করবেন না। বিয়ে কিংবা সন্তানধারণের মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলাপ করা থেকে বিরত থাকুন। ‘বিয়ে কবে করবা?’ কিংবা ‘বাচ্চা নিচ্ছ না কেন, কোনো সমস্যা?’ এমন প্রশ্ন কিন্তু আপনার বিচার-বিবেচনা বোধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আবার কেউ হয়তো বিয়ে করেছেন বেশ কিছুদিন হলো। কবে তিনি বাচ্চা নিচ্ছেন, এ নিয়ে অত্যুৎসাহ দেখাবেন না। কিংবা কারও হয়তো অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি সন্তানের জন্ম হয়েছে। পুত্রসন্তানের আশায় বারবার সন্তান নিচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্ন করতে যাওয়াও অবান্তর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের জীবনাচরণের সবটাই সংস্কৃতির অংশ। সভ্য জাতির সংস্কৃতি উন্নত। সভ্য জাতির আলাপচারিতা হয় মার্জিত। এমন আচরণ করা হয়, যাতে কেউ আঘাত না পায়। তাই ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করাটা সমীচীন নয়।’
মনের ওপর প্রভাব
অস্বস্তিকর প্রশ্নবাণে কাউকে জর্জরিত করলে সেই আঘাতের ক্ষত কতটা গভীর হয়, এমনকি আপনি কৌতূহলের বশে প্রশ্ন করলেও এই প্রশ্নের স্বরূপটা তাঁর জায়গা থেকে কেমন, কখনো ভেবে দেখেছেন কি? এমন অনেক বিষয় থাকে, যা নিয়ে ব্যক্তি নিজেই হয়তো মর্মাহত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, সেটা নিয়ে আপনি আবার যখন তাকে প্রশ্ন করেন, তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। এসব প্রশ্ন তাঁর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ সম্পর্কে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক জানালেন, নেতিবাচক প্রশ্নে একজন ব্যক্তি বিপন্ন বোধ করতে পারেন। সেখান থেকে তাঁর মনে আতঙ্ক জন্মাতে পারে। নেতিবাচক চিন্তা, হতাশা, এমনকি অপরাধ বোধ এবং হীনম্মন্যতায়ও ভুগতে পারেন তিনি। যখন কেউ নিয়মিত এসব প্রশ্ন শুনতে শুরু করেন, তখন তিনি সামাজিক আয়োজনও এড়িয়ে চলতে পারেন। যত দিন বেঁচে থাকতে হবে, তত দিন এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, এমন ভাবনায় আক্রান্ত হতে পারে মন। আত্মহত্যার প্রবণতাও সৃষ্টি হতে পারে।
এসব প্রশ্ন তাই করবেন না
কারও আয়রোজগার নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। ‘সরকারি চাকরি হয় নাই?’ কিংবা ‘সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলে কেন?’ এমন প্রশ্নও করবেন না। স্বামীর প্রচুর অর্থ থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী কেন চাকরি করেন কিংবা একজন নারীর স্বামী কেন চাকরিবাকরি করেন না, এসব আপনার মাথাব্যথা নয়। কেউ বিয়ের পর কেন মা-বাবার বাড়িতে থাকেন কিংবা কেন মা-বাবার সংসার থেকে আলাদা হয়েছেন, কোন পরিবারের খরচ কে জোগান, এসব প্রশ্ন করাটা রীতিমতো অভদ্রতা।
কেউ হয়তো বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন মানবিকের কোনো বিষয়ে। এ নিয়েও প্রশ্ন নয়। তিনি মেডিকেল বা প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন কি না, জানতে চাওয়াটাও অবান্তর। আর আপনি যদি জেনে থাকেন, তিনি পছন্দের বিষয়ে সুযোগ না পেয়ে অন্য বিষয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন, তা নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্ন করতে তো যাবেনই না।
এক বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে অনেককেই ভিন্ন বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে দেখা যায়, কেউ কেউ নিজেই হন উদ্যোক্তা। ‘এত পড়ালেখা করে শেষমেশ বাসায় বাসায় খাবার ডেলিভারি দাও’ বা ‘কাপড়ের ব্যবসা করছ?’—এমন প্রশ্ন আপনার হীনম্মন্যতারই পরিচয় দেবে।
কারও বিবাহবিচ্ছেদ হলে ‘সংসারটা টেকাতে পারলে না কেন?’ কিংবা ‘আবার নতুন করে সংসার শুরু করছেন না কেন?’ এমন প্রশ্ন করবেন না।
‘তোমার পরীক্ষার ফল খারাপ হলো কেন?’, ‘আপনার ছেলেকে অমুক স্কুলে ভর্তি করাতে গেলেন কেন?’, ‘মেয়েকে ড্রয়িং ক্লাসে দিতে গেলেন কেন?,’ ‘অমুক জমিটা ডেভেলপারকে দিচ্ছেন না কেন?’, ‘কেন খামোখা এত টাকা খরচ করছেন?’, ‘কেন মুটিয়ে যাচ্ছেন?’, ‘আপনার হাঁটার ভঙ্গিটা এমন কেন?’, ‘আপনার বয়স কত?’—এসব প্রশ্নও করবেন না।
কোনো অভিভাবককেও কখনো তাঁর সন্তানের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। খেয়াল রাখবেন, বয়োজ্যেষ্ঠ মা-বাবাকে অনেক সংবেদনশীল প্রশ্ন ভীষণ বিব্রতকর এবং কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে।