ক্যারিবিয়ান ক্রুজে মেক্সিকোর মায়ান পিরামিডে
মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপ ও সার্কাসের আলোকচিত্র
জাহাজখানা মনে হয় নোঙর তুলছে। সশব্দ সঞ্চালনে সচকিত হয়ে কেবিনের দেয়ালে হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করি। তারপর টলোমলো পায়ে বসে পড়ি ছোটখাটো কামরার একমাত্র সোফাটিতে। অনুভব করি—সামান্য সময়ের ব্যবধানে, বিমূর্ত চিত্রকলায় শোভিত মায়ামি নগরীর সৈকত, আর্ট-ডেকো কেতার স্থাপত্য প্রভৃতি হয়ে পড়বে ভিন দেশের ঝাপসা হয়ে আসা এক সমুদ্রবন্দর। ঘন্টাখানেক হতে চলল, জাহাজের স্টেটরুম নামে পরিচিত কেবিনটিতে সেটল্ড্ হওয়ার চেষ্টা করছি। সহযাত্রী শ্যানন মিনিট পনেরো আগে থারমোস ভর্তি গরম জল জুগিয়ে গেছে। কাঁপা হতে তৈরি করেছি চা। পেয়ালা একটি নয়, দুটি। তা থেকে উড়ছে ধোঁয়া, ছড়িয়ে পড়ছে সিলোন টির সুগন্ধ।
কথা ছিল, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফিরে এসে শ্যাননও শামিল হবে চা-পানে। সে না আসাতে অবাক হই না তেমন। দীর্ঘদিনের পরিচিত এ নারী, যাকে বন্ধু সন্বোধন করতে আমি ভালোবাসি। কথার খেলাফ সে করে না বটে, তবে সময়নিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তার অনীহা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। ক্যারবিয়ান ক্রুজ নামক এ নৌযাত্রার টিকিট কেনা থেকে কেবিন সিলেকশন অব্দি তাবৎ কিছুতে শ্যানন আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। অ্যালগরিদমের কলাকৌশলে আমার প্রত্যাশিত বাজেটের চেয়ে বিপুল ছাড়ে সে শুধু ক্রুজের টিকিট কিনে দেয়নি, দরাজ হাতে কমিশনও নিচ্ছে। বিনিময়ে অনলাইনে শোর এক্সকারশন তথা—মেক্সিকোর ইউকাতান পেনিনসুলা, বেলিজ ও হন্ডুরাসের একাধিক পিরামিড–শোভিত মায়ান মন্দির পরিদর্শনের বন্দোবস্তেও হাত লাগিয়েছে।
একটু আগে শ্যানন আমাকে শুধু গরম জলের ফ্লাস্কই সরবরাহ করেনি, সাইড টেবিলে ওষুধবিসুধ, সপ্তাহের প্রতিটি দিন চিহ্নিত পিলবক্স, সাপ্লিমেন্টের কৌটা, নিত্যদিনের স্বাস্থ্য–ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতি প্রভৃতি গোছগাছ করে দিয়েছে। নৌভ্রমণে টিকিট কাটা ও ইন্টারনেট বিষয়ক সহায়তা ভিন্ন অন্য সবকিছু শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, তার জব ডেসক্রিপশনের বাইরেও। জাহাজে ওঠা মাত্র পয়লাবার ক্রুজে আসা প্রায় আড়াই হাজার সহযাত্রীর ছোটাছুটিতে এমন ধুন্ধুমার বেঁধেছিল যে কোনোক্রমে আমরা নির্দিষ্ট কেবিনে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছি। ভাবছি, আরও ঘণ্টাখানেক নিরিবিলি কাটিয়ে বাইরে ডেক, রেস্তোরাঁ ও বারগুলোতে কুরুক্ষেত্রপ্রতিম পরিস্থিতি শান্ত হলে পরে জাহাজ দেখতে বেরোব। আমি চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে আগেকার ক্রুজে কোনো যাত্রী আমার কামরায় কৃত্রিম কোনো ডিম লুকিয়ে রেখেছে কিনা, তার তালাশ করি।
দুয়ার ঠেলে কেবিনে ঢোকে শ্যানন। আমি ম্যাসেজ পোরা কৃত্রিম ডিমের সন্ধান করছি বুঝতে পেরে উপদেশ দেয়, ‘ইউ রিয়েলি হ্যাভ টু সার্চ হার্ড। আগেকার ক্রুজের কোনো প্যাসেঞ্জার হয়তো ফ্লোর ল্যাম্প, এয়ারকন্ডিশনার অথবা সিংকের পেছন দিকের নাট-বল্টু খুলে ডিমটি লুকিয়ে রেখেছে। খুঁজে পাওয়াটা সহজ হবে না।’
অনুসন্ধান মুলতবি রেখে আমি তার দিকে তাকাই। বিকিনির ওপর সিল্কের রোব পরে এসেছে। কাঁধে তোয়ালে। বটুয়াতে সানস্ক্রিনের কৌটাও। অর্থাৎ সে সুইমিংপুলের দিকে যাচ্ছে। টুকটাক কথাবার্তা থেকে জানতে পারি, আগেকার যুগে ক্রুজে ডিম খুঁজে পেলে, বার্তার নিচে দেওয়া ঠিকানায় চিঠিপত্র লেখা যেত। দিন বদল হয়েছে। নৌযাত্রীরা বার্তার তলায় হালফিল খুঁজে পাচ্ছে ব্লগ প্রভৃতির লিংক। এমনকি অ্যাপস ইত্যাদির মাধ্যমে গড়ে ওঠছে আন্ডা-পানেওয়ালাদের নেটওয়ার্ক।
চোখেমুখে স্কুল মিসট্রেসের অভিব্যক্তি নিয়ে শ্যানন এবার মেলে ধরে জাহাজের একখানা মানচিত্র। তাতে বিরাট এ নৌযানের কোনটা ‘বো’ বা ফ্রন্ট, আর কোনটা ‘স্টার্ন’ বা ব্যাক, এমনকি কোথায় স্টারব্রিজ বা জেটিমুখি ডেক প্রভৃতি হাইলাইটারে তীরচিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করা। নৌযাত্রার পয়লা দিনে কী কী না করলেই নয়, সে তার একটি তালিকা লেখা চেকলিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে চা পান না করেই বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। শ্যাননের আচরণে রীতিমতো বিভ্রান্ত বোধ করি, কারণ বার্তা পোরা অশ্বডিম্ব খুঁজে পেতে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও আমি এমন কোনো অকালকুষ্মাণণ্ড নই যে জাহাজের অন্ধিসন্ধি নিজে খুঁজে নিতে পারব না।
কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসি কেবিনের লাগোয়া চিলতে বেলকনিতে। জাহাজখানা এখনো ভাসছে নদীজলের সংকীর্ণ খাড়িতে। গতি এতো ক্ষীণ যে আগে বাড়ছে না থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বলা মুশকিল। সমুদ্রগামী নদীটি বাঁক নিয়েছে সামনে। তাতে ভাসমান দুটি জাহাজের মাঝবরাবর জল কেটে ছুটছে একটি ট্যাগবোট। উড়ছে সবর্ত্র একাধিক সিগাল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শ্যাননের আচরণ নিয়ে ভাবি। ক্যারিবীয় অঞ্চলের সমুদ্র সে ভালোবাসে এবং প্রতিবছর ক্রুজ-বোট চেপে দু-তিনবার করে তার জলে ভাসা চাই। গেল বছর বিশেক ধরে এভাবে সে নৌভ্রমণ করে আসছে। এ রুটের প্রায় প্রতিটি জাহাজই তার চেনা। কখনো ভাড়ার কড়ি জোটাতে না পারলে কোনো না কোনো প্যাসেঞ্জারের নৌযাত্রার জোগাড়যন্ত্র সে করে দেয়। তা থেকে পাওয়া কমিশন দিয়ে রাহাখরচের সংকুলানও করে। তা করুক, তার এক্সপার্টিজের মারফত আমি উপকৃত হচ্ছি। আমার মতো আরও কিছু যাত্রী, যারা নৌযাত্রায় কম্পিউটার তথা ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপস প্রভৃতি ব্যবহার না করে শ্যাননের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা পাচ্ছে, আমার মতো তারাও তার সহায়তাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করছে। তবে আমার বিভ্রান্তি অন্যত্র।
যাত্রার শুরুয়াতে আমি পুরো দুটি দিন বলা চলে তার সান্নিধ্যে কাটিয়েছি মায়ামিতে। প্রচুর সময় দিয়েছে সে, এবং বারবার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত একাধিক স্টাডির উল্লেখ করে বলেছে, সিনিয়র সিটিজেনদের দিনযাপনে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। ক্রুজের মাধ্যমে তারা সমমনা অন্যান্য বয়োবৃদ্ধদের সান্নিধ্যে আসতে পারে অতি সহজে। একত্রে যেতে পারে রেস্তোরাঁ বা পানশালা-কেন্দ্রিক লাইভ মিউজিক বা কনসার্টে। এমনকি, চাইলে জুটি বেঁধে উপকুলে শোর এক্সকারশনও করতে পারে। পরস্পরের মধ্যে পূর্বপরিচয় নেই, এ রকমের সিনিয়রদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য নির্মিত হয়েছে একাধিক অ্যাপস। তার কথাবার্তায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমিও ক্রয় করেছি অ্যাপস বিষয়ক সহায়তা।
গতকাল শ্যানন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল মায়ামির পর্যটক–উপদ্রুত সৈকতে। কিন্তু তুমুল রোদে সামান্য সময়ের ভেতর আমি উত্যক্ত হয়ে ওঠলে সে প্রস্তাব দেয়, ‘লেট মি শো ইউ আ ফিউ আর্ট ডেকো স্টাইল বিল্ডিংস্।’ স্থাপত্যকলায় আমার আগ্রহ প্রচুর। গেল শতাব্দীর বিশ থেকে তিরিশের দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের হরেক নগরীতে গড়ে উঠেছিল আর্ট ডেকো শৈলীতে অনেকগুলো দালানকোঠা। মায়ামির সৈকত-সংলগ্ন সরণীতে এ ধারার ইমারত একাধিক। সৈকত ছেড়ে শ্যানন আর্ট ডেকো স্টাইলের একটি দালানের সামনে নিয়ে এলে কেন জানি আমি উত্সাহ হারাই। ঢুকতে চাই না ভেতরে। তবে সড়কের একটি চলমান দৃশ্যপট আমাকে আমোদ জোগায়। চেষ্টা করি, সেগওয়ে নামক বাহনের চাকায় ভর দিয়ে ছুটে চলা একটি যুবক ও দুটি যুবতীর ছবি তুলতে। মেয়ে দুটির হেলমেটে মোহাক কেতার সাজ। তাদের পুরুষ-সঙ্গীটি গতি সামান্য কমিয়ে দিয়ে সেলফোনে তুলে নিচ্ছে সাথীদের ছবি।
এ পথদৃশ্য শ্যাননকে স্মৃতিতাড়িত করে। সে বলে ওঠে, ‘ডু ইউ রিমেমবার বাই অ্যানি চান্স...প্রথম যেবার তুমি মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপে এসেছিলে, ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি ছেলের মাথায় মোহাক কেতার চুল দেখতে পেয়ে তোমার চোখ দুটি কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল?’
আর্ট ডেকো শৈলীর ইমারত দেখা-ট্যাখা বাদ দিয়ে, মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপের স্মৃতি নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে আমরা ফের সরণীতে হাঁটি। অনেক অনেক বছর আগে আমি স্বদেশ ছেড়ে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া এসে পৌঁছেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। ছাত্র হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছিলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্রীষ্মের অবকাশে বেড়াতে যাই মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপে। ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে নিত্যদিনের ভাড়া জোটানো কঠিন হয়ে উঠেছিল। হাইস্কুলে ড্রপআউট হওয়া তরুণী শ্যানন পার্টটাইম কাজ করত ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে। আমি পুরো সামার মার্থা’স ভিনিয়ার্ডে বাস করতে চাই শুনে বলেছিল, ‘তোমার ইনকামে তুমি কখনো এখানকার কোনো বাড়িতে কোনো কামরা দূরে থাক, খাটিয়াও ভাড়া করতে পারবে না। তবে যদি তাঁবুতে বসবাস করতে আগ্রহী হও, জাস্ট লেট মি নো। আমার লগকেবিনের সামনে টেন্ট খাটাতে পারো। আই উইল নট চার্জ ইউ অ্যানি রেন্ট।’
সমস্যা দেখা দিয়েছিল তাঁবু খরিদ করার কড়ি জোটাতে না পারলে। শ্যানন তার ছাদে ছিদ্রওয়ালা তাঁবুটি শুধু ধারই দেয়নি, সারভাইভাল সেন্টার থেকে ফ্রি একটি স্লিপিংব্যাগ জোগাড় করে দিয়ে আমার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিল। হরিণচরা হাল্কা বনানীর ভেতরবাগে ছিল তার ঝুরঝুরে এক কামরার লগকেবিন। সন্ধ্যার পর হেডল্যাম্পের আলোয় ঘরে ফিরে প্রায়শ সে জ্বালাত ক্যাম্পফায়ারের আগুন। তার আঁচে আমার রাতের খাবার ঝলসে নিতে কোনো অসুবিধা হতো না।
আগুনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য আমি দিনদুপুরের বনানী ঢুঁড়ে জোগাড় করে রাখতাম শুকনো কাঠ। কখনো খাবার শেয়ার করতে করতে আমরা কিছু ব্যক্তিগত তথ্যও আদানপ্রদান করতাম। তখন জেনেছিলাম যে, তার পিতা ও পিতামহ ছিলেন মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপের প্রখ্যাত দুই ডাক হান্টার। তাঁরা তীরধনুক দিয়ে শিকার করতেন হাঁস। তার মাও হাঁস শিকারের জন্য ডিকয় বা কাঠের নকল হাঁস তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তীরন্দাজিতে শ্যাননেরও দক্ষতা আছে। কিছুদিন কোনো এক সার্কাসে সে তীর ছুড়ে লক্ষ্য ভেদ করার কাজ করেছে। মাঝেমধ্যে আমাদের কথাবার্তায় বিষয়বস্তুর অভাব হলে একটি তরুণের মাথায় মোহাক কেতার কেশসজ্জা দেখে আমি যে বিপুলভাবে বিস্মিত হয়েছিলাম, কিংবা ডেজিগনেটেড ন্যুড-বিচে সন্ধ্যাবেলা চাদর-সমেত কোর্তা-পায়জামা পরে নিশুতি নারী-পুরুষদের চোখ ছানাবড়া করে হেঁটেছিলাম—তা ইয়াদ করিয়ে দিয়ে আমাকে খেপাত। আর জোনাকির আলোয় কাঁটাচামচের সহায়তা ছাড়া আমার হাতের পাঁচ আঙুলে ভাত খাওয়া দেখেও সে আমোদ পেত।
সরণীতে হাঁটতে হাঁটতে নোনা হাওয়ার ঝাপটায় সচেতন হই যে আমরা চলে এসেছি মায়ামির ওয়াটার ফ্রন্টের খুব কাছে। পামবীথিকার ওপর দিয়ে অত্যন্ত লো-ফ্লাইটে উড়ে যায় তিনটি নাদুসনুদুস পেলিক্যান। ওগুলোর উড্ডয়নরেখার দিকে তাকিয়ে শ্যানন বলে ওঠে, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট…উই মে এক্সপ্লোর দিস ক্রুজ-শিপ টুগেদার। তারপর…তুমি তো চলার পথে সামান্য সব ডিটেল ভালোবাসো। ডেকে বসে কিন্তু দেখা যায় জাহাজ-চড়া মানুষজনদের চলাফেরা অথবা সমুদ্রজলে জলচর প্রাণীদের ভেসে যাওয়া.., হাউ আবাউট দিস?’
