গাড়িরও যে বডি আছে, মনেই থাকে না

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন নবম পর্ব।

সিগিরিয়ার বাংলা প্রতিশব্দ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় সিংহের মতো দেখতে পাথর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কেকিরাওয়া-ডাম্বুলা (২৪.৬০ কিলোমিটার)

দুলহাজের সূত্র ধরে আমার ব্যাচমেট পুনসিসির সঙ্গে কথা হলো রাতে। শ্রীলঙ্কায় আসার আগে থেকেই ওকে সোশ্যাল সাইটে খুঁজছিলাম। এমডি পরীক্ষায় মনঃসংযোগের জন্য ও সোশ্যাল সাইটে নেই। পুনসিসি মেডিকেলে থাকাকালে অসাধারণ ব্যাডমিন্টন খেলত। অবশ্য আমার শ্রীলঙ্কান ব্যাচমেটদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব ছিল তুষিত বান্দারার সঙ্গে। ও এখন যুক্তরাজ্যে থাকে। ওর মতো এত শান্ত, ভদ্র ছেলে এ যুগে বিরল। ডাম্বুলায় কাজ করা আরও একজন শ্রীলঙ্কান ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা হলো রাতে। ইউএসটিসি মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্র রামালান এখন কাজ করে ডাম্বুলাতেই। রাতের খাবারের দাওয়াত দেওয়ার জন্যই ফোন করেছিল অবশ্য। জানালাম, আমাদের অবস্থান ডাম্বুলা থেকে ২৩ কিলোমিটার পেছনে।
জুমন ভাইয়ের জন্মদিন কাল। ভাইকে আগাম শুভেচ্ছা জানাব ঠিক করে রেখেছিলাম। উনিও আমার মতো তুলা রাশির। গত রাতের খাবারের পর ছোট্ট একটা কাপকেক কিনেছিলাম। রাতে আমার স্বল্পাহারের ব্যাপারে জানে বলে জুমন ভাই খানিকটা ভ্রুকুটি করলেন। আমি আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আজ হঠাৎ কেক খেতে ইচ্ছা করছে।’

জুমন ভাই বয়সে আমার বড়। অবশ্য সহপাঠী না হলেও আমরা সমপাঠী। জুমন ভাইয়েরও বেশ বই পড়ার অভ্যাস। নন-ফিকশনেই আগ্রহ বেশি। বার্ট্রান্ড রাসেল আর মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভক্ত। রাতে ব্রাশ করার আগে তাঁকে চমকে দিয়েই বললাম, ‘শুভ জন্মদিন ভাই। চলেন কেক কাটি!’ জুমন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘তাই তো বলি, তুই ব্যাটা চায়ে চিনি খাস না। সে আবার কেনে কেক!’ কেকের সঙ্গে আইসক্রিমের কাঠি চেয়ে এনেছিলাম। সেটা দিয়েই কাটাকাটি হলো! অবশ্য মোম কেনা হয়নি। মোম পেলে বয়সের সমান মোমবাতি জ্বালাতে গেলে কেকিরাওয়া নামক এই শহরের ছোট্ট গেস্টহাউসে অগ্নিকাণ্ড হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী ছিল!
সকালে পথে নামতেই আবিষ্কার করলাম, দৈর্ঘ্যে কেকিরাওয়া বিশাল শহর। দিগন্তে রাস্তার শেষ মাথায় সবুজ পাহাড় দেখা যায়। এই অঞ্চলে প্রচুর মুসলিম। মূলত শ্রীলঙ্কান মুর মুসলিম। দোকানের সাইনবোর্ড দেখলেই ব্যাপারটা বেশ আঁচ করা যায়। শহরের শেষে ফসলি খেত। এক জায়গায় লেখা—Otters ahead, drive carefully। প্রাকৃতিক পরিবেশে ভোঁদড় দেখার লোভে এবার রাস্তার চেয়ে পথের ধারে চোখ রাখছি বেশি।

