ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সবে পেরোলেন উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি। এরই মধ্যে ২০ বছর বয়সী কাশফিয়া আরফা অর্জন করেছেন বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র নারী রেসারের খেতাব। গত ১৯-২২ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামে আয়োজিত ‘এশিয়ান অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৪’-এ মিক্সড ডাবল বিভাগের দ্বিতীয় পর্বে কাশফিয়া হয়েছেন ষষ্ঠ। এই অর্জনের শুরুটা অসম্ভব মনে হলেও কাশফিয়া এগিয়েছেন নিজের ছন্দে। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে তিনি কথা বললেন আবৃতি আহমেদ—এর সঙ্গে।
প্রথম আলো :
এত কম বয়সে এত বড় পরিচয়, কেমন লাগছে?
কাশফিয়া: স্বপ্নকে পেশায় পরিণত করতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। দেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যেতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। এখন মনে হয়, চাইলে আমি সামনে আরও অনেক বড় কোনো লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। আরও বেশি ভালো লাগবে, যদি অন্য নারীদের স্বপ্নযাত্রায় অনুপ্রেরণা জোগাতে পারি।
প্রথম আলো :
‘এশিয়ান অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ কীভাবে অংশ নিলেন?
কাশফিয়া: অটো জিমখানা চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজনটি আসলে একটি প্রস্তুতিমূলক রেস ছিল। ‘ফেস্টিভ অব স্পিড’ নামের আরেকটি রেস আছে ১৭ অক্টোবর (শেষ হয়েছে) মালয়েশিয়ায়। আমার লক্ষ্য মূলত ‘ফিফা মোটর স্পোর্ট গেমস ২০২৪’-এ অংশ নেওয়া। সেটির আসর বসবে এ মাসে (অক্টোবর) স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায়। দুটি রেসিং টুর্নামেন্টেই অংশগ্রহণ করছি।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ‘এফআইএ এএসএন জাতীয় রেসিং লাইসেন্স’ পেয়েছেন, কীভাবে সম্ভব হলো?
কাশফিয়া: এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের। ভিয়েতনামের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তারাই প্রথম আমাকে ডাকে। সেখানকার বেশ কয়েকটি আয়োজনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হই। এরপর তারা আমাকে ‘আন্তর্জাতিক রেসিং লাইসেন্স’ দেয়।
প্রথম আলো :
রেসিংয়ে আগ্রহী হলেন কীভাবে?
কাশফিয়া: ছোটবেলা থেকেই গাড়ি খুব টানত। রেসিংয়ের গতি ও চ্যালেঞ্জে রোমাঞ্চ কাজ করে। প্রতিটা মুহূর্ত অন্য রকম মনে হয়। এটাই আসলে আমাকে রেসিংয়ে টেনে এনেছে। আমার প্রথম রেসিং কার ছিল মাজদা আর এক্স ৮।
একদম ছোটবেলায় কী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
কাশফিয়া: একদম ছোটবেলায় এমন কিছু করতে চেয়েছি, যা আমাকে আলাদা পরিচিতি এনে দেবে এবং দেশের জন্য গর্বের কারণ হব। যদিও রেসিংয়ের প্রতি আমার আগ্রহ পরে তৈরি হয়, ছোটবেলা থেকেই সব সময় চাইতাম ব্যতিক্রমী কিছু করতে। আমার সেই স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। একজন রেসার হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এটা আমার জীবনের বড় অর্জন। তবে আমি মনে করি, স্বপ্ন শেষ হওয়ার নয়, এখনো অনেক কিছু করার আছে। প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো :
আপনার অনুপ্রেরণা কে?
কাশফিয়া: সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা। খুব ছোটবেলাতেই আমার বাবা মারা যান। এর পর থেকে তিনি একা হাতেই আমাদের দুই বোনকে আগলে রেখেছেন। তাঁর ত্যাগ, ভালোবাসা ও সাহস আমাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে বাঁচতে শেখায়। রেসারের পাশাপাশি আমি একজন হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। আমার শিক্ষক হিরা বেগম ও হ্যান্ডবল কোচ নাসির উল্লাহর প্রতিও আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তাঁদের উপদেশ, ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা সঙ্গে ছিল বলেই এতটা পথ আসতে পেরেছি।
আপনার প্রিয় রেসার কে?
কাশফিয়া: আমার প্রিয় রেসার অভিক আনোয়ার। তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক ইভেন্টজয়ী বাংলাদেশি রেসার। তিনি যখন রেসিং শুরু করেন, তখন বাংলাদেশে রেসিংয়ে কোনো সুযোগ-সুবিধাই ছিল না। কিন্তু তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি, নিজ যোগ্যতায় দেশের হয়ে সাফল্য নিয়ে এসেছেন।
প্রথম আলো :
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রেসিং কঠিন নাকি সহজ বলে মনে হয়?
যারা আপনার মতো হতে চায়, তাদের কী পরামর্শ দেবেন?
কাশফিয়া: প্রতিটি সাফল্যের পেছনে কঠোর পরিশ্রম আর মনোযোগ থাকে। তাই বলব, স্বপ্ন দেখুন, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন আর কখনো হাল ছাড়বেন না। আমাদের দেশের মেয়েরা অনেক কিছু করতে পারে, শুধু তাদের সুযোগ আর সাহস লাগবে।
কাশফিয়া: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার রেসিংয়ের পুরো বিষয়টিই বেশ কঠিন। এর জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মানের রেসিং ট্র্যাক, গাড়ি, প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের যথেষ্ট অভাব আছে। কিন্তু এখন অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ আগ্রহী রেসারদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা দিচ্ছে। যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্ম এবং বিভিন্ন সংগঠন ধীরে ধীরে রেসিংয়ে আগ্রহী হচ্ছে। সবার সমর্থন ও যথাযথ পরিকল্পনা থাকলে বাংলাদেশেও কার রেসিংয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে।
আপনার কী কী সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে?
কাশফিয়া: আমাদের দেশে এখনো নারীকে গাড়ির চালক হিসেবে দেখে মানুষ খুব একটা অভ্যস্ত নয়। পথে বের হলে এটা তীব্রভাবে অনুভব করি। কিন্তু ‘তুমি পারবে না’—এ ধরনের নেতিবাচক কথাকে আমি আমার শক্তি হিসেবে নিয়েছি, সেভাবেই এগিয়েছি। নিজে কিছু করতে চাইলে শুধু নিজের কথা শুনতে হবে, অন্যদের কটূক্তিতে থাকতে হবে বধির হয়ে। কঠিন মনে হলেও নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটতে এটুকু মেনে এগোতে হবে।
প্রথম আলো :
অনেকেই বলছেন, আপনি দারুণ সাহসী...
কাশফিয়া: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঝুঁকি থাকে। অনেক বাধাও থাকে। এসব ভয়, অনিশ্চয়তা অতিক্রম করতে সাহসই সবচেয়ে বড় শক্তি। তবে শুধু সাহসই নয়, সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস, পরিশ্রম ও ধৈর্য সফলতার জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
কাশফিয়া: ইন্টারন্যাশনাল র্যালিক্রস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা আছে। আমি চাই, একদিন এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ুক।