জয়াবর্ধনে–সাঙ্গাকারাদের রেস্তোরাঁর নাম মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব, শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে সেখানেই খেয়েছি

রেস্তোরাঁর নাম মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব। সোজা বাংলায় ‘কাঁকড়া মন্ত্রণালয়’। প্রতিষ্ঠাতা তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তি—শ্রীলঙ্কার দুই সাবেক ক্রিকেটার মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমারা সাঙ্গাকারা আর শেফ দর্শন মুনিদাসা। রেস্তোরাঁটিতে খেতে গিয়েছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম

অতিথিদের চাহিদার কথা ভেবে চিংড়ি এবং অন্য মাছের বৈচিত্র্যময় আয়োজনও আছে কাঁকড়া রেস্তোরাঁয়
ছবি: সংগৃহীত

শ্রীলঙ্কায় কয়েকটা দিন প্রকৃতির সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলাম। পাহাড়ঘেরা নুয়ারা এলিয়ার লেক গ্রেগরির পাশে হাঁটা। চা-বাগানের মাঝখানে লিটল ইংল্যান্ড নামে গড়ে ওঠা একটা পাড়ায় বৃষ্টিমুখর রাতযাপন। পরদিন শরতের স্নিগ্ধ ভোরেই শীতের আমেজ। পাহাড়ের উঁচুতে চা-বাগানের ভেতর হেঁটে বেড়াই। এ রকম জায়গাতে যে জোঁকের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় আমাদের তা মনে করিয়ে দিলেন কটেজের ম্যানেজার। এরপর ছোট্ট পাহাড়ি শহর এল্লার আশপাশে পাহাড় ও ঝরনা দেখি। লোকালয় ছাড়িয়ে হাইকিং করে মিনি অ্যাডামস পিকের ওপরে উঠে চারদিকের বনভূমি ও পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখি। রাবণ ফলসে ২৫ মিটার উঁচু থেকে নামছে জলধারা।

রামায়ণ পড়ার স্মৃতি থেকে শ্রীলঙ্কায় কী কী ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন আছে, সে বিষয়ে খোঁজ নিই। আমাদের গাইড বেশ হতাশ করেন। তিনি জানালেন, এখানে-ওখানে কিছু নামকরণ ছাড়া পৌরাণিক কাহিনির কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দেশের কোথাও নেই।

প্রকৃতি আমার প্রিয়। সারা দিন হেঁটে বেড়াতে ক্লান্ত বোধ করি না। কিন্তু সন্ধ্যায় ভালো খাবার চাই। নানা ধরনের খাবার খেতে ভালোবাসি। বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিক ভ্রমণকাহিনি লেখকদের রচনায় বিদেশি খাবার, বিশেষত ইউরোপীয় খাবার বিষয়ে বেশ রক্ষণশীল ও বিরূপ মন্তব্য পড়েছি। যুগ বদলেছে। বিদেশভ্রমণে গিয়ে অনেকেই এখন সেসব দেশের খাবার খেতে চান। আমি ফরাসি বা স্প্যানিশ খাবারের অনুরাগী। থাই, সিচুয়ান, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় খাবারও পছন্দ করি। নতুন কোনো দেশে বেড়াতে গেলে সেখানকার খাবার খেয়ে দেখতে চাই।

সেন্ট ক্লেয়ার জলপ্রপাত
ছবি: লেখক

নুয়ারা এলিয়া বা এল্লা—এসব জায়গায় হোটেলের ভেতরে বা বাইরের রেস্তোরাঁয় শ্রীলঙ্কান খাবার পাওয়া যায়। ভেবেছিলাম দক্ষিণ ভারতীয় খাবার এখানে ভালো হবে। কিন্তু এই অঞ্চলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে এঁদের ইউরোপীয় মেনু। সকালের নাশতায় রুটি মাখন, প্যানকেক, মাফিন, ডিম ও সসেজ থেকে রাতের খাবারে স্যুপ, মিষ্টান্ন পর্যন্ত সবকিছুতে উপনিবেশী প্রভুদের প্রভাব বা ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাঁরা। খাবারগুলো এত চেনা যে আলাদা করে আকর্ষণ বোধ করি না।