জবাব দিই আমি, ‘সাউন্ড্স্ রিয়েলি গুড, মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপের স্মৃতি নিয়েও কথা বলা যায় কিন্তু।’ মাথা থেকে স্কার্ফটি খুলে নিয়ে সে চোখেমুখে আগ্রহ ফুটিয়ে বলে, ‘রিমেমবার উই অ্যাগ্রি টু স্পেন্ড সাম কোয়ালিটি টাইমস টুগেদার ইন দ্য ক্রুজ।’
আমি উদ্দীপ্ত হই আর খেয়াল করি যে, আমাদের জাহাজটি হেলেদুলে চলতে শুরু করেছে। আমরা ক্রমশ বেরিয়ে যাচ্ছি নোনাজলের নদী ছাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে। কাছেই নোঙর করে আছে আরেকখানা পেল্লায় ক্রুজ-শিপ। আমি কপালে হাত রেখে রোদ ফিরিয়ে পড়ে নিই জাহাজটির নাম, ‘কার্নিভ্যাল প্রাইড’। ক্রুজে জাহাজ সিলেকশনের সময় এ জাহাজ সম্পর্কে আমি শ্যাননের কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনেছি। সে বছরখানেক আগে কার্নিভাল প্রাইডে ক্রুজ করেছে। ‘এনচ্যানমেন্ট অব দি সিজ’ নামে যে জাহাজে আমরা ভাসছি, নকশার দিক থেকে কার্নিভ্যাল প্রাইডও প্রায় একই রকমের, এদের প্যাসেঞ্জার ক্যাপাসিটি আড়াই হাজারের সামান্য ওপরে, প্রায় হাজারখানেক ক্রু নৌযাত্রীদের হরেক রকম সার্ভিস দিতে অষ্টপ্রহর মোতায়েন থাকেন।
হঠাৎ করে বেড়ে যায় জাহাজটির গতি। আমি রেলিংয়ে হাত ঠেকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে দেখি, আমরা ভেসে যাচ্ছি মায়ামির প্রায় চেনা কিছু দালানকোঠার পাশ ঘেঁষে। গতকাল ওই ওয়াটার-ফ্রন্ট নেইবারহুডে শ্যাননের সঙ্গে আমি কিছু কোয়ালিটি টাইম কাটিয়েছি। রাজপথে নীল রঙের চৌকস একটি তিন চাকার ট্রাইক দেখতে পেয়ে শ্যানন আওয়াজ দিয়ে তুলেছিল হাত। আরোহী কৃষ্ণাঙ্গ এক যুগল ট্রাইক থামিয়ে তাকে হ্যালো বলেছিল। হাত ঝাকঝাকি করে পরিচিত হয়েছিলাম আমিও। এ জুটির দুজনই চিত্রশিল্পী। মাস-তিনেক আগে তারা এ নেইবারহুডের ফুটপাথে এঁকেছেন বিরাট আকারের একটি ম্যুরাল। এরা দুজন ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান। এদের মধ্যে ডিয়েগো নামে তরুণটির পিতামাতা বাহামা এবং এমিলিয়ানো নামে তরুণীটির মা-বাবা ত্রিনিদাদ থেকে মায়ামিতে এসে সেটেল্ড্ হন গেল শতকের ছয়ের দশকে। শিল্পী দুজন অনুরোধ করেন, মাত্র ব্লকখানেক দূরের ফুটপাতে শোভা পাচ্ছে তাদের আঁকা ম্যুরাল। আর্টওয়ার্কটিতে আমি যদি নজর বোলাই, তাহলে তারা যারপরনাই খুশি হবেন।
ম্যুরাল অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে জানাতে পারি যে শ্যানন অ্যারেঞ্জার হিসাবে এ চিত্রকর্ম বাস্তবায়নের খুঁটিনাটি সবকিছুতে যুক্ত ছিল। চিত্রপ্রীতি, বিশেষ করে ম্যুরাল, ফ্রেস্কো প্রভৃতি শৈলী সম্পর্কে তার আগ্রহ সম্পর্কে আমি বিগতভাবে ওয়াকিবহাল। মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপে বসবাসের দিনগুলিতে ভ্রাম্যমাণ এক ইউরোপীয় চিত্রকরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। ওখানকার বাইক-পাথের পাশে সে ম্যুরাল আঁকতে চাইলে শ্যানন অনুমতি আদায় করা থেকে আরও নানাবিধ জোগাড়যন্ত্রে হাত লাগিয়ে অ্যারেঞ্জারের দায়িত্ব পালন করেছিল। তাদের সম্পর্ক টেকেনি, তবে ম্যুরালটি দাঁড়িয়ে ছিল বাইসাইকেল–অধ্যুষিত পথের পাশে বছর দুয়েক।
এসে পড়ি আমরা ম্যুরালের শিল্পদ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা সরণীতে। বিরাট আকারের সড়কচিত্রটির সামনে সেলফোনে ছবি তুলছে সপরিবারে মায়ামিতে বেড়াতে আসা পর্যটকরা। তাদের দিকে হাত নেড়ে আমরা একটু সরে এসে চিত্রকর্মটির কাছাকাছি দাঁড়াই। হঠাৎ করে কেন জানি চুপচাপ হয়ে পড়ে শ্যানন। বটুয়া থেকে ওষুধের শিশি বের করে নাসারন্ধ্রে সে কিছু একটা স্প্রে করছে। ছবি দেখাতে মনোযোগ দিই আমি।
লোহিত বর্ণের বৃক্ষলতাহীন উষর এক পর্বতের ওপরে ভাসছে জায়েন্ট সাইজের এক মানবসন্তান। জানতে কৌতূহল হয়, লোকটি সুপারম্যান না নভশ্চর? মনে হয়, দৈত্যপ্রতীম মানুষটির শরীর দড়িদড়া দিয়ে বাঁধা ওপরের কোনো অদৃশ্য উড়োজাহাজের সঙ্গে। চিত্রের এ চরিত্রটি উড়ছে না ভাসছে নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে তার আচরণে স্পষ্টত ফুটে উঠছে স্ট্রাগল।
পাশ থেকে মিনমিনিয়ে শ্যানন বলে ওঠে, ‘হেল্প মি আউট হিয়ার, উইল ইউ?’ ঘুরে তাকাই আমি। দেখি, সে ব্যাকপ্যাক থেকে ওয়াকিং স্টিকের মতো কিছু বের করার চেষ্টা করছে। হাত লাগাই। বস্তুটি আদতে একটি ফোল্ডিংচেয়ার। তাতে বসে রীতিমতো নেতিয়ে পড়ে সে বলে, ‘ইউ প্রোব্যাবলি ডোন্ট নো, বছর দশেক হতে চলল আমার শরীরে ধরা পড়েছে অটো–ইমিউন ডিজিজ। মাঝেসাজে এত ক্লান্তি পায় যে একটু সময় বসে জিরিয়ে না নিলে…আই ক্যান্ট রিয়েলি স্ট্যান্ড অন মাই ফিট। আই ক্যান্ট রিয়েলি মুভ অ্যালং।’
উবার চেপে আমরা ফিরি তার লো-ইনকাম নেইবারহুডের অ্যাপার্টমেন্টে। ফেরার পথে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা তেমন কিছু হয় না। তবে পেছনের সিটে শ্যাননের পাশাপাশি বসে কেবলই মনে হচ্ছিল, গেল তিন দশকে আমি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়েছি একাধিকবার। কমন ফ্রেন্ডদের মারফত কোনো না কোনোভাবে তা জানতে পেরে সে হয় টেলিফোন করেছে, না হয় জলরঙে আঁকা ‘গেট ওয়েল সুন’ কার্ড পাঠিয়ে খোঁজখবর করেছে। বিনিময়ে আমি কখনো তার জীবনে কী ঘটছে কিছু জানতে চাইনি। ভাবি, আমাদের এ আচরণগত পার্থক্যের পেছনে জেন্ডারবিষয়ক ব্যবধান কি কোনো ভূমিকা রেখেছে? নাকি তার সঙ্গে অধিক অন্তরঙ্গ হতে আমি অবচেতন থেকে কোনো সায় পাইনি বলে বিশদ কিছু জানতে কখনো উদ্যোগ নিইনি?