সাইনবোর্ড বলে দিচ্ছে, সামনে ভোঁদড়!
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অবশ্য ভোঁদড়ের দেখা না মিললেও আছে শাখামৃগদের দৌরাত্ম্য। এদের থেকে বাঁচতেই এদিকের সব দোকান খাঁচাবদ্ধ। পথিমধ্যে সুরিয়াগামা জংশন। বাড়িগুলোর দেয়াল উপচে পড়ছে চন্দ্রপ্রভা। কিছুটা এগিয়ে কাইলাপাথানা। এখান থেকে রাস্তা খানিক উঁচু–নিচু। ইহালাগামাতে প্রকাণ্ড সব নিমগাছ। আর পথের বাঁয়ে পাথুরে পাহাড়। আর রাস্তার পাশে অনেকগুলো খ্রিষ্টান গোরস্তান।
কিছুদূর এগিয়ে মাদাতুগামা নামে ছোট্ট জনপদ। ছোট্ট জনপদের শেষে বিশাল পোস্ট অফিস। শ্রীলঙ্কায় লোকে পোস্ট অফিসের ওপর বেশ নির্ভরশীল। সব সময় এখানে ভিড় লেগেই আছে। মাদাতুগামা পেরিয়ে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের খালাদের দোকান। সবে ঝাঁপ খুলেছে। দোকানের গৃহদেবতাই এখনো পুজোর নৈবেদ্য পায়নি। এত তাড়াতাড়ি খাবার মিলবে না। অগত্যা সামনের দিকে পা চালাতে হলো। ছোট্ট একটা দোকানে ভাত আর তরকারি ছাড়া কিছু নেই। সকালের নাশতা হিসেবে সেটাই উদরস্থ করলাম।
কিথুলহিথিইয়াওয়া থেকে রাস্তার ধারে প্রচুর শজনেগাছ। আর মাঝেমধ্যেই বডিওয়াশের বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপন দেখলেই আমরা ধন্দে পড়ে যাই। নিজেদের বডির কথাই মনে আসে প্রথমে। গাড়িরও যে বডি আছে, সেটা মনেই থাকে না।

বিজ্ঞাপন দেখে ধন্দে পড়ে যাই
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ এক মাতাজির দেখা পেলাম। মাহিন্দ্রা বলেরো গাড়ির পেছনে এক দেবীকে অধিষ্ঠিত করেছেন আর পথচলতি লোকেদের মাথায় হাত রেখে কৃপা বিলোচ্ছেন। বুলাগামা নামক জনপদে পা রেখে প্রবেশ করলাম নতুন একটা রাজ্যে। দেশের একেবারে মাঝবরবার সেন্ট্রাল প্রভিন্সে।
মিরিসগোনিইয়াওয়া থেকে এগোলে ডাম্বুলা শহরের সীমানা শুরু। শহরের নানা দ্রষ্টব্য চোখে পড়ছে। আর সঙ্গে অনেক মানুষ। ২০ মিনিট শহরে হেঁটেই হাঁপিয়ে গেলাম। এত দিন প্রকৃতির মধ্যে হাঁটায় শহর আর ভালো লাগছে না। প্রকৃতি কম, মানুষ বেশি—এমন জায়গা আমাদের পছন্দ নয়।

আরও পড়ুন

ক্লক টাওয়ার থেমে বাঁয়ের ছোট রাস্তাটা স্বস্তি এনে দিল। লোকজনের ভিড় একেবারেই পাতলা এই রাস্তায়। অবশ্য পথে পড়ল ডাম্বুলা জেলার কাঁচা সবজির আড়ত। জায়গাটাকে ডাম্বুলার রিয়াজউদ্দীন বাজার হিসেবে বিবেচনা করা যেতেই পারে! ট্রাক-লরি আর শ্রমিকদের হাঁকডাকে সরগরম। ভিড় এড়াতে গিয়ে আরও ভিড়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। টকের ভয়ে গ্রাম ছাড়লাম, এখন তেঁতুলতলাতেই বাড়ি বানানোর দশা আমাদের!