সেখান থেকে গাড়িতে করে আসি সমুদ্রতীরে গল নামের ছোট ও পুরোনো এক শহরে। এ শহর, মানে গল ফোর্ট ষোড়শ শতাব্দীতে গড়ে তুলেছিল পর্তুগিজরা। পরে ডাচ এবং সবশেষে ইংরেজদের হাতে শহরটি ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে ওঠে। এখানকার প্রতিটি ভবনে ও উপাসনালয়ে ওই তিন শ বছরের পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়। খাবারের ব্যাপারেও ওই শহরে পর্তুগিজ প্রভাব রয়েছে বেশি।

স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিই কলম্বো ফিরে গিয়ে সেখানকার যেকোনো ভালো হোটেলে স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে পারব। এ শহরের বড় হোটেলগুলোয় দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের প্রাধান্য চোখে পড়ে। সকালের ব্রেকফাস্ট বুফেতে আপাম, উত্তাপম, ইডলি ও দোসার রকমফের দেখে এবং চেখে মুগ্ধ হই।

কিন্তু আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল কাঁকড়া মন্ত্রণালয়ে!

আরও পড়ুন
প্রমাণ আকারের চিংড়িও মেলে কাঁকড়ার রেস্তোরাঁয়

কাঁকড়ার রাজ্যে

কোনো দেশে বেড়াতে যাচ্ছি শুনলেই অভিজ্ঞ স্বজনেরা কিছু পরামর্শ দেন। এবার পরামর্শ বা আদেশ নিয়ে হাজির হলো ছোটরা। বলে দিল কলম্বোয় কাঁকড়া-চিংড়ির যে বিখ্যাত রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেখানে যেন অবশ্যই আমরা যাই। একটু বেশি খরচ পড়লেও অভিজ্ঞতাটা হবে নতুন ও একেবারে আলাদা। এ ধরনের রেস্তোরাঁয় হঠাৎ করে জায়গা পাওয়া বেশ কঠিন। ফোন করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে রিজার্ভেশন পেলাম।

বিকেলে তাজ সমুদ্র হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে একটা টুকটুক নিলাম। রাস্তার পাশে একজনকে রেস্তোরাঁর নাম বলতেই পথ দেখিয়ে দিলেন। চত্বরের তিনদিকে অন্য দোকানপাট। এক প্রান্তে রেস্তোরাঁ। প্রতিষ্ঠাতা তিনজন অতি বিখ্যাত মানুষ। দর্শন মুনিদাসা শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত রাঁধুনি। শেফ হিসেবে দেশের বাইরেও অনেক দূর বিস্তৃত তাঁর খ্যাতি। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাবেক ক্রিকেটার মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমারা সাঙ্গাকারা। তিনজনে মিলে তৈরি করা রেস্তোরাঁর নাম মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব, কাঁকড়া মন্ত্রণালয়। দুই ক্রিকেটার আর তাঁদের শেফ বন্ধু যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছে। শ্রীলঙ্কার বাইরেও বেশ কয়েকটা শহরে চালু হয়েছে এই রেস্তোরাঁ।

তখনো দিনের আলো আছে। রেস্তোরাঁর ভেতরে যাওয়ার আগেই কয়েকটা ছবি তুলে নিই। তারপর ভেতরে গিয়ে একটা টেবিল নিয়ে বসি। ওদের ওয়েটাররা যথেষ্ট দক্ষ। একজন এসে আমাদের রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব ও খাবারের বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে বলেন। মূলত কাঁকড়ার রেস্তোরাঁ হলেও অতিথিদের চাহিদার কথা ভেবে চিংড়ি এবং অন্য মাছের বৈচিত্র্যময় আয়োজনও আছে। মুরগির মাংস আর ভেজিটেরিয়ান খাবারের ব্যবস্থাও আছে। মেনুতে আছে বিভিন্ন আকারের কাঁকড়ার ছবি, তাদের ওজন ও দামের ব্যাপারে দরকারি সব তথ্য। সবচেয়ে ছোট কাঁকড়ার ওজন আধা কেজি, আর সবচেয়ে বড় দুই কেজি। আমার আতঙ্কিত চেহারা দেখে পরামর্শ দিলেন, চিলি-গার্লিক দিয়ে রান্না করা ছোট একটা কাঁকড়া ও তাঁদের বিশেষ ধরনের রুটিই আমার জন্য যথেষ্ট। সেটা দুজনে শেয়ার করা যায়। আমার স্ত্রী রানি নেবে চিংড়ি। তাতে কয়েকটি বড় ও বেশ কিছু ছোট চিংড়ি থাকবে যা দুই থেকে তিনজন শেয়ার করা যায়।