অ্যাপার্টমেন্টের দোরগোড়ায় আমি বিদায় নিতে যাই, কিন্তু শ্যানন স্মীত হেসে বলে, ‘কামন ওভার। আই ক্যান অফার ইউ আ ড্রিংক।’ আহ্বানটি ফেরাই না আমি। একটিমাত্র কামরার দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে পাতা তার বিছানা। তা থেকে একাধিক বর্ণে দ্যুতি ছড়াচ্ছে বাটিক-টাইডাই নকশার বেডকাভার। অগোছালো বইপত্রে উপচে পড়া বুকশেল্ফের পাশে ক্যানভাসের দুটি ফ্লোল্ডিংচেয়ার। কফিটেবিলে ছাইদানি, একাধিক পাইপ, মোমদান, জলরঙের টিউব, ছোটখাট একটি গ্লোব ও আইপ্যাড প্রভৃতি রাখা।
ক্যানভাসের চেয়ারটিতে বসতেই চোখ চলে যায় ছাদে। তাতে আড়াআড়ি ঝুলছে তিব্বতের বেশ কতগুলো প্রার্থনা-পতাকা। স্টিরিওতে মৃদুস্বরে বেজে ওঠে বাঁশরী, যা নিমেষে আমাকে নিয়ে যায় মায়ামি থেকে অনেক দূরে মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপে। বহু বছর আগে, সপ্তাহে অন্তত একবার করে আমরা একটি বৌদ্ধ মন্দিরের মেডিটেশন গ্রোগ্রামে শরিক হতাম। মুণ্ডিতমস্তক একজন তরুণ ভিক্ষু ধ্যানবিষয়ক সেশনের শুরুয়াতে বাঁশরীর এ টেপটি বাজিয়ে দুহাত জোড় করে আমাদের ওয়েলকাম করতেন।
কিচেনেটের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শ্যানন জানতে চায়, ‘উড ইউ এনজয় আ কাভা রুট বেইস্ড্ ড্রিংক?’ কিঞ্চিৎ নেশাজাগানিয়া এ পানীয় সম্পর্কে শুনেছি বিস্তর, কিন্তু কখনো চেখে দেখার মওকা মেলেনি। আমার চোখমুখে দ্বিধা দেখতে পেয়ে সে ব্যাখ্যা করে, ‘কাভা হচ্ছে ফিজি কিংবা হাওয়াই দ্বীপে প্রাপ্ত এক ধরনের ভেষজ শিকড়, যা সেবন করে ওখানকার আদিবাসী কৌমের পুরোহিত বা শামানরা চলে যান চেতনার এক জাদুময় স্তরে।’ প্রতিক্রিয়া জানাই, ‘সন্ধ্যাটা সচেতনভাবে কাটাতে চাই, শ্যানন।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার আপত্তি নাচক করে দিয়ে সে বলে, ‘পরিমিত পানে হ্যালুসিনেশন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
কাভা-শিকড়ের বিশুষ্ক চূর্ণে বরফকুঁচি দেয়া কোকোনাট ওয়াটার মিশিয়ে শ্যানন তৈরি করে পানীয়। আগ্রহভরে চুমুক দিই শরবতের শীতল পেয়ালায়। এক ধরনের স্নিগ্ধ আমেজে ক্রমশ রিল্যাক্স হয়ে আসে দেহমন। কথা বলার বিষয়বস্তু খুঁজছিলাম। চোখে পড়ে, কফিটেবিলে মোমদান ঘেঁষে রাখা বৌদ্ধ মনাস্টারিতে শিক্ষানবিশ নান হওয়ার পদ্ধতি বর্ণিত একটি প্যাম্ফলেট। কৌতূহলবশত জানতে চাই, ‘শ্যানন, আর ইউ প্ল্যানিং টু বিকাম আ বুডিস্ট নান?’ পান করতে করতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে জবাব দেয়, ‘ইয়েস, আই হ্যাভ দিস ডিজায়ার। শরীর অশক্ত হয়ে পড়লে যখন সৈকতে সময় কাটানো সম্ভব হবে না, ক্রুজে-ট্রুজে যাওয়াটাও যখন দুরূহ হয়ে উঠবে…পারহ্যাপ্স আই উড এক্সপ্লোর ইফ আই কুড বিকাম আ নান।’
‘সাউন্ডস সো ইন্টারেস্টিং,’ বলে আমি প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করি। করোটির ভেতর একসঙ্গে অনেকগুলো শিমূল ফেটে ছড়িয়ে পড়ে অলীক তুলো। সতর্ক হই আমি। একটি সিডি ডিস্কে করে শ্যানন পরিবেশন করে গোটাকয়েক কাঠবাদাম। একটি মুখে দিয়ে ভাবি জিজ্ঞেস করব, তোমার ঘরে পিরিচ-টিরিচ কিছু নেই? তখনই চোখে পড়ে, ফুলের টবে পোঁতা বিচিত্র কোনো গাছের শুকনো খটখটে ডাল। তার প্রতিটি প্রশাখা থেকে ঝুলছে গ্লাসবিড, পুঁতি ও পাথরে তৈরি গলার হার ও কানের দুল; আর টবটিতে ঠেকা দিয়ে রাখা ফ্রেমে বাঁধানো ফটোগ্রাফও, তাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিশোরী শ্যানন বুলস্ আই বা অভিষ্ট লক্ষ্যে ছুড়ছে তীর।
বুঝতে পারি এটি তার সার্কাস–জীবনের স্মৃতি। প্রশ্ন করি, ‘ডু ইউ মাইন্ড টেলিং মি আ লিটল বিট অ্যাবাউট ইয়োর সার্কাস ডেইজ, শ্যানন?’ ভ্রূকুটিতে বোধ করি সে যাচাই করে নেয় আমার উদ্দেশ্য। তারপর বিরক্ত হয়ে বলে, ‘দেয়ার ইজ নট আ হৌল লট টু টেল ইউ। পারফরমেন্সের সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে ইনজিওর্ড হয়েছিলাম। এ নিয়ে তিনবার অপারেশন হলো, কিন্তু টেরিবল ব্যাকপেইনের কোনো সুরাহা হয়নি। দ্যাটস্ অল।’
জানতে চাই, ‘সার্কাসের ছবিটির একটি প্রতিলিপি আমাকে দেওয়া যায়?’ কোঁচকানো কপালে রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে সে জবাব দেয়, ‘হেল, নো?’ শেষ চেষ্টা করি, ‘হোয়াই নট শ্যানন, ছবির একটি ডিজিটাল কপি পেলে পারহ্যাপ্স আই কুড রাইট সামথিং অ্যাবাউট ইউ?’ কঠোরমুখে সে জবাব দেয়, ‘মাই সার্কাস ডেইজ আর অফ লিমিট, আন্ডারস্ট্যান্ড?’
