শততম দেশ ভ্রমণের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশি এই দম্পতি, কীভাবে খরচ জোগান তাঁরা
সাত মহাদেশের শততম দেশ ভ্রমণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন শাহারিয়াত শারমীন-রেজাউল বাহার। আগামী মাসে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের মাধ্যমে দেশ ঘোরায় সেঞ্চুরি হাঁকাবেন এই বাংলাদেশি দম্পতি। নিজেদের ভ্রমণজীবনের গল্প শোনালেন রেজাউল বাহার
শারমীনের সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে পরিচয়। ২০০৫ সালে গাঁটছড়া বাঁধা। সেই বছরই যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে শারমীন। তখন আমার মাস্টার্স শেষ হয়েছে। বুয়েটে পাঠ শেষ করে মার্কিন মুলুকেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম করছি। ছোটখাটো একটা চাকরিতে ঢুকেছি মাত্র। কানেটিকাট স্টেটের এক বাসায় আমরা সাবলেট উঠি। ঘাড়ে ঋণের বোঝা নিয়ে শুরু হয় দুজনের টানাহেঁচড়ার সংসার। কিছুদিন পর সেন্ট্রাল কানেটিকাট স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় শারমীন। ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। স্নাতকোত্তর করে একটা চাকরিতেও ঢুকে গেল। এত দিন অন্য কিছু ভাবা আমাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তার চাকরির পর টুকটাক ভাবতে শুরু করলাম। সেই ভাবনা ছিল ভ্রমণ নিয়ে।
২০০৮ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম আমরা একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কোনো দেশে বেড়াতে যাই। সেটা ছিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বাহামা। অভিজ্ঞতাটা মন্দ ছিল না। তবে সেই ভ্রমণে একটি রিসোর্টের অফার নিয়ে যে ঠকে এসেছিলাম, এত দিন পরও সেটা মনে আছে।
তার পর থেকে ভ্রমণ করেছি পরিকল্পনা করে। বলা যায়, রীতিমতো গবেষণা করে নতুন দেশে পা ফেলেছি। এভাবেই পেরিয়ে গেল ১৫ বছর। সব সময়ই মনে হতো আমাদের, যেভাবে আছি ভালো আছি, এর চেয়ে ভালো থাকার প্রয়োজন নেই। দম্পতি হিসেবে একসময় সচেতনভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সন্তান নেব না। এক জীবনে সবকিছু হওয়ার নয়। দুজনেরই ভ্রমণ পছন্দ। রোজগার যা হচ্ছে, ভ্রমণেই খরচ হচ্ছে। একসময়, প্রায় বছর ১০ আগে, নিজেদের পেশাগত ক্যারিয়ারও একটা জায়গায় আটকে দিলাম। ওপরে ওঠার প্রয়োজন নেই, বেশি অর্থ কামাতে গিয়ে বেশি দায়িত্ব নেওয়ারও দরকার নেই। যেভাবে চলছে চলুক, ভ্রমণটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি ছুটি কাজে লাগাতে হবে।
এখন বছরে ছুটির পরিমাণ ২৫-৩০ দিন। মাঝেমধ্যে সরকারি ছুটি থাকে। যে সপ্তাহে সরকারি ছুটি থাকে, তার সঙ্গে বাকি চার দিন ছুটি নিই। আর এই ছুটিতেই যাওয়া যায় একটা বা দুইটা দেশে। ভ্রমণ নিয়ে আমি যথেষ্ট গবেষণা করি, পরিকল্পনাটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এভাবেই বছরে সাত-আটবার আমরা দেশের বাইরে ভ্রমণে বের হচ্ছি।
সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয়
পৃথিবীর বহু জায়গায় আমি সূর্যোদয় দেখেছি। কিন্তু লোন্দার মতো সূর্যোদয় কোথাও দেখিনি। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের এলাকা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ার এই গ্রামেই আমার জন্ম। লোন্দা নিয়ে আমি একটি বইও প্রকাশ করেছি—গ্রামের নাম লোন্দা। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার ভালো লাগার প্রত্যেক মানুষকে আমি নিয়ে যাব লোন্দায়। তবে শারমীন হয়তো বলবে, তার দেখা সেরা সূর্যোদয়ের জায়গা কক্সবাজার। সাগরপারের এই শহরেই যে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
সেখানে আমরা আবার যাব
২০২১ সালে বিলাসবহুল জাহাজে করে আমাদের অ্যান্টার্কটিকা–যাত্রা ছিল সবচেয়ে ব্যয়বহুল। জনপ্রতি খরচ ছিল ২৫ লাখ টাকা। যাওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম। টাকা জোগাড় করতে হয়েছে, ২০২০ সালে কোভিড মহামারি এসে একবার পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। তাই অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ ছিল অনিশ্চয়তা, আনন্দ, উত্তেজনায় ভরা।
