সম্রাট বাবরের জন্মস্থানে গিয়ে যা দেখলাম
উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ থেকে সকালেই ট্রেন ছাড়ল। বগিতে বেশির ভাগই স্থানীয় মানুষ, বাইরের মানুষ বলতে আমরা চার বাংলাদেশি আর কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে এসেছিল। যখন চোখ খুলে বাইরে তাকালাম, দেখি কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়। ধীরে ধীরে পাহাড়ের উচ্চতা বাড়তে থাকল। একটু পর খেয়াল করলাম, পাহাড়ের গায়ে শ্বেতশুভ্র বরফ লেগে আছে।
আমাদের গাইডের নাম মির্জা বেগ। সে জানাল, আমরা এখন নামানগান প্রদেশের নামানগান উপত্যকা পার হচ্ছি। উপত্যকার এক পাশে কিরগিজস্তান, অন্য দিকে তাজিকিস্তান। এ রকম সীমান্তবর্তী রেলপথ ১৫০ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই রেলপথ দিয়ে যেতে যেতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না—প্রকৃতির ছবি তুলব, ভিডিও ধারণ করব, না সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু দুচোখ ভরে উপভোগ করব!
রেলপথের পাশ দিয়ে সড়ক দেখছি। পাহাড়–পর্বত কেটে পথ বানানো হয়েছে এই পথ। চারদিক বরফের চাদরে ঢাকা। গাছের শাখা-প্রশাখা পর্যন্ত বরফে আচ্ছাদিত। এর মধ্যেই পাখি উড়ছে। আপন মনে বয়ে চলেছে সির দরিয়া নদী। ট্রেন থেকে দেখছি ছোট ছোট শহরতলি বরফে জড়িয়ে আছে। ঘাস চিবাচ্ছে ভেড়ার দল। এত দৃশ্য একসঙ্গে সেলুলয়েডে দেখা যায়। এমন সময় ট্রেনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন এসে বললেন, ‘রেস্টরুম ব্যবহার করতে চাইলে আগামী আধঘণ্টার মধ্যে করুন, ট্রেন একটি দীর্ঘ টানেলের মধ্যে প্রবেশ করবে।’
ব্যাখ্যার জন্য মির্জার দিকে তাকালাম। মির্জা বলল, ‘একটু পর আমরা ১৮ কিলোমিটার লম্বা একটি টানেলে ঢুকব। নামানগান উপত্যকার কামচিক পাসের ভেতর দিয়ে টানেলটি চলে গেছে। তখন ওয়াশরুম ব্যবহার করা যাবে না।’
হঠাৎ অন্ধকার। ট্রেনের সব লাইট জ্বলে উঠল। কামচিক পাস টানেল দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। আর টানেল শেষ হওয়ার পর আবহাওয়া বদলে গেল। কমে এল উচ্চতা। শুভ্রতা সরে গিয়ে চোখে পড়ছে বাদামিরঙা পাহাড়। মনে হলো এতক্ষণ স্বপ্নের জগতে ছিলাম, এখন পৃথিবীতে ফিরে এলাম।
মনে পড়ল সম্রাট বাবরের কথা। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের জন্মস্থান আন্দিজান শহর দেখতেই আমাদের এই ছুটে চলা। সেখানে পৌঁছাতে আর কত দেরি?
মির্জা জানাল, আরও দেড় ঘণ্টা!