প্রবল প্রতিক্রিয়ায় আমি থতমত খেয়ে যাই। অপ্রস্তুত পরিস্থিতি থেকে সে-ই আমাকে উদ্ধার করে বলে, ‘আই লাভ মাই লাইফ ইন মার্থা’স ভিনিয়ার্ড। ওই দ্বীপ নিয়ে কথা বলতে চাইলে, আই থিংক আই অ্যাম ওপেন ফর দ্যাট। জাহাজে কয়েক দিন তো একত্রে কাটাব। মে বি উই উইল চ্যাট আ বিট।’ নিমেষে করোটিতে ভেসে ওঠে মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপের টুকরো স্মৃতি। আমি চোখ মুদি আর দেখতে পাই, হ্রদের মতো নোনাজলের এক চিলতে কৌভে প্রাণপনে আমি সামলানোর চেষ্টা করছি উইন্ডসার্ফিংয়ের পাল। কাছেই ক্যানু নৌকায় বসে আমার নাস্তানাবুদ হওয়ার ছবি তুলছে শ্যানন। আর ঝুপ ঝুপ করে জলের নীলাভ সারফেসে একের পর এক ল্যান্ড করছে ম্যালার্ড প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস।
আশপাশের প্রতিটি বেলকনি থেকে জাহাজের সহযাত্রীরা একত্রে হাততালি দিই। সচকিত হয়ে আমি রেলিংয়ে ঝুঁকে চলমান জলের দিকে তাকাই। নদী অতিক্রম করে জলযানটি চলে এসেছে মোহনায়। সামনে বারদরিয়ার নোনাজলে উড়ছে তুমুল রোদের সোনালি ফুলকি। ফের হাততালি পড়ে। আর দেখতে পাই, জাহাজটির পাশ ঘেঁষে লাফিয়ে লাফিয়ে আগুয়ান হচ্ছে সাতটি ডলফিন।
কাউবয় ও ফ্লাইং ড্রাগন
কেবিন থেকে বেরিয়ে লিফট পাকড়ে সরাসরি চলে আসি জাহাজের ডেকে। লাঞ্চ সেরে কিছু যাত্রী জগিং-পাথ ধরে হাঁটাহাঁটি করছেন। মায়ামি বন্দর ছাড়ার পর কেটে গেছে ঘন্টা দেড়েক। তারপরও জাহাজচড়া কিছু বান্দার ক্রুজ বোটের হরেক ফ্যাসিলিটি চেক করে নেওয়ার আগ্রহ কমেনি। আমার ঠিক সামনে প্রবল কৌতূহল নিয়ে কয়েকজন নৌপর্যটক হেঁটে যেতে যেতে, থেমে, বারবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাচ্ছেন কাঁচঘেরা জিমনেশিয়ামের দিকে। ওখানে ঢুকে পড়তে পড়তে ভাবি, দেখে নেয়া যাক ব্যায়াম–করনেওয়াদের কার্যকলাপ।
এদিকে কামরা একাধিক। এক্সারসাইজের যন্ত্রপাতিও প্রচুর। মেডিটেশন ও অঙ্গ সংবাহনের কুঠুরি অতিক্রম করে চলে আসি আরামকেদারায় বসার বন্দোবস্তঅলা এক লাউঞ্জে। একটু দাঁড়াই। সামনের কাঁচের দেয়ালে শঙ্খ ও ঝিনুক গেঁথে তৈরি করা হয়েছে হাঙরের ছবি। ওপাশে কাঠের ফ্লোরে হালকা চালে ড্যান্স করছে ইয়োগা টাইটসপরা দুই নারী। কান্ট্রি মিউজিশিয়ান ডলি পার্টনের কণ্ঠস্বরে বাজছে, ‘জোওলিন, জোওলিন, অ্যাম বেগিং ইউ প্লিজ ডোন্ট টেক মাই ম্যান..।’
সংকীর্ণ করিডোর ধরে বেরিয়ে আসার পথে চোখ চলে যায় ইগলুর আকৃতিতে তৈরি আরেকটি কাচের কুঠুরিতে। ভেতরে দাঁড়িয়ে সূর্যস্নানের পোশাক পরা শ্যানন। হাতে তার ডার্ট ছোড়ার ছোট্ট তীর। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে রক অ্যান্ড রোলখ্যাত বাদক জন বোনামের ড্রামবিট। গাঢ় কনসেনট্রেশনে শ্যানন ড্রামবিটের তাল–লয় অনুসরণ করে ছুড়ছে ডার্টের তীর। সাপের ফনার মতো দুলে উঠছে চেস্টনাট বর্ণের পনিটেইল, কিন্তু লক্ষ্য সে ভেদ করতে পারছে না। নীরবে সরে আসি আমি। জীবনে বোধ করি দ্বিতীয়বার তার আপাত কোনো ব্যর্থতায় আবেগপ্রবণ হই।
মনে অবধারিতভাবে ফিরে আসে মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপের প্রসঙ্গ। ছবি তুলতে ভালোবাসত শ্যানন। তার প্যানটেক্স ক্যামেরাটি অর্থমূল্যে ছিল এক্সপেনসিভ। লেন্স ছিল উঁচু মানের। তারপরও স্ন্যাপশটগুলো শিল্পকলার মানদণ্ডে উতরাত না। ঢাকায় বাটিক প্রচলনের জন্য সে জামানায় আলোচিত বস্ত্রালয় শেড থেকে কেনা টাইডাইয়ের কোর্তা-পায়জামায় এবং কাঁধ অতিক্রম করা চুলে পর্যটকঅধ্যুষিত মার্থা’স ভিনিয়ার্ড দ্বীপে আমি ছিলাম রীতিমতো দর্শনীয় বস্তু। আমার কিছু পোরট্রেট পিকচারও সে করেছিল, কিন্তু অনভিপ্রেত ব্লারের কারণে কোনোটাই সংরক্ষণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
শ্যাননের হাতে ট্রেমর বা কম্পনের বিষয়টা তখন আমার চোখে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল। জানতে পেরেছিলাম যে তীর ছোড়ায় লক্ষ্যভেদী হওয়ার অভিলাষে তাকে গাঢ় কনসেনট্রেশনে অনুশীলন করতে হতো দিনের পর দিন। পরিণামে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল কব্জি ও বাহুর নার্ভ। তখন থেকে স্থির হয়ে ক্যামেরা ধরাটা তার জন্য দুরূহ হয়ে উঠেছিল। শ্যাননের ব্যর্থতাজনিত তুমুল ফ্রাস্ট্রেশনের মুখোমুখি হয়েছিলাম দূর অতীতেও একবার। আর আবেগপ্রবণ না হয়ে আমার গত্যন্তর ছিল না।
চলে আসি সুইমিংপুলের খোলামেলা চত্বরে। এদিকেও কিছু নৌযাত্রী কী এক উচ্ছ্বাসে মশগুল হয়ে দল বেঁধে হাঁটছেন। বুঝতে পারি না এ মুহূর্তে আমার করণীয় কী? কাচের ছায়াদার ছাউনির তলা থেকে রণপায়ে এগিয়ে আসে দৈত্যাকৃতির মুণ্ডুচাঁছা এক বান্দা। একা আসেনি সে। সামনে খেদিয়ে নিয়ে এসেছে স্কেলিটন স্যুটপরা এক নারীকে। কঙ্কালের লেবাসপরা রমণীটি সকলের দিকে হাত নেড়ে ছুটে যায়, স্পা চিহ্নিত করিডোর ধরে। এদের আচমকা উপস্থিতিতে রীতিমতো ঘা খেয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।
