এখানে ওপেনহাইমার থাকতেন?
না, আমরা পথ ভুলে অন্য কোথাও যাইনি। পথ হারানোর সম্ভাবনাই নেই। আমেরিকায় গুগল ম্যাপ এখন এতটাই নিখুঁত যে ট্রাফিক লাইটগুলোও দেখা যায়। ওপেনহাইমারের বাড়ির সামনেই আমরা আছি। ঠিক সামনে। হাতছোঁয়া দূরত্বে। তারপরও মনে সন্দেহ। এই কি ওপেনহাইমারের বাড়ি? কী করে হয়! এত সাদাসিধে? কোনো ফটক, নামফলক, আলোকবাতি, পথ দেখানো সাইন—কিছুই তো পেলাম না। তাহলে কি অন্য কোথাও এসে পড়েছি? মনের এই প্রশ্ন মুখ ফুটে যে কাউকে বলব, আশপাশে তেমন কেউও নেই। উপায়?
আলবুকার্কি, নিউ মেক্সিকো
নিউ মেক্সিকো আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আর আলবুকার্কি তার সবচেয়ে বড় শহর। এ শহরের নাম অন্য আর দশটি বড় শহরের মতো প্রচলিত নয়। কিন্তু ‘ব্রেকিং ব্যাড’ সিরিজ আর ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার বদৌলতে এই নাম এখন আগের থেকে অনেক বেশি শোনা যায়। আমেরিকার অন্য সব রাজ্যের মতো এই রাজ্যেরও একটা স্লোগান আছে—ল্যান্ড অব এনচ্যান্টমেন্ট যাকে ‘মোহিত করা রাজ্য’ বললেও ভুল হবে না। আগে আসা হয়নি, তাই উত্তেজনা কাজ করছিল।
নর্থ ক্যারোলাইনার শান্ত, স্নিগ্ধ, সবুজে ভরা রোলি শহর থেকে যাত্রা শুরু করে শিকাগোয় ঘণ্টাখানেকের বিরতি দিয়ে আলবুকার্কি ইন্টারন্যাশনাল সানপোর্টে অবতরণ করল বিমান। না, ঠিকই পড়েছেন; এই এয়ারপোর্টকে আদর করে এরা ডাকে সানপোর্ট। আলবুকার্কিতে সারা বছর প্রচুর রোদ থাকে। বিমানবন্দরটির নাম সেই রোদেলা আবহকেই ধারণ করে আছে। দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার উষ্ণতা আর উন্মুক্ততাকেও মনে করিয়ে দেয় এই নাম। এই দুই অনুভূতির কোনোটাই অবশ্য তখনো আমার হয়নি। জানালার পাশের সিট না হওয়ায় দিগন্তের ব্যাপ্তি বা বিস্তার কোনোটাই বুঝতে পারলাম না। সেটাও ভালো। কী আছে নিচে নেমে একবারে দেখাই ভালো।
আমাকে নিতে এসেছে আমার বড় বোন আর তার সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছেলে ওমর। যান্ত্রিক সিঁড়ির মাঝামাঝি থাকতেই তাদের দেখা গেল। উচ্ছ্বসিত হয়ে আলিঙ্গন। অনেক দিন পর তা-ও আবার এত দূরে দেখা! শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে লু হাওয়ার দমকায় থমকাতে হলো। এই এয়ারপোর্টে অনেক অনেক যাত্রী চলাচল করে না। তাই সবকিছু একটু বেশিই ফাঁকা ফাঁকা। এতে দমকা হাওয়াটাকে আরও জোরালো মনে হলো, সঙ্গে গরমের তেজও। নাম কেন সানপোর্ট, এবার একটু করে হলেও ধরতে পারলাম। বাতাস তো নয়, যেন কামারের হাপরের হাঁপ। ফস ফস করে গায়ে এসে লাগছে।
গাড়িতে লটবহর তুলে বের হয়ে পুরোটা বুঝতে পারা গেল। এ তো রীতিমতো বিভীষিকা! খোলা জানালা দিয়ে তাপপ্রবাহ এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বোন আর ওমর দিব্যি আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। রাস্তার অন্য গাড়িগুলোর অনেকেরই জানালা খোলা। বাতাসটা নাকি ভালো। অনেক গাড়ির জানালা তোলা। তাদের হয়তো আমার দশা। এ আবহাওয়ায় প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে আশপাশ দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এ–ও আমেরিকা? একেবারে আলাদা। মনে হয় বাড়িগুলো সব মাটি দিয়ে গড়া। বেশির ভাগ একতলা, নিচু। দোকানপাট যা দেখলাম, প্রায় সবই একতলা। দু-একটা, কদাচিৎ উঁচু বিল্ডিং, তা-ও ছয়তলার বেশি হবে না। হাতে গোনা যাবে। বাকি সব একতলা বা বেশি হলে দোতলা আর মেটে রং। এতে করে উষ্ণতার তীব্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে রুক্ষতার মাত্রা। মোহিত করা এই রাজ্যকে স্নায়বিক আর মানসিক দুইভাবেই অনুভব করা যাচ্ছে। তবে সবার দশা যে আমার মতো না, তা মূল সড়কের পাশের হাঁটা কিংবা দৌড়ানোর জন্য যে লেনগুলো আছে, তাতে এই ভরদুপুরেও কাউকে দৌড়াতে, কুকুর নিয়ে, বাচ্চাদের স্ট্রলার নিয়ে হাঁটতে দেখলাম। তবে কি এটাই স্বাভাবিক?