পুরো মহাদেশ, যা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় সমান, ঢেকে আছে বরফে। পুরো মহাদেশের ওপর গড়ে বরফের উচ্চতা সাত হাজার ফুট, প্রায় দুই কিলোমিটার। অ্যান্টার্কটিকার ছবি ভিডিও বা লেখায় কারও সামনে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এখানকার বিশালত্ব অনুভবের, দেখার মতো। সাগরে ভেসে আছে বড় বড় বরফের টুকরা, আইসবার্গ। সবচেয়ে বড় আইসবার্গটা সিঙ্গাপুরের থেকে পাঁচ গুণ বড়, ভেসে বেড়াচ্ছে সাগরে। বিজ্ঞানীরা সেটা পর্যবেক্ষণ করছেন। অ্যান্টার্কটিকার বরফ পুরোটা গলে গেলে সাগরে পানির উচ্চতা বাড়বে ২০০ ফুট। অর্থাৎ পৃথিবীর অর্ধেকটাই ডুবে যাবে পানিতে। এগুলো নিছক গল্প নয়, সত্য। সেই সত্যকে কাছ থেকে দেখে এসেছি।
অনেকেই বলেন, অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ ‘ওয়ানস ইন আ লাইফ টাইম’। কিন্তু আমরা আবার সেখানে যাব।
ভ্রমণে মানুষের ছোঁয়া
মরক্কোতে যাওয়ার আগে খোঁজখবর করে নিবন্ধিত নতুন একটা ট্যুর এজেন্সি বেছে নিয়েছিলাম। যে গাইড আমাদের সঙ্গী হয়েছিল, তার নাম মোহাম্মদ।
শারমীন আর আমি—দুজনই বন্ধুবৎসল মানুষ। তরুণ গাইড মোহাম্মদকেও সহজ করে নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, ছেলেটা যেন তার কাজটাকে কাজ না মনে করে, সময়টা যেন উপভোগ করে। হয়েছিলও তা-ই। সাহারা মরুভূমিতে তাঁবুবাসে যাব। পথটা কষ্টের। রিসোর্ট থেকে উটের পিঠে চড়ে যেতে হয়। আমরা দুজন উটের পিঠে, রাখাল নিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যে। সঙ্গে মোহাম্মদ। একটা সময় আমি নেমে পড়লাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। আমার হাঁটার উদ্দেশ্য যে মোহাম্মদকে সহানুভূতি জানানো, ব্যাপারটা সে হয়তো বুঝে ফেলেছিল। এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনাই আছে। তাই তো বিদায়বেলায় ছেলেটা আমাদের জন্য উপহার নিয়ে এল। তার নিজেরও সংসার আছে, চার-পাঁচ দিনে বুঝেছি, সেই সংসারে টানাপোড়েনও আছে। তবু সে অর্থ খরচ করে উপহার কিনেছে এবং নিতে বাধ্য করছে। তাই হাত না মিলিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ছেলেটা আনন্দে কাঁদল। তার দুফোঁটা জল আমাদের ভ্রমণের অনেক বড় পাওয়া। আজও মোহাম্মদের খোঁজ নিই। ওদের ছোট ট্যুর এজেন্সি এখন অনেক বড় হয়েছে।
পথে পথে এমন অনেক মানুষের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় যারা আমাদের হৃদয় ভরিয়ে দিয়েছে।
শততম দেশ ভ্রমণে থাকছে বন্ধুরা
একটা সময় পর্যন্ত ভ্রমণের সংখ্যার দিকে আমরা তাকাইনি। দুজন মনের আনন্দে শুধু ঘুরতে চেয়েছি। কিন্তু ১০, ২০ করে ৯০–এ পৌঁছে মনে হলো, শতকের মাইলফলকটা তো উদ্যাপন করাই যায়! বাংলাদেশি দম্পতি হিসেবে আমরাই হয়তো প্রথম একসঙ্গে ৭ মহাদেশের ১০০ দেশ ভ্রমণ করতে যাচ্ছি। সেই ভেবে উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমরা এরই মধ্যে ৯৮টি দেশ ভ্রমণ করেছি। কম্বোডিয়া হবে আমাদের ৯৯তম দেশ। সেখানে দুই দিন থেকে ২১ নভেম্বর চলে যাব ইন্দোনেশিয়ায়। ছোটবেলার ৩২ বন্ধু তাদের পরিবারসহ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যাবে। এরই মধ্যে তারা বিমানের টিকিট কেটে রেখেছে। সেখানে একটি ভিলা ঠিক করে রেখেছি আমরা। এখানেই হবে আমাদের ১০০ মাইলফলকের উদ্যাপন। বন্ধুদের এই অংশগ্রহণ আমাদের জন্য অনেক বড় এক প্রাপ্তি।
প্রথম প্রথম ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল অবকাশযাপন, একসময় তা রক্তে মিশে যায়। এখন জীবনের প্রথম অগ্রাধিকার—ভ্রমণ। সেদিন শারমীনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, ১০০ দেশ হওয়ার পর কি আমরা পৃথিবীর সব দেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করব?’
তার উত্তর, ‘না। আমরা কখনো কোনো কিছুর পিছে ছুটব না। ভ্রমণ উপভোগ করব, কখনো কোনো মাইলফলক এসে দাঁড়ালে ছুঁয়ে দেখব।’