তাঁর সংগ্রহে আছে দেড় হাজারের বেশি ভ্রমণবিষয়ক বই
সাইকেলে ঘুরেছেন বহু দেশ। তাঁর পেশাও ঘোরাঘুরিসংশ্লিষ্ট—ট্যুর অপারেটিং। আর নেশা? ভ্রমণের বই সংগ্রহ। তাঁর সংগ্রহে আছে দেড় হাজারের বেশি ভ্রমণবিষয়ক বই। সজীব মিয়াকে বই সংগ্রহের গল্প শোনালেন আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল
মা–বাবাকে বই পড়তে দেখে দেখে বড় হয়েছি। একসময় তাঁদের অভ্যাসটাই আমার মধ্যে জেঁকে বসে। স্কুলে পড়ার সময় বাবা নানা ধরনের বই উপহার দিতেন। ক্লাস সেভেনে যখন, তখন একদিন সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে দিলেন। আমার কাছে অবশ্য এই বই বিশেষ আগ্রহ তৈরি করল না। কারণ, তখন আমি রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’সহ বিভিন্ন লেখকের ‘দস্যু সিরিজ’–এর বইয়ে ডুবে আছি। তারপর ‘বেতাল বাহাদুর’, ‘ম্যানড্রেক’, ‘নন্টে ফন্টে’, ‘বাটুল দি গ্রেট’, ‘টিনটিন’, ‘টারজান’সহ নানা কমিকস বইয়ে বুঁদ হলাম। আর ভ্রমণের বইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ হলো কলেজে পড়ার সময়।
১৯৮৭ কি ১৯৮৮ সাল। আমি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। কাছেই বাংলাবাজার। আমার কলেজের সামনে ফুটপাতেও পুরোনো বই বিক্রি হতো। সেসব সংগ্রহ করতাম। ব্যক্তিগত সংগ্রহটা এভাবে গড়ে উঠতে থাকে। বাসায় যখন বইয়ের সংগ্রহ বেড়ে গেল, মনে হলো, একটা বুকশেলফ দরকার। কিন্তু বুকশেলফ কেনার মতো টাকা আমার নেই। বাসার সবার কাছে চাঁদা ধার্য করলাম। সেই চাঁদার টাকায় একটি বুকশেলফ কিনে ফেললাম।
পরে তেজগাঁও কলেজে পড়ার সময়ে ‘যুব পর্যটক ক্লাব বাংলাদেশ’–এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। ক্লাবটি চক্ষু মেলিয়া নামের একটি মুখপত্র প্রকাশ করে। ক্লাব আর ম্যাগাজিনের কাজের জন্য ভ্রমণপিপাসু নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে। তাঁদের কাছ থেকে দেশ–বিদেশের ভ্রমণের গল্প শুনি। বিদেশের গল্প শুনে সেসব দেশে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়, তাই সেসব দেশের ভ্রমণকাহিনি পড়ে মানসভ্রমণে বের হতাম! এভাবেই ভ্রমণের বই পড়া ও সংগ্রহ এগিয়ে চলে।
স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনার লিয়াকত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল। তাঁর কল্যাণে আবার সৈয়দ মুজতবা আলী পড়া শুরু করি। এ ছাড়া আবুল ফজল, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, ঊর্মি রহমানের লেখা ভ্রমণকাহিনি তখন নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় পড়তাম।
এসব করতে করতেই সাইক্লিংয়ে যুক্ত হই। ১৯৯৪ সালে ইয়াং ট্যুরিস্ট ক্লাবের (ওয়াইটিসি) পক্ষ থেকে হংকং, ম্যাকাও, চীন ভ্রমণ করি। হংকংয়ে ভ্রমণের সময় বিখ্যাত জার্মান সাইক্লিস্ট হেইঞ্জ স্ট্রাকের একটি তথ্যবহুল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করি। জানতে পারি, তিনি পৃথিবীর একমাত্র সাইক্লিস্ট, যিনি টানা ৫০ বছর সাইকেল চালিয়েছেন।
১৯৯৬ সালের কথা। কলকাতায় ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের ওপর ১২ বছর গবেষণা করে শ্যামসুন্দর বসু লেখেন রামনাথের পৃথিবী। তিনি সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন। সেটা সংগ্রহ করি। এরপর বিমল মুখার্জীর দুচাকায় দুনিয়া ও বিমল দের সুদূরের পিয়াসীও সংগ্রহ করি। এসব বই ছাড়াও ভ্রমণবিষয়ক যত রকম ম্যাগাজিন পেতাম, তার প্রায় সব কটিই সংগ্রহ করতাম। নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানও ছিল আমার সংগ্রহের বড় একটা উৎস। অনেক বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীও ভ্রমণবিষয়ক বই দান করেছেন।
সাইকেলে বিশ্বভ্রমণকারী প্রত্যেকের বই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁদের অনুপ্রেরণায় ১৯৯৭ সালে ১০ মাসে ১৯টি দেশ ভ্রমণ করি। এরপর ২০১২ সালে মুনতাসির মামুনের সঙ্গে ৬৭ দিনে আমেরিকার ১১টি রাজ্য ট্যানডেম বাইসাইকেলে ভ্রমণ অন্যতম স্মৃতিবহুল ঘটনা। সর্বশেষ ২০২২ সালে আফ্রিকার রুয়ান্ডায় সাইকেল চালিয়েছি।
ভ্রমণ করতে করতে এটাই এখন আমার ধ্যানজ্ঞান, নেশা-পেশা। জীবিকার প্রয়োজনে ট্যুর অপারেটর হিসেবে কাজ করছি। ডেলটা আউটডোরস আমার কোম্পানি। বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের আমি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে কাজ করছি। এই সংগঠন থেকে প্রকাশ করেছি ভ্রমণবিষয়ক প্রকাশনা, বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় আয়োজন করছি বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
এসব কাজের মাধ্যমেই ভ্রমণবিষয়ক বই সংগ্রহ ও পড়ার কাজটিও করে গেছি। বর্তমানে আমার সংগ্রহে বাংলাদেশি ভ্রমণলেখকদের এক হাজারের বেশি বই আছে। দেশের ভ্রমণলেখক ছাড়াও ভারতীয় বাংলাভাষী লেখকদের ৩০০ থেকে ৪০০ ভ্রমণবিষয়ক বই আছে। এর বাইরে অন্যান্য দেশের ভ্রমণবিষয়ক বই, ভ্রমণ গাইড ও ম্যাগাজিন সংগ্রহ করেছি।
আর এভাবেই বাংলা ভাষায় সর্বাধিক ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের সংগ্রহশালা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। বাংলায় প্রকাশিত ভ্রমণবিষয়ক সব বইয়ের একটি তালিকা করার ইচ্ছা আমার আছে। কাজটি শুরুও করেছি। কষ্টসাধ্য হলেও আনন্দের সঙ্গেই আমি লেগে আছি।