মিনিট বিশেকের মধ্যেই দানবীয় রূপ নিয়ে ফুঁসতে থাকল নদীটি
শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন ত্রয়োদশ পর্ব।
ত্রয়োদশ দিন: থালডেনা থেকে এল্লা। দূরত্ব: ৩৪ দশমিক ১৯ কিলোমিটার।
গেস্টহাউসটার ঠিক নিচেই বাদুলু ওয়া নদীর স্রোতকে কৃত্রিমভাবে আটকে ফেলা হয়েছে। বিশাল গর্জন তুলে পাথরের বিছানায় ঝাঁপ দিয়েছে নিয়ন্ত্রিত জলরাশি। ঠিক এখানেই বাদুলু ওয়া নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি ছোট জলধারা। ছোট জলধারার রং গাঢ় সবুজ আর বাদুলু ওয়ার মূল স্রোতটা উজান থেকে বয়ে আনা পলির কারণে ঘোলা। সন্ধ্যায় এখানে পৌঁছানোয় জায়গাটার নিসর্গ শোভা উপভোগের সুযোগ হয়নি। তার ওপর আবার বৃষ্টি ছিল। রাতে শুধু টানা গর্জনটুকুই শোনা হয়েছে। সকালে দুচোখ ভরে দেখার সুযোগ হলো। গেস্টহাউস থেকে বেরোতেই মালিক পাকড়াও করে প্লেইন টি কিংবা রং–চায়ের আমন্ত্রণ দিলেন। এই সকাল সকাল চায়ের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার মতো বেরসিক আমরা নই। দাঁতভাঙা সিংহলা, ভাঙা ইংরেজি আর ইশারা-ইঙ্গিতে কথোপকথন চলতে থাকল।
হাঁটা শুরু করতেই প্রথমে পড়ল বলিয়েদ্দা। এখান থেকে এগিয়ে কিশোর সংশোধন কেন্দ্র। এই সকালেই ফটকের চারপাশ ঝাঁট দিতে ব্যস্ত কয়েকজন কিশোর। কোনো এক কারণে এখানকার বুদ্ধমূর্তিটি সাদা কাপড়ে ঢাকা। এক জায়গায় ভূমিধসে রাস্তায় গাছ পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, একটু আগেই পাহাড়ের বাঁধন আলগা করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে এক্সকাভেটর চলে এল। পাহাড়ের মোচড়ের পর মোচড় পেরোচ্ছি। অনেকগুলো বাঁকই কানা গলির মতো, ওপাশে কী আছে, দেখা যায় না। পরের জনপদ ছয় মাইল পোস্ট। বাদুলু ওয়া নদীর ধার ঘেঁষে ধাপ চাষ হচ্ছে। নদীর জলকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেচের কাজে।
নাশতা সেরে পথে নামতেই বিশাল এক চড়াই। ঊর্ধ্বমুখী টানা চড়াই, নামার নামগন্ধ নেই। পাহাড়ি রাস্তার নিয়ম মেনেই রাস্তা অসম্ভব প্যাঁচানো। খাদের ধার ঘেঁষেই বানানো হয় পার্বত্য অঞ্চলের রাস্তা। চড়াইয়ে উঠতে গিয়ে দুটো টুকটুকের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। মনুষ্যচালিত পা দুটো ইঞ্জিন পাওয়ারে চলে না বলেই ভরসা। উইলপাওয়ারে ভর করে দিব্যি এগিয়ে যাওয়া যায়!