আলবুকার্কি থেকে লস আলামোস
কদিনের বিরতি দিয়ে বোনের পরিবারের সঙ্গে লস আলামোসের উদ্দেশে যাত্রা করা গেল। একেবারেই কাছে। ঘণ্টা দুয়েকের ড্রাইভ। নিউ মেক্সিকোতে দুই ঘণ্টার দূরত্ব কাছের দূরত্ব বলেই মনে হলো। এত ফাঁকা কোনো শহর আগে দেখা হয়নি। এত বিরান, ছাড়া ছাড়া আর দিগন্ত ফোঁড়া রাস্তাগুলো অমানবিক রকম বৈচিত্র্যহীন মনে হলেও তার মধ্যে মাধুর্য আছে। কোথাও কেউ নেইর মতো একটা ব্যাপার। বড় কোনো গাছ নেই। সুউচ্চ কাচঘেরা দালান নেই। শুধু নেই আর নেই।
লস আলামোসের দিকে যাওয়া শুরু করে অবশ্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাপমাত্রা কমতে শুরু করল। রওনা দেওয়ার আগে আমার বোন পই পই করে বলে দিয়েছিল যেন জ্যাকেট আর গরম কাপড় নিয়ে নেই। প্রথমে মনে হয়েছিল ঠাট্টা। ভেবেছিলাম সপরিবার আমাকে হয়তো বোকা বানাতে চাচ্ছে। কিন্তু না। সান্তা-ফে দিয়ে না গিয়ে আমরা খানিকটা ঘুরে পাহাড়ি সিনিক রোড ধরেছি। যে কারণে উচ্চতা বাড়বে আর তাতে করে তাপমাত্রা কমে যাবে। এখানে বলে রাখা ভালো আলবুকার্কি সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৫ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। আর এই উচ্চতার তারতম্য আমার শরীর ঠিকই ধরতে পারল। পাহাড়ি পথে যত এগিয়ে যাওয়া হয়েছে, এই উচ্চতা আরও বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি। আমি তো খুশি। গাড়ির জানালা একটু ফাঁক রেখে বৃষ্টিটা উপভোগ করা যাচ্ছে। তবে ঠান্ডাও বেশ। বেশ মানে বেশ। আমাদের শীতের থেকে অনেক অনেক ঠান্ডা। একটা সময় বৃষ্টির বদলে হালকা তুষারপাত শুরু হলো। পেঁজা তুলার মতো মিহি, হালকা, আবছায়া হয়ে গলে পড়ছে চারপাশে। এদিকে প্রচুর গাছ। সরু সর্পিল রাস্তা। মাঝেমধ্যে নদীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে বলেও মনে হলো। ভুলও হতে পারে। খুব কম গাড়ি। একটা–দুটো। মাঝেমধ্যে। রাস্তার কারণেই কারও বাড়াবাড়ি নেই। সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীরলয়ে উপভোগ করছে সবকিছু। এও কি মোহিত করা রাজ্যের আরেক রূপ?
