বিলেতের আয়েশ ছেড়ে খাগড়াছড়ির পাহাড়ে এসে কেন থাকছেন রাসেল
বিলেতে ধরাবাঁধা চাকরি ভালো লাগল না। তাই আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারো থেকে আমাজনের গহিনে ছোটাছুটি করে এখন খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ে থিতু হয়েছেন। আয়েশি জীবন ছেড়ে গড়ে তুলেছেন বন। বন্য প্রাণী রক্ষায় এলাকার মানুষকে করছেন সচেতন। মাহফুজ রাসেলের ডেরায় অতিথি হয়েছিলেন সজীব মিয়া
কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট একটি ঘর, ভেতরে দুটি কামরা, লাগোয়া বারান্দা। চারপাশ বৃক্ষ-লতাগুল্মে ঠাসা। ঘরের একপাশে মাহফুজ রাসেল নিজে থাকেন, অন্য অংশটা অতিথিশালা। মধ্যদুপুরে বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ তিনটি বানরের আগমনে পা হারানো আশ্রিত কুকুরটির হাঁকডাকে আলাপে ছেদ পড়ে। সামনের গাছটায় ঝিরি থেকে একটি মাছরাঙা এসে বসে, অন্য গাছগুলোতেও নানা জাতের পাখির আনাগোনা। কুকুরটি শান্ত হলে মাহফুজ রাসেল বলেন, ‘আশপাশের পাহাড়ে নির্বিচার গাছ কাটা হচ্ছে। ঝিরিগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে; যা টিকে আছে, সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। তাই এখানে অনেক পাখি আর প্রাণীর দেখা মেলে।’
আগের দিন মাটিরাঙ্গা সদর থেকে রাসেলের আস্তানায় আসার পথেই তাঁর কথার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। পাহাড়ি বন রীতিমতো ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে, বনভূমিতে গড়ে উঠছে মানুষের আবাসস্থল, চলছে বাণিজ্যিক বৃক্ষের আবাদ। রাসেলের আন্দোলন এখন যে বনভূমিটুকু টিকে আছে, অন্তত ততটুকু যেন রক্ষা পায়।
বনের মায়ায়
মায়ের সঙ্গে রাসেলের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। বাবা গত হওয়ার পর রাসেল সিদ্ধান্ত নেন, যুক্তরাজ্য ছেড়ে একেবারে দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু চাইলেই তো আর ফেরা যায় না। বিলেতে দীর্ঘদিনের বাস, তাই ছেড়ে আসারও আছে নানা প্রস্তুতি। আর দেশে যে ফিরে আসবেন, থাকবেন কোথায়? ঢাকা শহর যে তাঁর ভালো লাগে না।
মাঝখানে কয়েক মাসের জন্য দেশে এলেন। বিভিন্ন জায়গায় জমি দেখলেন। তখনই মাটিরাঙ্গার পাহাড়ের সন্ধান পান। বন্ধুদের সহযোগিতায় কিনেও ফেলেন। পরে ম্যানচেস্টারের বাড়িটা বিক্রি করে ২০১৬ সালে সবকিছু গুটিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ‘ফেরার ছয় দিনের মাথায় মাটিরাঙ্গায় চলে আসি। পূর্ব খেদাছড়া গ্রামের একটি বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত করি। ভাড়াবাড়িতে থেকেই আমার আর তত্ত্বাবধায়কের ঘর তুলতে থাকি,’ বলেন রাসেল।
ঘর তৈরির সময়ে পাহাড়ি বন ধ্বংস ও বন্য প্রাণী শিকারের মহোৎসব দেখে আঁতকে ওঠেন রাসেল। মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে রোষানলেও পড়েন তিনি। বুঝতে পারেন, শিকার আর বনের গাছ কাটা স্থানীয় মানুষের দীর্ঘদিনের জীবিকা। বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না করলে তাঁদের এসব কাজ করা থেকে বিরত রাখা যাবে না। সেই কাজকেই ব্রত হিসেবে নিলেন রাসেল, গড়ে তুললেন একটি সংগঠন, নাম ‘পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগ’।
পিটা একটি পাখির নাম। কদাচিৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে যার দেখা মেলে। আর ছড়া তো প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ, পাহাড়ের প্রাণ। পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে বনের মতো ছড়া বা ঝিরিরও সুরক্ষা দরকার। এই পাখি আর প্রকৃতির সংযোগ ঘটাতে মাহফুজ রাসেল তাই উদ্যোগটির নাম দিয়েছেন ‘পিটাছড়া’।
