আজ সাইকেল চালাতে হবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন দশম পর্ব

চার ঘণ্টা সাইকেল চালানোর পর বিরতি
ছবি: সংগৃহীত

তমাসিনা মাদাগাস্কারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এটি মূলত বন্দর নগরী। ১০০ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে সেখানেই যাব।

ভোরে দুই সাইকেল আগপিছ করে যাচ্ছি। মাদাগাস্কারে যা সমতল, বাংলাদেশে তা পাহাড়ি এলাকা। চড়াই ঠেলতে হচ্ছে। নাতিদীর্ঘ বলে গায়ে লাগছে কম। মেঘলা সকাল, বৃষ্টি আসবে যে কখন, সেটা অনুমান করা গেল না। আজ অবশ্য সেসব নিয়ে ভাবনা নেই। সাইকেল আর পা ঠিক থাকলে চালাতে থাকব। সাড়ে নয়টার দিকে চঞ্চলদের সাইকেলের পেছনের চাকা পাংচার হলো। ত্বরিত ঠিক করে আবার শুরু। সবার মধ্যেই তাড়া। ১০০ কিলোমিটার আমাদের জন্য অনেক। বিশেষত, মাদাগাস্কারের জন্য সংখ্যাটা ভয়ের।

প্রথম বিরতি নিলাম ১০টায়। চার ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার চালিয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছে এভাবে গেলে বিকেলের আগে পৌঁছাব। দ্রুত যাওয়ার জন্য দুপুরের খাবারের আগে আর কোনো বিরতি নেব না।

চলতে চলতেই বৃষ্টি শুরু হলো। দেড়টা বাজে। ৬০ কিলোমিটারের বেশি চালিয়েছি। এখন খাবারের বিরতি দেওয়া যেতেই পারে। এদিকে লোকালয় আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছনের ঘরগুলো দেখা যায়। ঠিক পাড়া নয়। রাস্তার দুই পাশ জংলা। থামব থামব করছি, এরই মধ্যে আমাদের সাইকেলের পেছনের চাকা পাংচার হলো। থামালাম। কাকতালীয়ভাবে একটি বড় ঝুপড়ি একদম কাছে। সাইকেলটা রেখে ওখানে গেলাম আগে। এটা গ্রাম্য হোটেল। নুডলস আর কয়েক ধরনের পিঠা করা আছে। চায়ের এন্তেজাম দেখা গেল। অন্যান্য মুদি থেকে এর পার্থক্য হলো, এখানে বসার জায়গা আছে।

পথে হঠাৎ বৃষ্টি
ছবি: সংগৃহীত

খাবারের অর্ডার দিয়ে আমি চাকাটা খুলে নিয়ে এলাম। টিউব পাল্টাতে সময় নিল না। খাবার বলতে নুডলস আর সঙ্গে ডিম। বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ফারাক খুঁজে পেলাম না। গ্রামের দোকানগুলোতে এখন নারীরাও কাজ করেন। এখানেও তাই। এই দোকানি দুই সন্তানের মা। তাঁর সঙ্গে শামিমা আপার খাতির হলো।

আমি সাইকেলে চাকা লাগাচ্ছি, এরই মধ্যে চঞ্চলরা চলে এল।

বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু আকাশের মেঘ কাটেনি। গুড়গুড় শব্দ আসছে মাঝেমধ্যে। আড়াইটার দিকে আবার শুরু। টানা এক ঘণ্টা চালানোর পর আমার শরীর খারাপ লাগা শুরু হলো। কোনো দোকান পেলে থামব, এটা জানিয়ে দিলাম শামিমা আপাকে। আরও খানিক বাদে দোকান পাওয়া গেল। একটা ট্রাকস্ট্যান্ডের মতো। ভারী গাড়ির চাকার দাগ সর্বত্র। রাস্তার ওপরেই দাঁড়ালাম। এক কাঁদি কলা আর একটা বড় কোক নেওয়া হলো। আমার সুগারের সমস্যা আছে। খুব বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে। কোক বা ফল খুব কাজে দেয় এই সময়। হলোও তা-ই। অপেক্ষা করলাম কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। চঞ্চলদের খবর নেই। ফোনে চেষ্টা করা হলো।

ওদের না পেয়ে শুরু করলাম চালানো। শুরুতেই চড়াই। যাক, আমাদের গতি কমবে কিছুটা। সমতলে ট্যান্ডেম ভয়াবহ। গতি উঠলে এর থেকে আরামের কিছু নেই। ট্রেনের মতো, গতি ওঠাতেই কষ্ট। উঠে গেলে অবিরাম চলে যায়। আরও এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। থামলাম আবার আরেকটা দোকানে। ঝুপড়ি দোকান। এটাই এখানে চল। একজন নারী বসে আছেন। দোকানে মনিহারি সদাইপাতির সঙ্গে চাল-ডালও আছে। আছে শুঁটকি। মাছি উড়ছে ভনভন করে। প্লাস্টিকের বয়ামে খোলা বিস্কুট।