আন্দিজান রেলস্টেশন
আন্দিজান রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে মূল সড়ক পার হতেই বাবরের ভাস্কর্য। ঘোড়ার ওপর বসে আছেন সম্রাট। অনেকক্ষণ ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। শিল্পীর কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের সম্রাটের কতখানি মিল? হয়তো এ রকমই ছিলেন। ভাস্কর্য দেখার পর ইতিহাস আরও সজীব হয়ে ওঠে।
বাবরের বাবা ছিলেন পাশের ফারগানা অঞ্চলের রাজা। পরে তিনি আন্দিজানে এসে বসবাস করেছেন। আন্দিজানেই বাবরের জন্ম। ইতিহাস বলছে, বাবর তৈমুর লংয়ের বংশধর। বাবার মৃত্যুর পর ১৪৯৪ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। বাবরের পুরো জীবনটাই যুদ্ধে ভরা এক মহাকাব্য। একসময় পূর্বপুরুষ তৈমুর লংয়ের রাজধানী সমরখন্দ দখল করে তৈমুরী সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বাবর। পারেননি। বরং সব রাজ্যই তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপর ভাগ্য তাঁকে আফগানিস্তানে নিয়ে যায়। ১৫২৫ সালে কাবুল দখল করে হন সেখানকার শাসক। তারপর ভারতবর্ষের দিকে তাঁর নজর পড়ে।
এখানে আসার আগপর্যন্ত আমি জানতাম ফারগানা একটি শহর। সে ভুল ভাঙল। ফারগানা আসলে বিশাল উপত্যকা, যা উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান আর তাজিকিস্তানজুড়ে বিস্তৃত। উজবেকিস্তানের ফারগানা উপত্যকায় তিনটি প্রদেশ রয়েছে—ফারগানা, আন্দিজান ও নামানগান। ট্রেনে আসার সময় আমরা নামানগান প্রদেশ পাড়ি দিয়েছি।
সম্রাটের ভাস্কর্য চত্বর থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। এখন সম্রাটের স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে যাব। ১৫৩০ সালের আগ্রায় মৃত্যুবরণ করেন বাবার। কাবুলে তাঁকে সমাহিত করা হোক, এই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা। সম্রাটের সেই ইচ্ছা পূরণ করতেই ১৫৪৪ সালে আগ্রা থেকে বাবরের সমাধি সরিয়ে কাবুলে স্থানান্তরিত করেন তাঁর স্ত্রী। কাবুল থেকে অল্প কিছু মাটি এনে তৈরি হয়েছে এই স্মৃতিস্তম্ভ।
মেমোরিয়াল চত্বর আসলে একটি পার্ক। এখানে বাবরের আরও একটি ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ আর বাবর জাদুঘর রয়েছে। প্রথম ভাস্কর্যটিতে যোদ্ধা বাবরের রূপ তুলে ধরা হয়েছে, আর এখানে কবি বাবরের প্রতিমূর্তি, যেন চিন্তায় নিমগ্ন সম্রাট। বাবর কবিতা লিখতেন, সেই সঙ্গে লিখতেন দিনলিপি। চাগতাই ভাষায় লেখা সেই দিনলিপি উচ্চস্তরের সাহিত্য হিসেবে সমাদৃত।
ভাস্কর্য স্থান থেকে স্মৃতিস্তম্ভের দিকে এগিয়ে গেলাম। স্মৃতিস্তম্ভটি বেশ কিছু সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে হয়। স্মৃতিস্তম্ভের কাছে যেতে যেতেই দেখলাম সাদা চেরি ফুল ফুটে আছে। উজবেকিস্তান ভ্রমণে আন্দিজান এসেই কিছু ফুল দেখতে পেলাম। নয়তো সব গাছগাছালি একেবারে পাতাবিহীন। চেরিগাছ পেরিয়ে গেলেই সাদা মার্বেলের স্মৃতিস্তম্ভটি চোখে পড়ল। খানিক সময় সেখানে কাটালাম।
ততক্ষণে মির্জা বেগ জানাল, জাদুঘর খোলা হয়েছে। জাদুঘরটি বন্ধই ছিল, মির্জা খোলার ব্যবস্থা করেছে। জাদুঘরের কিউরেটর খাদিজা ভীষণ হাস্যোজ্জ্বল এক নারী। আমাদের অভিবাদন জানালেন। জাদুঘরে সম্রাট বাবরের তৈলচিত্র, বংশতালিকা, ৩১ ভাষায় অনূদিত বাবরনামা, বাবরনামার পাণ্ডুলিপি, সম্রাট বাবরের ব্যবহার করা বাদ্যযন্ত্রের রেপ্লিকা, সম্রাটের একটি আবক্ষ মূর্তি দিয়ে সাজানো হয়েছে। জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আবারও ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো দেখে নিলাম প্রথম মোগল সম্রাটকে।
বেলা প্রায় ফুরিয়ে এল। শরীর কিছুটা আরাম চাইছে। মেমোরিয়াল চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম মোগল সাম্রাজ্যের পেছনের কথা। মোগল সাম্রাজ্যের কথা বললেই শক্তি-ক্ষমতা আর জৌলুশের কথা মনে পড়ে। লোদি বংশের ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে এই সাম্রাজ্যের পত্তন করেন বাবর। আর দিল্লিতে সেই সাম্রাজ্য স্থাপনের আগে বাবরকে পাড়ি দিতে হয়েছিল কত লম্বা পথ!