শ্রীলঙ্কার দুই সাবেক ক্রিকেটার মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমারা সাঙ্গাকারার রেস্তোরাঁয় সস্ত্রীক লেখক
ছবি: সংগৃহীত

খাবার আসার আগে রেস্তোরাঁর ভেতরে আরও কয়েকটা ছবি তোলা হল। রেস্তোরাঁর নাম ও লোগোসহ বেশ কিছু স্মারকও এখানে বিক্রি হয়। টুপি, ছাতা, রান্নাঘরে ব্যবহার্য অ্যাপ্রোন ইত্যাদি আছে। ছবি তোলার জন্য বিশেষ করে সাঙ্গাকারা ও মাহেলার ছবির সামনে দাঁড়াই। সেই ঝুলন্ত ব্যানারে স্পষ্ট করে লেখা আছে, স্মারক বিক্রির লাভের টাকা শ্রীলঙ্কান কোনো চ্যারিটিতে দান করা হয়। কোন চ্যারিটিতে টাকা যাবে, ঠিক করে দেন ওই তিনজন।

টেবিলে প্লেট ছুরি কাঁটাচামচ ও ন্যাপকিন ছিল। কাঁকড়া আসার আগে বড় একটা বিব (শরীরের সামনের অংশ ঢেকে নেওয়ার মতো কাপড়ের আচ্ছাদন) এল। তারপর এল ম্যালেট, স্প্যাচুলা ও অন্যান্য সরঞ্জাম। কাঁকড়া খাওয়ার জন্য বিশেষভাবে তৈরি এসব যন্ত্র দেখতে প্লায়ার্স ও জাঁতির মতো। এমন হালকা ওজন যেন তা দিয়ে চাপ দিলে শুধু কাঁকড়ার ওপরের শক্ত খোসাটি ফাটবে। চূর্ণবিচূর্ণ করে শক্ত খোলসের গুঁড়া খাবারে মিশবে না। অথবা জোরে চাপ দিয়ে কাঁকড়ার পায়ের ভেতরের কোমল মাংসকে পিষে ফেলবে না।

তবু খাওয়ার সময় সাবধান হতে চেষ্টা করি। যন্ত্র যেমন বিশেষভাবে তৈরি, ব্যবহারেও তেমনি বিশেষ সতর্ক থাকি। দুই হাতে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাঁকড়া ভেঙে ভেঙে খাওয়ার অপরিশীলিত প্রক্রিয়াটিকে যথাসম্ভব মার্জিত ও সহনীয় করে তুলতে চেষ্টা করি। ওদের রান্না করা কাঁকড়ার নরম মাংসের স্বাদ সত্যি অপূর্ব। সাবধানতা সার্থক হলো। আমার জামাকাপড়ে কোথাও কোনো দাগ লাগল না। ভোজন প্রক্রিয়া শেষ করে বিব খুলে উঠে গিয়ে বেসিনে হাত ধোয়ার পর আনন্দটা আরও ভালোভাবে উপভোগ করলাম।

দেশে ফিরে আসার পর দেখি শ্রীলঙ্কার পাহাড় চা-বাগান, লেক ও ঝরনার দৃশ্য যেমন মনে গেঁথে আছে, তেমনি মনে আছে মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাবের খাদ্যবিলাস।

আরও পড়ুন