ডেকচেয়ারে বসে থাকা কাউবয় কেতার হ্যাটপরা এক লোক ভারি সুন্দর করে হেসে আওয়াজ দেন, ‘দেয়ার আর সাম গুড ফান ইন দ্য বোট।’ আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলে তিনি ফের কথা বলেন, ‘দিস ইজ নট দ্য টাইম টু লুক স্যাড। কামন ম্যান, লুজেন আপ আ বিট।’
পাশের ডেকচেয়ারে বসতে বসতে খেয়াল করি, নিচের দিকে নেমে ঝুলে থাকা অর্ধবন্ধনীর মতো গুঁফো মানুষটির ঠোঁটেমুখে লেগে আছে চ্যুয়িং টোবাকোর খয়েরি দাগ। তিনি রাম ডেকোরির গ্লাসে চুমুক দিয়ে জানতে চান আমার বিষয়–আশয়। জমে ওঠে কথাবার্তা। কাউবয় হিসাবে ব্র্যানডন মারফি ওয়াইয়োমিংয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অনেক বছর চালিয়েছেন ক্যাটল রেঞ্চ। এখন আর শরীরে কুলায় না। তাই শিক্ষানবিশ কাউবয়দের জন্য চালু একটি ড্যুডরেঞ্চে ঘোড়ায় চড়ার ইন্সট্রাকটার হিসাবে কাজ করেন। বছরে একবার করে ব্র্যানডনের ক্যারিবিয়ান ক্রুজের কোনো কোনো জাহাজে চড়া চাই। গরুর শিংওয়ালা মস্তক এনগ্রেভ করা বেল্টের চকচকে সিলভার বাকলটি ব্রাশ করতে করতে জানান, ক্রুজে অলস সময় কাটানো তার পছন্দ নয়। সব সময় কিছু না কিছু হাতের কাজ নিয়ে আছেন। চমত্কৃত হই তার বেল্ট-বাকলের ভেতরে খোদাই করা একটি গুপ্তকুঠুরি দেখে। চোখে ঝিলিক তুলে ফিসফিসিয়ে ব্র্যানডন বলেন, ‘ফর পার্সোনাল কনজাম্পশন ওনলি।’ আন্দাজ করি, এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে ভেসে বেড়ানোর সময় ইনি অল্পবিস্তর আবগারি আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেন না।
ব্র্যানডন মারফির সঙ্গে কাউবয় কালচার নিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতে এসে ঢুকি উইন্ড জ্যামার নামে একটি রেস্তোরাঁয়। আধ–ডজন কাউন্টারে একসঙ্গে ডিসপ্লে করা হয়েছে বুফে লাঞ্চের বেশুমার খাদ্যসম্ভার। আহার্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে শত শত খানেওয়ালাদের ছোটাছুটি। বারটেন্ডাররা তৃষিতদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ক্ষুধা উদ্রেককারি পানীয়। আমি এ হট্টগোলে বিচ্ছিন্ন হই ব্র্যানডনের সঙ্গে। আর অধিক আহারে ভূড়ি সম্প্রসারণের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্নও হই বিগতভাবে। পাস্তার প্লেটে আধ-ডজন শুঁড়ওয়ালা গলদা চিংড়ির পশরা সাজিয়ে ব্র্যানডন এসে আমার কাঁধে চাটি মেরে বলেন, ‘হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর? গো অন ম্যান। ডিগ ইন।’
বিস্তর ভেবেচিন্তে ফিগার মেনটেইন করার দৃঢ় অঙ্গিকার নিয়ে আমি স্যুপ কাউন্টারের দিকে রওয়ানা হই। রোস্টেড বিফের বারকোশের সামনে কালোকোলা শীর্ণকায় এক ব্যক্তি হালকা চালে ড্যান্স করছেন। সংযত নৃত্যের তালে তালে তার কাঁধে দুলছে রঙজ্বলা সাটিনের কাপড়ে তৈরি বিচিত্র একটি পাখি। ঠিক বুঝতে পারি না, এ বান্দার আচমকা আনন্দে মতোয়ারা হওয়ার কারণ কী।
সাত-পাঁচ ভেবে গাসপাচো স্যুপের সঙ্গে এক টুকরা কর্নব্রেড নিয়ে চেষ্টা করি কোথাও বসতে। পাওয়া যায় খালি একখানা চেয়ার। উল্টোদিকে বসে একটু আগে নজরে পড়া আত্মহারা হয়ে ড্যান্স করা বান্দা। বসতে চাইলে ইশারায় আমার অনুরোধ মঞ্জুর করে তিনি নজর দেন, সংগৃহীত আহারের একাধিক ডিশে। খাবারের বহরের দিকে তাকিয়ে আমার আঁতকে ওঠার অবস্থা হয়! শীর্ণকায় মানুষটির পাকস্থলি বিরাট হওয়ার সম্ভাবনা কম। ঠিক বুঝতে পারি না এতগুলো আইটেম ওখানে অ্যাকেমোডেট করবেন কীভাবে?
তো নামটাম বলে চেষ্টা করি পরিচিত হওয়ার। কোস্তারিকা থেকে আগত এ ভদ্রসন্তানের নাম জালেকুল আলবারো সাবেরিও। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে ইনি আফ্রো-কোস্তারিকান, অর্থাৎ উনার পূর্বপুরুষেরা এক জামানায় ক্রীতদাস হিসাবে এসে পৌঁছেছিলেন ক্যারিবীয় কোনো দ্বীপে, অতঃপর কালক্রমে থিতু হন কোস্তারিকায়। পেশা হিসাবে জালেকুল ড্যান্স ইন্সট্রাকটার। সচরাচর টিনএজারদের মেরেঙ্গে কিংবা সালসা ড্যান্সের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। জানতে চাই, ‘কাঁধে পাখিমতো প্রাণীটি কী?’ চোখ দুটি লক্ষ্মীপেঁচার মতো বৃত্তাকার করে তিনি জবাব দেন, ‘ফ্লাইং ড্রাগন।’ না বলে পারি না, ‘ড্রাগন দেখতে এ রকম হয় নাকি?’ বিরক্ত হয়ে জবাব দেন, ‘দিস ইজ মাই পার্সোনাল পেট। আমার পোষা ড্রাগনটিকে আমি নিজে তৈরি করেছি। ডু ইউ হ্যাভ আ প্রবলেম উইথ দিস?’ উত্তর শুনে আমি খামোশ মেরে যাই।
প্রচুর পরিমাণে গো–মাংস ও কয়েক খাবলা ম্যাশ পটেটো ভক্ষণ করে জালেকুলের ফের কথা বলার বাসনা হয়। তিনি আইফোনের পিকচার গ্যালারিতে ক্লিক করে দেখান হরেক রকমের কাপড় দিয়ে পুতুলের মতো করে তৈরি বেশ কতগুলো খানিকটা কাল্পনিক পশুপাখির আলোকচিত্র। বুঝতে পারি, এগুলো কমফোর্ট অ্যানিমেল হিসাবে পরিচিত। কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কিংবা পশমে হাত বুলিয়ে আদর করলে প্রশমিত হয় স্ট্রেস। জানতে চান জালেকুল, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট ওয়ান?’