চলতে চলতে তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেল। তবে গুমোট ভাবটা রয়েই গেল। লস আলামোসের সড়কচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আরও কিছুটা বাকি। পথ এখানে একটাই। এটা ধরে এগিয়ে গেলেই লস আলামোস। এটা পাজারিতো প্লাটুতে অবস্থিত। যে কারণে দূর আর উঁচু থেকে দেখতে একে দারুণ লাগে। চারদিকটা উঁচু, মাঝে প্রায় সমতল একটা জায়গা। এই পাজারিতো প্লাটু ট্রেকিংয়ের জন্য বেশ জনপ্রিয়। বেশ কিছু ট্রেকিং রুট আছে। শীতকালে স্কি করার বন্দোবস্তও আছে। আছে ব্যান্ডলিয়ার জাতীয় উদ্যান আর ভালেস জাতীয় সংরক্ষণাগার। আমরাও থেমেছিলাম নিছক ছবি তোলার জন্য। আমাদের গন্তব্য লস আলামোস, বিশেষত ওপেনহাইমার সাহেবের বাড়ি দেখা।
লস আলামোস
সেনাবাহিনীর চৌকিতে পরিচয়পত্র দেখাতে হলো। তারা এও বলে দিলেন কোথাও যেন ছবি তোলা না হয়। সেনাবাহিনীর চৌকি পার হওয়ার অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। পুলিশের চৌকি আর এর মধ্যে পার্থক্য হলো—গা ছমছমে ভাব।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং সর্বোত্তম বিজ্ঞানপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি লস আলামোসের এই গবেষণাকেন্দ্র। ম্যানহাটান প্রকল্পের জন্য লস আলামোসকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। লস আলামোসে পারমাণবিক বোমা এবং হাইড্রোজেন বোমাসহ বিভিন্ন পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন হয়েছিল। বিখ্যাত ম্যানহাটান প্রকল্পের কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং পরমাণু গবেষণা ও উন্নয়নে এর অবদান অপরিসীম। এখানেই প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি হয়েছিল আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা ব্যবহৃত হয়েছিল। এই ম্যানহাটান প্রকল্পেরই বৈজ্ঞানিক পরিচালক ছিলেন রবার্ট ওপেনহেইমার। দূরদর্শী বিজ্ঞানীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন দক্ষ এক প্রশাসক।
যদি ভাবেন লস আলামোসের গুরুত্ব কমে গেছে, তাহলে ভুল করবেন। এই বিজ্ঞানাগার এখনো চালু আছে। গবেষকেরা সৌর এবং পরমাণু শক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাবৎ আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার বলে এখানে পুলিশি চৌকির বদলে সেনাচৌকি বিদ্যমান। এটা আমার ধারণামাত্র। সত্য–মিথ্যা জানি না।
ওপেনহাইমারের বাড়ি
গুগল ম্যাপ অনুসরণ করে অবশেষে ওপেনহাইমারের বাড়ির সামনে পৌঁছানো গেল। কাঠের একতলা বাড়ি। এতটা অনাড়ম্বর হবে ভাবিনি। ক্রিমসন রেড বা গাঢ় রক্তাভ রং কালের ধুলায় মলিন। বিশাল গাছগুলোয় সময় আটকে গেছে। শুরুর দিকে গাছগুলো যে এই রং ছিল না, তা ঢের ধরতে পারা যায়। কিন্তু কোথাও লেখা নেই যে এটাই ওপেনহাইমারের বাড়ি বা এখানেই ওপেনহাইমার সাহেব থাকতেন। গুগলে জানতে চাওয়া হলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে গাছের আড়ালের বাড়িটাকে ঠিক দেখার যোগ্য মনে বলে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। দেখা বলতে কেবল বাইরে থেকেই দেখা। ভেতরে প্রবেশের কোনো উপায় নেই। বাড়ির একপাশে সবুজ ঘাসে মোড়া একচিলতে জায়গা। তাতেই গাছগুলো। বেশ আগলে রাখার মতো। কিন্তু কোথাও কোনো নামফলক পেলাম না। সন্দিহান হয়ে এদিক-ওদিক করে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো। তাঁরাও এটাই দেখিয়ে দিলেন। তার মানে আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আশাহত হলাম বৈকি। ভেবেছিলাম কত কিছু দেখব। হলো কই।
অগত্যা ইন্টারনেট ঘেঁটে বুঝতে পারলাম নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে ওপেনহাইমার সাহেব ঠিক কোথায় থাকতেন, কী ধরনের কাজ করতেন, এসব গোপন রাখা হতো। সে জন্য তাঁর বাড়িটাকে একদমই সাধারণ অন্য বাড়িগুলোর মতো করেই করা এবং রাখা হয়েছিল। আর কখনোই বা এখনো বলা হয় না যে এটাই তাঁর বাড়ি। এই রহস্য বহাল তবিয়তে আছে। আছে কিন্তু আবার এইটাই যে আসলে তাঁর বাড়ি, সেটাও বলা হচ্ছে না।
লস আলামোস নিজেই একটা শহর। যে শহরে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর ঘনত্ব পৃথিবীর যেকোনো জায়গার থেকে নাকি বেশি। এখানে বাংলাদেশিরাও কাজ করেন। জাদুঘর থেকে বের হওয়ার সময় তেমনই এক বাংলাদেশি পরিবারের সঙ্গে দেখা। অনেক দিন ধরে এখানে আছেন। আমার বোনের পরিবারের পূর্বপরিচিত। কাকতালীয়ভাবে দেখা হলো। দেখা যেহেতু হলোই তাই তাঁর কাছ থেকে ঝালিয়ে নেওয়া হলো যে ওপেনহাইমার সাহেবের বাড়ি সম্পর্কে ইন্টারনেট যা বলছে, তা সত্যি কি না। তিনি সরাসরি কোনো উত্তরে গেলেন না।
‘হাইলি ক্লাসিফায়েড,’ বলে হেসে দিলেন।