দেবতাখুমে বেড়াতে যাওয়ার আগে এই তথ্যগুলো জেনে রাখুন
দেবতাখুম। দুই পাথুরে পাহাড়ের মাঝখানে প্রায় ৪০০ মিটার দীর্ঘ স্বচ্ছ এক জলধারার নাম। নিরাপত্তার কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত ফেব্রুয়ারিতে জায়গাটার ওপর থেকে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে বান্দরবানের স্থানীয় প্রশাসন। একদল পর্যটকের সঙ্গে আরেক দফা জায়গাটা ঘুরে এলেন মুশফিকা রহমান
উঁচু উঁচু পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তারাছা খাল। রোয়াংছড়ি বাজার থেকে নেমে সেই খাল ধরেই আমরা হাঁটছি। নিঃশব্দ পাহাড়ি প্রকৃতি। খালের স্বচ্ছ জলে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় নিজেদের পায়ের শব্দই কানে বাজতে থাকে।
দলে আমরা নানা বয়সী ১৮ জন নারী। সবার পেশাও আলাদা। রোয়াংছড়ি থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দুজন স্থানীয় গাইড। তাঁদের দেখানো পথেই আমরা পা ফেলছি। দেবতাখুম ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির আগে বেশ কয়েকবার এসেছি। মনে হলো আগের চেয়ে প্রকৃতি আরও রূপসী হয়েছে। দীর্ঘদিন পর্যটকদের পা না পড়ায় পথের ধারে বড় বড় বুনো ঘাস ও লতাপাতা জন্মেছে। কিছু জায়গা পরিষ্কার করে স্থানীয়রা বাদাম চাষ করেছেন। ঝিরির পাশে এক বাদামচাষির সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি কিছু কাঁচা বাদাম হাতে তুলে দিলেন। পাহাড়ি বাদাম চিবুতে চিবুতে ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছে গেলাম শীলবান্ধা পাড়ায়। বেলা তখন ১১টা।
শীলবান্ধা পাড়ায় মিনিট দশেকের বিরতি। এই পাড়ায় বেশ ঘনবসতি। স্থানীয়দের বাড়িঘরের পাশাপাশি নতুন করে তোলা হয়েছে পর্যটকদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা—টংদোকান। দোকানগুলোতে পেঁপে ও লেবুর শরবত বিক্রি হচ্ছে।
শীলবান্ধা পাড়া থেকে নিচে নামতেই চোখে পড়ল টিকিট কাউন্টার। কাউন্টারের পাশাপাশি নতুন করে তৈরি হয়েছে ছবি তোলার বুথ ও বাথরুম। কাউন্টারে গিয়ে জনপ্রতি ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হলো। এই টাকাতেই লাইফ জ্যাকেটসহ নৌকা পারাপার, ভেলায় ঘোরা। প্রত্যেকে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি। মিনিট পাঁচেক হেঁটে খাদ পারাপারের জন্য নৌকার সিরিয়াল নিতে হলো। মাঝির কণ্ঠে গুন গুন পাহাড়ি সুর শুনতে শুনতে জায়গাটা পার হলাম।
জেনে রাখুন : ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল বা সায়েদাবাদ থেকে বাসে বান্দরবান সদরে যেতে হবে। এসব বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৯০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। বান্দরবান থেকে জিপে রোয়াংছড়ি বাজার। ১০–১২ জনের জিপ ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা। রোয়াংছড়ি বাজারে থানা ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হয়। এই ক্যাম্প থেকেই স্থানীয় গাইড দেওয়া হয়। এই পথে যেতে প্রতি ১০ জনে অন্তত একজন গাইড নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। গাইডপ্রতি সম্মানী এক হাজার টাকা। রোয়াংছড়ি বাজার থেকে এক কি দেড় ঘণ্টা হাঁটলেই দেবতাখুম। এখানে এন্ট্রি ফিসহ ভেলা বা নৌকা ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা।
নৌকা থেকে নেমেই আবার ভেলার সিরিয়াল। দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানালেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর পর্যটকের ভিড় বেড়েছে। শুরুতে দিনে হাজারের বেশি ভ্রমণপিপাসুও নাকি ঘুরে গেছেন। ভেলায় চড়তে চড়তেই নাকি অনেকের সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। আজ পর্যটকের সংখ্যা ৪০০ ছুঁই ছুঁই। সিরিয়াল পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।
কয়েকটা বাঁশ একসঙ্গে করে বানানো হয়েছে ভেলা। কোনো ভেলায় ওঠা যায় দুজন, কোনোটায় একজন। চালাতে হয় নিজেকেই। কেউ চাইলে ডিঙিনৌকাও নিতে পারেন। তবে বাঁশের ভেলায় ঘুরতে না পারলে দেবতাখুম ভ্রমণ মনে হয় অসম্পূর্ণ।
আমি একাই একটা ভেলায় উঠে পড়লাম। বইঠা বাওয়ার সময় মনে আতঙ্ক ভর করল, প্রায় ৭০ ফুট গভীর খুমে পরে গেলে কী হবে! এর মধ্যেই ‘ওমা, পড়ে গেলাম, পড়ে গেলাম’ চিৎকার। পেছনে তাকিয়ে দেখি এক কিশোরী। তার ভেলা কখনো ডানে যাচ্ছে তো কখনো বাঁয়ে! অন্যরা পরামর্শ দিয়ে চলেছে কীভাবে চালাতে হবে।
আমার নিজের অবস্থাও তার চেয়ে খুব একটা ভালো না। কিন্তু প্রকাশ করছি না। মুচকি হেসে ভেলা বাইছি। চারদিকে টলমলে জল। তাতে এসে পড়ছে দুপুরের সোনাঝরা রোদ। সেই রোদের চিকচিক ভেদ করে এগিয়ে চললাম। এই গা ছমছম রোমাঞ্চকর অনুভূতি দ্বিগুণ হয়ে গেল বাঁয়ে মোড় নেওয়ার পর। গায়ে এসে লাগল শীতল বাতাসের ঝাপটা। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। খুমের এই অংশে পাহাড় ভেদ করে রোদ পৌঁছায় না। পাহাড় থেকেও যেন শিরশির করে বের হচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া। এই অংশে খুমের গভীরতা বেশি। খুমের শেষ প্রান্তে পাথরে ঘেরা একটা পথ দূরে চলে গেছে। সেই পথে লাল কাপড় বাঁধা। মানে সীমানা শেষ, আর যাওয়া যাবে না।
সেই সীমানার ধারে ছবি তুলে ফেরার পথ ধরে মনে মনে ভাবলাম, হয়তো কোনো দিন লাল কাপড়ের ওপারের অদেখাকেও দেখতে পাব।