নিজের ও বন্ধুদের কেনা ২৩ একর জায়গা বন্য প্রাণীদের জন্য ছেড়ে দিলেন রাসেল। গ্রামে গিয়ে গড়ে তুললেন পাঠাগার, চিকিৎসাকেন্দ্র। শিকার ঠেকাতে কাউকে দিলেন ব্যবসার মূলধন, কাউকে দেখালেন বিকল্প পেশার সন্ধান, এভাবে অনেকের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা হলো। অনেকে পুরোনো পেশা ছেড়ে দিলেন। দিনে দিনে পিটাছড়া বনটাও বৃক্ষরাজিতে ভরে গেল। সেখানে এখন ফিরতে শুরু করেছে বন্য প্রাণী। রাসেল বলছিলেন, ‘শজারু, ভোঁদড়, লজ্জাবতী বানরের মতো বিপন্ন প্রাণীসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয় এখন পিটাছড়া।’ পিঠাছড়ায় ১৫ প্রজাতির সাপের ছবি তুলেছেন রাসেল। তাঁর বনে বুলবুলি, ছাতারে, ধনেশসহ ১৫০ প্রজাতির পাখির দেখা পেয়েছেন এক পাখিবিশেষজ্ঞ।
রাসেল বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের মধ্যে গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে পাখি ও প্রাণী–গবেষকেরা আসবেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আসবেন, কাজ করবেন।’
কিলিমানজারো থেকে আমাজন
বাবার ছিল বদলির চাকরি। তিন–চার বছরের বেশি কোথাও থিতু হতে পারতেন না। ব্যাপারটি পরিবারের আর সবার কাছে যেমন–তেমন হলেও মাহফুজ রাসেলের কাছে ছিল দারুণ রোমাঞ্চকর। এভাবে ঘোরাঘুরির একটি পোকা সেই ছেলেবেলাতেই তাঁর মাথায় ঢুকে যায়।
১৯৯৩ সালে স্কুল-কলেজের পাঠ চুকে যেতেই ঘোরাঘুরির সেই পোকা ডানা মেলতে শুরু করে। তাই কলেজ থেকে বেরোনো মাত্রই বেরিয়ে পড়েন রাঙামাটির পথে; কখনোবা বান্দরবান-খাগড়াছড়ি। এরই মধ্যে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বিবিএ ও এমবিএ করেই ১৯৯৯ সালে চলে আসেন ঢাকা। মার্চেন্ডাইজিংয়ের ওপর একটি ডিপ্লোমা কোর্স করে ঢুকে পড়েন চাকরিতে। বছর দুয়েক চাকরির পর যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। ভর্তি হন ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনার বিষয় ছিল ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন মার্কেটিংয়ে। ২০০৫ সালে সেই পড়াশোনার পাটও চুকে গেলে নেমে পড়েন মার্চেন্ডাইজিংয়ের কাজে। ২০০৮ সালের শেষ দিকে নতুন আরেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সিদ্ধান্ত নেন অন্য কোনো পেশা বেছে নেবেন, যে পেশায় থেকে শখের পেছনেও সময় দেওয়া যাবে। আর তাই ভর্তি হলেন ম্যানচেস্টারের ইউনিভার্সিটি অব স্যালফোর্ডে, পড়াশোনার বিষয় ‘প্রপার্টি অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন’।
এরই ফাঁকে ফাঁকে যুক্তরাজ্য ও আশপাশের অঞ্চলের বড় বড় পাহাড়–পর্বতে আরোহণ করতে থাকলেন মাহফুজ। পাশাপাশি চলতে থাকে ইনডোর রক ক্লাইম্বিং। তবে এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু মাতৃভূমিকে ভোলেননি মাহফুজ।
বিশেষ করে বাংলাদেশের ছিন্নমূল শিশুদের কথা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা থেকে ঢাকার ছিন্নমূল শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন।
শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংস্থাকেও সহায়তা করতেন। তেমন একটি সংস্থার জন্য তহবিল গঠন করতেই গিয়েছিলেন কিলিমানজারো অভিযানে।
কিলিমানজারো জয়ের পর বেরিয়ে পড়েন আমাজন বনের উদ্দেশে। ইচ্ছা—আমাজনের গহিনে কোনো আদিবাসী পরিবারের সঙ্গে থাকা; কিন্তু ব্রাজিলে গিয়ে বুঝলেন, কাজটা খুবই কঠিন। আদিবাসীদের জীবনযাপন ও ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় বাইরের কাউকে তাঁদের সঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় না। তারপরও অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ইচ্ছাটা পূরণ করেছেন রাসেল। দুর্গম বনে এক পরিবারের সঙ্গে প্রায় দুই মাস থেকেছেন তাঁদের মতো করে।
আমাজন বন থেকে ফিরে শহুরে জীবনে অনেক দিন স্বাভাবিক হতে পারেননি মাহফুজ রাসেল। প্রায় ছয় মাস লেগেছে বন্ধু-পরিজনদের সঙ্গে মিশতে। কিন্তু বনের মানুষদের যে সহজ-সাধারণ জীবন দেখে এসেছেন, প্রকৃতির যে শিক্ষা তিনি রপ্ত করে এসেছেন, সেই শিক্ষাটাই এখনো বয়ে চলেছেন।
পিটাছড়া বন সেই জীবনশিক্ষারই ফল।