এক রাতের আশ্রয়, আজীবনের মায়া ও নকশালবাড়িতে ঈদ
বাংলাদেশ থেকে হেঁটেই এভারেস্ট জয় করতে চান ইকরামুল হাসান। এ উদ্দেশ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি। বাংলাদেশ, ভারত হয়ে এর মধ্যেই পৌঁছে গেছেন নেপাল। পথে ভারতের নকশালবাড়িতে কেটেছে তাঁর ঈদ। সেই অভিজ্ঞতাই ‘ছুটির দিনে’র পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন বাংলাদেশের এই পর্বতারোহী
অভিযানটার নাম দিয়েছি ‘সি টু সামিট’। এই অভিযান আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। দিয়েছে নির্ঘুম রাত, দুশ্চিন্তা, চোখের জল, ভয় আর অপ্রিয় সব অভিজ্ঞতা। কিন্তু সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা ভুলে যাই, যখন তার রঙিন আঁচলে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রকৃতি, যখন নিঃস্বার্থভাবে আমার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় অচেনা সব মানুষ। তারা আমাকে চেনে না, জানে না; তবু কোথাও যেন এক আত্মিক সংযোগ গড়ে ওঠে।
তেমনই এক মানুষ লিটন সরকার। শিলিগুড়ির পানিট্যাংকিতে আমাদের পরিচয়, যখন হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত আমি রাত্রিযাপনের জন্য একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম। লিটন পাশে দাঁড়াল, হোটেল খুঁজতে সাহায্য করল। কিন্তু সাশ্রয়ী কিছু পাওয়া গেল না। লিটনের বাবা, যিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান, খবর পেয়ে নকশালবাড়ি থেকে ছুটে এলেন। বললেন, ‘বিপদে পড়েছ, তোমাকে এটুকু সাহায্যও যদি না করি, তাহলে মানুষ হলাম কেন? এই গরিবের বাড়িতে থাকতে কি তোমার অসুবিধা হবে?’
তাঁর কথায় থমকে গেলাম। ১৯৬৭ সালে এই নকশালবাড়িতেই হয়েছিল নকশাল আন্দোলন, যা ভারতের অন্যতম বড় কৃষক বিপ্লবের সূচনা করে। কৃষক বিদ্রোহের সেই পুণ্যভূমিতে থাকতে আমার অসুবিধা হবে! বহুদিনের স্বপ্ন ছিল, সেখানে একদিন যাব। যদিও এ যাত্রায় খুব বেশি ঘুরে দেখার সময় নেই, তবু কিছুটা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ তো মিলবে! তাঁদের সঙ্গে চললাম নকশালবাড়ি। পথে এক মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে লিটনের বাবা বললেন, ‘এতটা পথ হেঁটে এসেছ, আগে কিছু খাও।’ জোর করে পাঁচটি মিষ্টি পাতে তুলে দিলেন। মিষ্টি আমি বেশি খেতে পারি না, তবু দুটি খেলাম, এ যে ভালোবাসার দান।
বাড়িতে পৌঁছে অবাক হলাম। লিটনের মা আমাকে এমন মমতায় আপন করে নিলেন যে মনে হলো, জন্ম থেকেই আমি তাঁদের ঘরের সন্তান। আমাকে ঘিরে তাঁদের কত ব্যস্ততা! স্নানের জল গরম করে দেবেন কি না, গায়ে শর্ষের তেল মাখব কি না, আমি কী খেতে চাই—সবকিছু নিয়ে যেন মাতৃস্নেহের এক উৎসব লেগে গেল।
কুয়ার শীতল জলে গা ভিজতেই শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে গেল। নিঃসঙ্গ পথের ধুলো, সারা দিনের ক্লান্তি আর গরমের অবসাদ একনিমেষে মিলিয়ে গেল। এই জলে স্নান শুধু শরীরকে সতেজ করল না, মনকেও এক অদ্ভুত স্বস্তিতে ভরিয়ে দিল।
স্নান শেষে ফিরে দেখি চা, পিঠা, শিঙাড়া ও মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছেন মা। ‘আরেকটু দিই? আরেকটু দিই?’ কত যে আদর! রাতের খাবারেও একই দৃশ্য। এত আয়োজনের পরও তাঁর দুঃখ, হঠাৎ করে চলে আসায় ভালো কিছু করে খাওয়াতে পারলেন না!
পরদিন ঈদ। সকালেই দেখি মা আমার জন্য সুজির হালুয়া রান্না করেছেন। ঈদের নামাজ পড়তে চাই শুনে নিজে আমাকে মাঠে নিয়ে গেলেন বাবা। নকশালবাড়িতে মুসলমানদের বসবাস আছে, এখানকার কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ শুরু সকাল সাড়ে নয়টায়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সময়মতোই সেখানে পৌঁছে গেলাম। মাঠের প্রবেশদ্বারটি সুন্দরভাবে সাজানো।
ভেতরে গিয়ে পেছনের একটি কাতারে দাঁড়ালাম। আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে ঈদের কুশলবিনিময় হলো। যখন শুনলেন বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং তাঁদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে এসেছি, তখন যেন এক অদৃশ্য বাঁধনে তাঁরা আমাকে আপন করে নিলেন। নামাজ শেষ হলে অনেকেই এগিয়ে এলেন, কোলাকুলি করলেন। বের হয়ে দেখি, বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
বাড়িতে ফিরে দেখি, মা খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। একসঙ্গে খেলাম। আরও একটা দিন থেকে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেন মা। কিন্তু আমাকে তো পথ চলতেই হবে। বিদায়ের আগে মায়ের সঙ্গে আমার মায়ের ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিলাম। দুই মা কথা বলছেন, আর আমি চোখের জল আড়াল করছি।
বিদায়ের সময় মা মাথায়–গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বাবা, মাকে ভুলে যেয়ো না। তুমি অবশ্যই সফল হবে। তোমার কষ্টের ফল তুমি পাবে। ফিরে এসো, আমি অপেক্ষায় থাকব।’
আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম। বারবার ফিরে তাকাচ্ছি, দেখছি, অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন মা।