ডাম্বুলা শহর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে


আরও কিছুটা এগিয়ে কান্দালামা রোড ধরলাম। গোল্ডেন স্টারস হোটেলের রুম দেখে পিলে চমকে গেল। এ নিশ্চয়ই আমাদের বাজেটে কুলোবে না। তা-ও বলে দেখতেই রিসেপশনের ভদ্রমহিলা খানিকটা দোনোমনা করে রাজি হয়ে গেলেন। অফ সিজন বলেই খুব সম্ভবত। জুমন ভাইকে গেস্টহাউসে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। আমার গন্তব্য সিগিরিয়া। জুমন ভাই বছর দশেক আগে শ্রীলঙ্কায় এসে সিগিরিয়া ঘুরে গিয়েছিলেন। আবার যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। আজকের দিনের মতো এখানেই হাঁটা শেষ।
ব্যাকপ্যাক রেখে আমি উল্টো দিকের বাসস্ট্যান্ড পানে এগোলাম। সিগিরিয়ার অবস্থান আমাদের যাত্রাপথের বিপরীত দিকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার। বলা হয়ে থাকে, শ্রীলঙ্কায় এসে যদি কেউ একটা জায়গা দেখবে বলে মনস্থির করে, তবে সেই জায়গাটা অবশ্যই সিগিরিয়া হওয়া উচিত। অনেকে একে বলেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য! সিগিরিয়ার বাংলা প্রতিশব্দ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় সিংহের মতো দেখতে পাথর। প্রাচীন নগর-পরিকল্পনার সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন হিসেবে এটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে মাতালে জেলায়। এর নির্মাতা রাজা কশ্যপ। যদিও অনেকে বলেন, এর আগেও এখানে বসতি ছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মঠ হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর রাজা কশ্যপ পঞ্চম শতাব্দীতে অনুরাধাপুরা থেকে সরিয়ে এখানেই নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। নিজের পিতা ধাতুসেনাকে সরিয়ে এবং সিংহাসনের মূল দাবিদার সৎভাই মোজ্ঞাল্লানাকে বঞ্চিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনি। কশ্যপ ছিলেন ধাতুসেনার দাসির ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তান। অন্যদিকে রাজা ধাতুসেনার স্বীকৃত রানির সন্তান ছিলেন মোজ্ঞাল্লানা। নিজের পিতাকে জীবন্ত অবস্থায় চারপাশে প্রাচীরবেষ্টিত করে হত্যা করেন কশ্যপ। অনেকটাই মোগল সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের সেই স্নায়ু টান টান সম্পর্ক। এখানে দারা শিকোর ভূমিকায় আছেন মোজ্ঞাল্লানা। সৎভাই কশ্যপের জন্য প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান মোজ্ঞাল্লানা। তবে যাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করেন, ফিরে এসে সিংহাসন দখল করবেন। দারা শিকোর মতো ভাইয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়নি মোজ্ঞাল্লানাকে। উল্টো ভাইকে হটিয়ে নিজের প্রাপ্য ময়ূর সিংহাসন বুঝে নেন মোজ্ঞাল্লানা।
কশ্যপ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় চড়ে বসেছিলেন হাতিতে। হাতি কৌশলগত কারণে দিক পরিবর্তন করলে পেছনের সৈন্যরা ধরে নেন, সামনে শত্রুপক্ষের বিশাল বাহিনী আসছে। তাঁরা রাজাকে ওখানেই ফেলে রেখে পালিয়ে যান। নিজের সৈন্যদলকে পশ্চাদপসরণ করতে দেখে কশ্যপ ওখানেই নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অবশ্য দুলহাজ গতকাল ভিন্ন একটা ঘটনা বলেছিল। স্কুলে ওর এক শিক্ষকের কাছে শোনা ঘটনাটা। যুদ্ধযাত্রার সময় রাজা কশ্যপের হাতির সামনে বিশাল এক সাপ পড়েছিল। তাই দেখে হাতি উল্টো পথে ফিরলে বিদায়ঘণ্টা বাজে কশ্যপের শাসনের। অবশ্য মিথের সঙ্গে মিথ্যার খানিকটা সম্পর্ক থাকতেই পারে!
সিগিরিয়া কমপ্লেক্সের চারপাশে পরিখা খনন করা আছে। টিকিট কেটে মূল প্রাঙ্গণে ঢুকতেই প্রথমে ওয়াটার গার্ডেন। আর ওপরে তাকালেই সেই অতিকায় লায়ন রক। প্রায় দুই হাজার বছরের কালের আঁচড় সামলে সটান দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে চূড়ার ওপরের গাছগুলোও চোখে পড়ে। মিরর গার্ডেনের লালচে দেয়ালও নিচ থেকে চোখ এড়ায় না। হাতের বাঁয়ে অষ্টভুজাকৃতি পুকুর। বোধিঘর, ইমেজ হাউস আর স্তূপ দেখে পা রাখলাম বোল্ডার গার্ডেনে। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ডিমের আকারের একেকটা বোল্ডার। এখানে একটা শানবাঁধানো পথের ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা—To the summit! এবার টানা সিঁড়ি ভাঙার পালা। মাঝপথে লায়ন স্টেয়ারকেস। সিংহের পায়ের নখরসদৃশ এই দ্বার কাজ করত মধ্যবর্তী ফটক হিসেবে। কী নিখুঁত কাজ! এত বছর পরও এর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখে অবাক হতে হয়।