পথের প্রতিটি বৈদ্যুতিক তারে একাধিক বাদুড় ঝুলছে নিথর। পরের জনপদ রিদিপানা। আরও একটা চড়াই ভেঙে গুরুপুরা জংশন। ডানে মোহনীয় সব সবুজ পাহাড়। হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, এমন পাহাড়ি রাস্তায় এই শারীরিক পরিশ্রমের মূল্য কতটুকু? শুধুই কি স্বপ্নতাড়িতের মতো হেঁটে যাওয়া? নির্মোহ মূল্যায়ন করলে প্রাপ্তির খাতায় খুব বেশি কিছু যোগ হয় না। দিন শেষে হাঁটা সুসম্পন্ন করার আনন্দ অবশ্য ছাপিয়ে যায় মাঝেমধ্যেই উঁকি দেওয়া এসব দ্বন্দ্বকে। শরীরের প্রতিটি স্নায়ু-ধমণিকে উদ্দীপিত করার রসদ এত সহজে আর কোথায়-ই বা পাই? যাত্রাপথে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে যুক্ত হওয়া অপ্রত্যাশিত আনন্দের লোভেই সম্ভবত আজীবন এসব পাগলামি করে যাব।
জুমন ভাই এই চড়াইয়ে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন। আমি তাঁর অপেক্ষায় পা দুটোকে ক্ষণেকের বিশ্রাম দিলাম একটি যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে। জুমন ভাই আসতেই আবার পা চালানো। এগিয়েই পেলাম জয়া মাওয়াথা। পরের জনপদ পোয়াকগোদামুল্লা। এবার পা চালিয়ে সোজা বাদুল্লা। এটি উভা প্রদেশের রাজধানী শহর। ক্লক টাওয়ার থেকে সোজা এগিয়ে গেলে ওল্ড ওয়ালাকাডে বাজার। ব্রিটিশদের আমলে তৈরি বিকিকিনির জায়গা। অনেকের ধারণা, এটি ডাচ আমলে তৈরি। স্থাপত্যের গুণে ছোট্ট একটা বিকিকিনির জায়গাও যে কী সুন্দর হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লাল টালির ছাদের ভবনটির অনেক প্রবেশপথ। ব্রিটিশরা এককালের সিলন থেকে বিদায় নিলেও তাদের প্রচুর কীর্তি এখানে রয়ে গেছে। ইউরোপিয়ান কিছু নাগরিক অবশ্য এত বছর পরও রয়ে গেছেন। তাঁদের বলা হয় ‘বার্গার পিপল’। মূলত ডাচ, পর্তুগিজ আর ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত তাঁরা।
শহর থেকে বেরিয়ে হালি-এলার রাস্তায় পড়তেই আবার চড়াই। ডাম্বুলা থেকে ছেড়ে আসা জাতীয় মহাসড়ক ধরেই আবার চলা। রাস্তার নাম এ-৫। শহরের শেষ মাথায় লুম্বিনী বিদ্যালয়। শাক্য রাজা শুদ্ধোধন আর মায়া দেবীর পুত্র সিদ্ধার্থের জন্মস্থান লুম্বিনীকেও মনে রেখেছে ওরা। কিছু দূর এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে নেমে প্রাচীন এক সেতু। যদিও দেখতে খুব একটা পুরোনো বলে মনে হয় না। নিচে বাদুলু ওয়া বিশাল সব বোল্ডারকে ভিজিয়ে নিজের পথ করে নিচ্ছে। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নামতে হবে বলে জুমন ভাই গেলেন না। ফেরার পর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কত পুরোনো সেতু? তাঁর আফসোস জাগানোর জন্য বললাম, কমসে কম নুহ নবীর আমলের তো হবেই!
পরের মোচড় ঘুরতেই চা-বাগানের দেখা।
বোগাহামদিত্তাতে একসঙ্গে দুটো হিন্দু মন্দির। দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যরীতিতে বানানো দেবালয়গুলো। ধীরে ধীরে এগোচ্ছি হালি-এলার দিকে। হালি-এলা থেকে নতুন মহাসড়ক এ-১৬ ধরে এগোনো। রাস্তার দুই ধারের দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর। বাদুলু ওয়াও সঙ্গে সঙ্গে চলছে। উঁচু পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট্ট সব বাড়ি ক্ষণে ক্ষণেই আনমনা করে দেয়।
পথে পড়ল উদুওয়ারা। আরও আরও চা-বাগান। বনসাই চা-গুল্মের ওপরে ছায়াবৃক্ষের শীতল ছাউনি। এদিকে প্রতি বাঁকে বাদুলু ওয়া নদী আরও মোহনীয়। নদীর প্রতি মোচড়ই হাজির হচ্ছে নতুন কোনো দৃশ্যপট নিয়ে। দৃশ্যপট সাজানোতে ওস্তাদ সূর্যকেও যেন হার মানানোর পণ নিয়েছে এই নদী। পরের বাঁকেই বিশাল এক ভূমিধসের এলাকা। একটু এগিয়ে সেই ভূমিধস প্রতিরোধের দারুণ কার্যকর একটা ব্যবস্থা দেখলাম।