যেতে হবে আরও অনেকটা পথ
ছবি: সংগৃহীত

বসে বসে অস্থির। চঞ্চলরা আসছে না। এর মধ্যেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। সে কি মুষলধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টিতে তো ওরা আরও দেরি করবে। তমাসিনা খুব বাড়িয়ে ধরলে পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার হবে। হাতে অনেক সময়। কিন্তু ওদের তো পেতে হবে। এখন একসঙ্গে যাওয়া প্রয়োজন।

ঘণ্টাখানেক আমরা বসে বসে বৃষ্টি দেখলাম। এর মধ্যে ফোনে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। পাওয়া গেল না। সাইকেলটা রেখে ঝুপড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এলাম। হেঁটে এগিয়ে দেখার চেষ্টা। চান্দের গাড়ির মতো একটা গাড়ি আসতে দেখলাম। ডান দিকের ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলছিল। গাড়ি থামল আমাদের সামনে। আমাদের দুই সহযাত্রী। সামনের সিট থেকে দুজন নেমে এল। প্যাডেল নষ্ট হয়ে গেছে।

সাইকেল নামিয়ে দেখলাম দুই প্যাডেলের মাঝখানে যে চেইন থাকে, তা আর কাজ করছে না। এভাবে সাইকেল চালানো একেবারে অসম্ভব নয়, তবে অনেক কিছু করতে হবে। আর সবকিছু করার পরও শুধু পেছনের একজনের প্যাডেলটা কাজ করবে। মূলকথা হলো, এটা নিয়ে আর চালিয়ে যাওয়া যাবে না। তাদের এই সমস্যা অনেক আগে হয়েছে। তাই তারা উপায়ান্তর না দেখে গাড়িতে চলে এসেছে। এখন যা করতে হবে, তা হলো বাঁ পাশের ক্র্যাঙ্কটা পাল্টে নিতে হবে। তমাসিনাতে পাওয়া যাবে। এদিকে রাস্তা সাইকেলের উপযোগী।

অনীহা সত্ত্বেও গাড়িতে উঠতে হলো। শামিমা আপা ভীষণ মর্মাহত হলেন। এই ট্রিপে যে কয়বার খুব মন খুলে চালানো গেছে, সে কয়বারই কিছু না কিছু ঝামেলা হয়েছে। আজ যেমন এমন সুন্দর রাস্তায় শুধু চড়ে থাকতে পারলেই চলে যাওয়া যেত। এক দিনে লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারলে নিজেদেরও ভালো লাগত।

বিকেল পাঁচটার একটু বেশি। শহরের কাছাকাছি এসে গেছি। অনেক দিন পর এত মানুষ একসঙ্গে দেখলাম। মাদাগাস্কারের গুলিস্তান কি তবে এটাই? রিকশার প্রাধান্য বেশি। দেখতে কিছুটা অন্য রকম হলেও ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হুবহু। সাইকেল অনেক। গাড়িও আছে। আমরা মনে হয়, একটা বাজার এলাকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তেজগাঁও থেকে রেলক্রসিং পার হয়ে কারওয়ান বাজারমুখী হলে যেমন একটা পরিবেশ, এখানেও অনেকটা তা-ই। কারওয়ান বাজারের চেয়ে কম হবে। কিন্তু মিল পাওয়া যাবে। হোটেল আছে ঠিক আমাদের মতোই। বেঞ্চ-টেবিলে অলস কিছু মানুষ।

হোটেল মেলভিলের বড় বিল্ডিং হাতের বাঁয়ে পড়ল। নিয়ন বাতির অক্ষরগুলো জ্বলে না উঠলেও বড় করে লেখা। সামনে শান-বাঁধানো পাকা জায়গাটাতে কম করেও চারটা গাড়ি একসঙ্গে রাখা যাবে। জিনিসপত্র নামিয়ে গাড়ি বিদায় করে ভেতরে যাওয়া হলো। খুব ভালো মানের হোটেল নয়। তবে বড় আর পরিষ্কার। একটা বড় রুমের ভাড়া বাংলা টাকায় চার হাজারের নিচে। সেদিক বিবেচনায় বেশ কম। রুম দেখে আসা হয়েছে। পছন্দ হয়েছে। বিশাল রুম। সবকিছু অনায়াসে রাখা যাবে। টিভিও আছে। সবকিছু ঠিক, বাদ সাধল সাইকেল। কোনোভাবেই রুমের ভেতরে নিতে দেবে না। আমাদের রুমটা দোতলায়। সাইকেল রাখতে হবে বাইরে গ্রিল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায়। হোটেলের ভাঙাচোরা খাট-টেবিল-চেয়ার রাখা হয়েছে এখানে। সব সময় তালা দেওয়া থাকে। প্রথমে নিমরাজি ছিলাম। ভাবলাম, আরেকটা হোটেল দেখি। সে কথা বলাও হলো হোটেলে। কিন্তু তারা অনড়। সাইকেল রুমে নেওয়া যাবে না। ভেবে দেখলাম, অন্য হোটেলে যাওয়া কঠিন হবে। কারণ, সবুজ সাইকেলটা ঠেলে নিতে হবে। পরের হোটেলে যে একই সমস্যা হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই বাড়াবাড়ি না করে রুমটা নিয়ে নিলাম।