স্যুাটকেসভর্তি কমফোর্ট অ্যানিমেল নিয়ে তিনি জাহাজে চড়েছেন। চাইলে আমি হ্রাসকৃতমূল্যে একটি খরিদ করতে পারি। তার পিকচার অ্যালবামের নকশা পছন্দ না হলে আমার মর্জিমাফিক ডিজাইনেও তিনি একটি কমফোর্ট অ্যানিমেল তৈরি করে দিতেন পারেন। দাম আহামরি কিছু না। ভাবি, জালেকুলকে দিয়ে একটি হাঁসজারু তৈরি করিয়ে নিতে পারলে তা কাঁধে করে উদ্বেগমুক্ত হালতে ঘুরে বেড়ানো যায় বইমেলা কিংবা চিত্রপ্রদর্শনীতে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার দেহমনে স্ট্রেস এতো কম যে স্রেফ খরচটা ঠিক জাস্টিফাই করতে পারি না। তো ‘আই উইল থিংক অ্যাবাউট ইট, জালেকুল,’ বলে উঠে পড়ি।
সুইমিংপুলের কাছেই চমত্কার একটি ব্রিজ দিয়ে যাওয়া যায় জাহাজের স্টারবোর্ড–সংলগ্ন ডেকে। ইস্পাতের খাম্বা পেঁচিয়ে ঘোরানো একটি সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করি ইস্পাতের সাঁকোটিতে। ভোকাল মিউজিকের ঝংকৃত লিরিক ও নৃত্যের তালে তালে স্টেপ ফেলার শব্দে সচকিত হয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাই। ওপরের লেয়ারে বৃত্তাকার একটি প্ল্যাটফর্মে মাইক্রোফোনের মাউথপিসওয়ালা একজন গায়ককে ঘিরে প্রবল জোশে ড্যান্স করছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত কয়েকটি যুবক ও যুবতী। তো সিঁড়ি থেকে নেমে ভিন্ন পথে চেষ্টা করি স্টারবোর্ডে পৌঁছতে।
ক্রুজ বোটের রিডিং কর্নার, ব্রিজ ও ওপেন এয়ার বার
লিফটে উঠে পড়ি ডেকের এক ধাপ ওপরে। দেখি, চলে এসেছি ব্রিজের কাছাকাছি। এখানে পাওয়া যায় দরিয়ার দুর্দান্ত ভিউ। ক্যামেরাটি বের করে ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখছি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উচ্চারণে কোনো এক নারী বলে ওঠেন, ‘ওয়াও, আ রিয়েল ক্যামেরা। হ্যাভন্ট সিন ওয়ান ফর আ হৌল ডেকেইড। কুল!’ বিদ্রূপে বিরক্ত হয়ে চোখ তুলে তাকাই। রোদচশমা পরা এক নারী ব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যস্নানে তামাটে হচ্ছেন। কথা বলেন তিনি ফের, ‘ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা…রিয়েল ওল্ড স্কুল। দেখাই তো যায় না আজকাল।’ কিছু বলতে হয়, তাই অনুরোধ করি, ‘উড ইউ মাইন্ড ব্লেসিং মাই ক্যামেরা উইথ আ পিকচার?’
কোনো দ্বিধা না করে রাজি হন তিনি আমার আদনা ক্যামেরাটিকে মহিমান্বিত করতে। স্ন্যাপশট নেওয়া হলে পরে জানতে চাই, ‘হোয়াট আর ইউ আপ টু হিয়ার অন দি ব্রিজ?’ বিচিত্র একটি তথ্য দেন ইনি। এনচ্যান্টমেন্ট অব দি সিজ নামক জাহাজটি আকারে ছোট বিধায় গেল বছর এর লেজের দিকে আরেকটি জাহাজের অংশবিশেষ জোড়া দিয়ে বাড়ানো হয়েছে প্যাসেনজার্স ক্যাপাসিটি। দুটি ভিন্ন অংশের মধ্যে যোগসূত্র হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন এ ব্রিজটি, যা মূলত দাঁড়িয়ে আছে সরাসরি জলের ওপর। এত কিছু জেনেও কিন্তু ভর দুপুরে রোদ–ঝলসানো সাঁকোতে তার দাঁড়িয়ে থাকার পারপাস আমার অজ্ঞাতই থেকে যায়। বাধ্য হয়ে ফলোআপ প্রশ্ন করি।
জবাবে মহিলা ফের গল্প ফাঁদেন। ক্যাফেতে নাকি শুনেছেন, ব্রিজের এ ভিউপয়েন্ট থেকে লোনাজলের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভেসে ওঠছে তিমিমাছ। তাকে সন্তুষ্ট করতে বাইনোকুলারে চোখ রেখে আমি তাকাই ঊর্মিমুখর জলের সারফেসে। কিছু তরঙ্গ ক্রনিক অ্যাজমায় ভোগা মানুষের ক্রমাগত শ্বাসাঘাতের মতো কেবলই ফিরে ফিরে আসছে চলমান জাহাজের দিকে। বলি, দুপুরে ভরপেট ভোজনের পর তিমি-পরিবার ছানাপোনাসহ একটু সিয়েস্তা বা ভাতঘুমে জিরিয়ে নিচ্ছে। ‘প্লিজ ট্রাই ইন দ্য টোয়াইলাইট আওয়ার। গোধূলিতে এরা হয়তো বেরোবে সান্ধ্যভ্রমণে।’ কাষ্ঠহাসি হেসে তিনি বলেন, ‘হোপ ইউ আর রাইট, বাট ইয়োর কমেন্ট ইজ রিয়েলি ফানি দো।’ ‘সি ইউ অ্যারাউন্ড,’ বলে বিদায় নিই।
ব্রিজ থেকে কদম কয়েক এগোতেই দেখা হয় কাউবয় ব্র্যানডন মারফির সঙ্গে। পাঁচ-সেরি বাটখারার মতো দুহাতে দুটি এক্সারসাইজ বল নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন ইনি। আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ব্রিজে দেখলাম তোমাকে। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ব্রিজ ইজ আ পিকআপ পয়েন্ট। সো, ওয়াচ আউট, ম্যান।’ আমার দুগ্ধধবল মনে সন্দেহের এক ছিটে গোমূত্র ছিটিয়ে পাঁচ-সেরি বাটখারাসহ জগিং-পাথের দিকে হেঁটে যান ব্র্যানডন।
কিঞ্চিৎ বিবমিষা নিয়ে অতিক্রম করি একাধিক করিডোর। লিফট চড়ে ফের ওপরে উঠি। এমন কী মানচিত্রের রেখাচিত্রেও চোখ বোলাই, কিন্তু স্টারবোর্ডের পরিবর্তে এসে পৌঁছাই সম্পূর্ণ খোলামেলা অট্রিয়ামের মতো প্রশস্ত এক পরিসরে। এ দিকে ভীড়বাট্টা নেই একেবারে। কোনো যাত্রীকে টাইম কিল করার জন্য অ্যাক্টিভিটির তালাশে ম্যাপ হাতে ছোটাছুটিও করতে দেখি না। খুঁজে পাই আধখানা চাঁদের মতো বাঁকানো একটি বেলকনি। রেলিং ধরে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাতেই দেখি, লাইভ মিউজিকের বারোয়ারি থানে খালি পড়ে আছে স্টেজ। তার সিঁড়িতে বসে ছোট্ট একটি ছেলে। আর ড্যান্সিং স্পেসে এলোপাথাড়ি নৃত্য করছে তিনটি মেয়েশিশু। চুপচাপ দাঁড়াই কিছুক্ষণ।