থেকে থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তবে কিছুটা এগোতেই বৃষ্টি থেমে গেল। ভেজা রাস্তা জানান দিচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগেই এখানে ঝুমবৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টির পরের চা–বাগান সব সময় মোহনীয়। কাঁচা সবুজ রঙের বাগান দূর থেকে দেখলে মনে হয় ‘সবুজ হিমবাহ’। এই হিমবাহে অবশ্য তুষারধস হয় না। বড়জোর ভূমিধস হয় মাঝেমধ্যে। কিছুটা এগোতেই আকাশ ফুটো করে বৃষ্টি নামল। মিনিট কয়েক দৌড়ে একটা ইটের ব্লক বানানোর দোকানে মাথা গোঁজার সুযোগ হলো। নির্মাণাধীন দোকানের কপাটবিহীন জানালা দিয়ে নিচের বাদুলু ওয়া নদী দেখা যায়। ফোনের ক্যামেরায় ১০ মিনিট আগে ধারণ করা স্থিরচিত্রের সঙ্গে ১০ মিনিট পরের নদীর স্রোতধারার বিশাল অমিল। শান্ত জলধারার বাদুলু ওয়া নদী মিনিট বিশেকের মধ্যেই দানবীয় রূপ নিয়ে ফুঁসছে। পাহাড়ি নদীর হড়কাবান সব সময় ভয়ানক। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এই নদী কিছুক্ষণ আগেও তর্জন-গর্জনবিহীন নিরীহ এক স্রোতধারা ছিল।
ঘণ্টা দেড়েক ওই ইটের ব্লকের দোকানে আটকে থেকে বৃষ্টি ইলশেগুঁড়ির রূপ নিতেই পায়ে স্যান্ডেল আর গায়ে পঞ্চো চাপিয়ে আবার পথে। উদ্দেশ্য, প্রায় বিকেলবেলায় এসে দুপুরের খাবার সারা। ৫০০ মিটার এগিয়ে দেমোদরায় ছোট্ট একটা দোকানে ডাল-ভাত-মাশরুম-ডিম পাওয়া গেল। দোকানি পরম যত্নে খাবার গরম করে পাতে তুলে দিলেন। খাওয়া শেষে আবার পথে। ইতিমধ্যে থাল্ডেনার গেস্টহাউসের মালিক দুবার ফোন করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে খোঁজ নিয়েছেন আমরা এল্লায় পৌঁছাতে পেরেছি কি না। মানুষের এসব ভালোবাসাই খুব সম্ভবত এমন ভ্রমণের পরম প্রাপ্তি। গন্তব্য এল্লা শহর এখান থেকে সাত কিলোমিটার। মূল সড়ক ছেড়ে দেমোদরার রাস্তা ধরলাম। এটি অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তা হলেও পথ কমবে প্রায় তিন কিলোমিটার। তবে এই রাস্তায় চড়াই বেশি। সেটা অবশ্য গায়ে মাখলাম না আমরা।
ধীরপায়ে চড়াই ভাঙছি। বৃষ্টি অবশ্য কোনো দয়াই দেখাচ্ছে না। একটা উঁচু জায়গায় উঠে এল্লা শহরের সুন্দর দৃশ্য পাওয়া গেল। ওখান থেকে আরেকটা চড়াই ভেঙে মূল সড়কে ওঠা গেল অবশেষে। শহরে ঢুকতেই চা–বাগান। খানিক এগিয়ে পেলাম রেলস্টেশন। অবশ্য আমরা প্রবেশ করেছি উল্টো দিক থেকে। আরেকটু সামনে ‘ওয়েলকাম টু এল্লা’ লেখা সেই গুহাসদৃশ প্রবেশপথ। এখানেই এল্লার মূল ট্যুরিস্ট হাব শুরু। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, লাইভ মিউজিক বার ইত্যাদিতে বোঝাই জায়গাটা। সাদা চামড়ার পর্যটকই বেশি রাস্তায়। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সিগিরিয়ার পরেই পছন্দ এই হিল স্টেশন। জায়গাটায় কাঠমান্ডুর ‘মিনি থামেল’ ভাইব আছে। এল্লা সিটি হোস্টেলে পা রাখতেই বৃষ্টি নামল আরও জাঁকিয়ে। রুমে ঢুকতেই জুমন ভাই হঠাৎ খেয়াল করলেন যে আমার পা লালে লাল! না, এই হিল স্টেশনে এসে কোনো অর্থযোগ ঘটেনি। দেমোদরার সরু পিচের রাস্তার পাশের ঘাসে স্যান্ডেল পায়ে হাঁটার সময় জোঁক কামড়িয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। রাতে খেতে বের হয়ে বুঝলাম এল্লা হিল স্টেশন হলেও অন্য পাহাড়ি শহরের মতো এটি সাততাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে না।