সিংহের পায়ের নখরসদৃশ এই দ্বার কাজ করত মধ্যবর্তী ফটক হিসেবে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এরপর আরও অনেকগুলো সিঁড়ির সোপান। ওপরে উঠে বাঁয়ে গিয়েই পেলাম রাজা কশ্যপের সিংহাসন। একদমই সাদামাটা! সামনেই এত উঁচুতেও বিশাল এক জলাধার। এককালে এই প্রাসাদের লোকেদের পানি জোগান দিলেও আজকাল সিগিরিয়ার বানরেরা পানি খায় মূলত এখানে। এখান থেকে দূরের পাহাড়সারির দারুণ দৃশ্য দেখা যায়। এরপর আছে প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সাউথ প্যালেস, ওয়েস্টার্ন প্যালেস ইত্যাদি। এত ওপরেও কুকুর উঠে পড়েছে। পিডুরাংগুলা রক খুব ভালো দেখা যায় সিগিরিয়া টপ থেকে।

বিশাল পাথরের মাঝখানে আশ্চর্য এক জলাশয়
ছবি: সংগৃহীত


‘ড্রোনাচার্যরা’ বোলতার মতো আওয়াজ তুলে ড্রোন উড়িয়ে দিয়েছে। অথচ সবখানেই সাবধানবাণী লেখা আছে—Be silent! Wasps! ঘণ্টাখানেক চূড়ায় ঘুরে নামার সিঁড়ি ধরলাম। যাত্রাপথে মিরর হাউস হয়ে কেভ পেইন্টিংয়ের গুহায়। ধারণা করা হয়, সিগিরিয়া নামক পুরো পাথরটাই একটা অতিকায় চিত্রশালা ছিল একসময়। ১৯৬৭ সালে কে বা কারা একবার এখানে ভাঙচুর করে অনেকগুলো চিত্রকর্ম নষ্ট করে দিয়েছিল। সেটার ছাপ এখনো রয়ে গেছে গুহার নানা চিত্রে। সিস্টার্ন রক দেখলাম নিচে নেমে। একটা বিশাল পাথরের মাঝখানে আশ্চর্য এক জলাশয়। জায়গাটা মুখপোড়া হনুমানদের অভয়ারণ্য। অডিয়েন্স হল, আসমা কেভ আর কোবরা হুড কেভ দেখে মূল রাস্তায়। এখান থেকে আবার লোকাল বাসে সন্ধ্যা নাগাদ ডাম্বুলা।