মনে ফিরে আসে অত্যন্ত জরুরি, তবে আপাত নিগেটিভ একটি তথ্য: গড়পড়তা একটি ম্যামথ সাইজের ক্রুজ বোট নিত্যদিন পোড়ায় ২৫০ টনের মতো জ্বালানি তেল। এ ধরনের জাহাজগুলো বর্জ্য ফেলে দিয়েও বিষাক্ত করে তুলছে সমুদ্রজল। ক্যারিবিয়ান ক্রুজের লাগাতার জাহাজ চলাচলের কারণে হামেশা নিঃসৃত হচ্ছে গ্রীন হাউস গ্যাস। জখম হচ্ছে কোরাল রিফ বা প্রবালের দৃষ্টিনন্দন ফর্মেশন। পরিবেশের এ ধংসযজ্ঞে নিজের মেহনতে অর্জিত কড়ি খরচ করে শামিল হওয়ার অপরাধকে জাস্টিফাই করতে পারি না। ভাবি, গিল্ট ফিলিং অবশ্যই আমার প্রাপ্য।
বিং আওয়াজে আইফোনটি ম্যাসেজ মারফত জানায় যে আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হওয়া সহযাত্রী মিসেস মার্শা অ্যাংস্টর্ম রিডিং কর্নারে এসে বসেছেন। বেশ কিছু টাকাপয়সার বিনিময়ে শ্যানন একটি অ্যাপস আইফোনে ইন্সস্টল করে দিয়ে আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে যেসব যাত্রী অপরিচিত কারো সঙ্গে পরিচিত হতে এবং নিজের জীবন সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে আগ্রহী, তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। মিসেস মার্শা অ্যাংস্টর্ম ১৯৭০ থেকে ’৭২ সাল অব্দি আফগানিস্তানের কাবুল শহরে পিস কোর নামে একটি সংস্থার তরফে স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। যেহেতু ওই ধরনের কাজে আমিও সফর করেছি কাবুল একাধিকবার, সুতরাং তিনি আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে রাজি হয়েছেন। অ্যাপস মারফত আমরা পরস্পরের বায়ো সম্পর্কেও অবগত হয়েছি। হাতে মিনিট বিশেক সময় আছে। সুতরাং জাহাজের মানচিত্রের দিকে নজর দিয়ে রিডিং কর্নারের পা চালাই ।
এসে পড়ি ইন্টারনেট চেক করার জন্য একাধিক কম্পিউটারে সজ্জিত কাউন্টারে। ওই পরিসরের লাগোয়া পাজল মেলানোর পুরো দস্তুর ফ্যাসিলিটি। ওখানে নিরিবিলি বসে শ্রীমান জালেকুল চেষ্টা করছেন পাজোলের পিসগুলো জোড়া দিয়ে অর্থপূর্ণ কিছু গড়তে। আমাকে দেখতে পেয়ে আওয়াজ দেন, ‘বসে পড়ো। পাজলস আর গুড ফর ব্রেন। চিন্তাশক্তিকে ধারালো করার ক্ষেত্রে পাজলের বিকল্প কিছু নেই।’ এ মুহূর্তে ক্রুজ বোটে চড়ে গ্রীন হাউস গ্যাস বৃদ্ধিতে শরিক হওয়ার কারণে ভুগছি গিল্ট ফিলিংয়ে। তা থেকে তৈরি হচ্ছে দুশ্চিন্তা। এটাকে শার্প করে নেওয়াটা হবে মূর্খতার শামিল। সুতরাং প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়ে বলি, ‘তুমি রাজি থাকলে বলো, আমি বরং তোমার ফ্লাইং ড্রাগনসমেত একটি ছবি তুলে নিই।’ খুশিমুখে চোখজোড়া চারআনি রসগোল্লার মতো গোলাকার করে পজ দেন জালেকুল।
রিডিং কর্নারের শেলফগুলোতে মানসম্পন্ন বইপত্রের সংখ্যা কম। তবে আরামসে বসে জিরোনোর জন্য রাখা আছে হরেক রকমের সোফা ও রকিংচেয়ার। টিপয়গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে ফ্যাশন ম্যাগাজিন, সেইলিং ও হর্সরাইডিং বিষয়ক গ্লসিপেপারে মুদ্রিত রঙচঙে ম্যাগাজিনাদি। এককোণে আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে চোখমুখ সংবাদপত্রে সম্পূর্ণ ঢেকে রিল্যাক্স করছেন সিগারহাতে এক পুরুষ। জীবিত নন ইনি, প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি মূর্তিবিশেষ। একে ছাড়িয়ে বেশ খানিক দূরত্ব বজায় রেখে আর্মচেয়ারে বসে মিসেস মার্শা অ্যাংস্টর্ম। গাঢ় মনোযোগে অত্যন্ত সিনিয়র এ ভদ্রমহিলা বৃত্তাকার একটি হুপে সাঁটা কাপড়ে এমব্রয়ডারি করছেন। তার সামনে ওয়াকারের ওপর পড়ে আছে সেলাই–ফোঁড়াইয়ের সরঞ্জাম।
কাঁটায় কাঁটায় পাঁচ মিনিট আগে এসে রিডিং কর্নারে পৌঁছেছি। সুতরাং সিগারওয়ালা মূর্তিটির পাশে বসে অপেক্ষা করি। আর এ সুযোগে মিসেস অ্যাংস্টর্মকেও অবজার্ভ করি। তাঁর প্রগাঢ় কনসেনট্রেশন অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে ফিরিয়ে আনে বতসোয়ানার কালাহারি ডেজার্টে সাফারির স্মৃতি। চুপচাপ বসেছিলাম অকাবাংগো ডেল্টার চিতাবে-লেদিবা গেইম রিজার্ভের একটি অবজার্ভেশন টাওয়ারে। চোখের সামনে দীর্ঘ ঘাসের ঘন বিন্যাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে উঁইপোকার বেশ কতগুলো ঢিবি। একটির আবডাল থেকে মা-চিতা শিকারের তালাশে হামাগুড়ি দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে আগাচ্ছে। বাইনোকুলারে তার মুখে ফোকাস করে আছি। পলক পড়ছে না মাদি জন্তুটির দুচোখে। একটি বোলতা উড়ে এসে অবলীলায় পান করে চিতাবাঘের চোখের জল। তাতেও কিন্তু প্রাণীটির কনসেনট্রেশনের ঘাটতি পড়ে না। আমি গাঢ় কনসেনট্রেশনে সুঁইসুতোয় ফুল–তোলা মিসেস অ্যাংস্টর্মের মুখের অভিব্যক্তিকে নিরিখ করি। তাঁর চোখেমুখে প্রবল কৌতূহলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা। মুখমণ্ডলে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে জীবাশ্মে ছাপ এঁকে বিলুপ্ত হওয়া আদিযুগের কোনো মাকড়সার মতো বয়সের বলিরেখা।
সেলফোনের বিং শব্দে সচকিত হয়ে মিসেস অ্যাংস্টর্ম চেষ্টা করেন উঠে দাঁড়ানোর। খানিক কুঁজো মানুষটি ঘাড় বাঁকাতেই দেখতে পান আমাকে। আর স্মীতহাস্যে ভরে ওঠে তাঁর মুখমণ্ডল, ‘হিয়ার ইউ আর সুলতান, ওয়েটিং পেশেন্টলি।’ এগিয়ে গিয়ে আমি বলি, ‘আপনি তো কাবুলে বছর দুয়েক কাজ করেছেন। হাউ গুড ইজ ইয়োর দারি ল্যাঙ্গুয়েজ?’
কপাল কুঁচকে মহিলা চেষ্টা করেন আমার উদ্দেশ্য বুঝতে। তবে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘মুলাকাতে সোমা খুশ হাস্ত,’ বা ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’ সাক্ষাৎ হওয়াতে আমিও যারপরনাই খুশি হয়েছি। বাড়িয়ে দেওয়া হাতে আফগানি কায়দায় চুমো খেয়ে এমব্রয়ডারির দিকে নজর দিয়ে মন্তব্য করি, ‘সুঁইসুতোয় আপনি গুলদোজির নকশা তুলছেন।’ জবাব দেন, ‘ইয়েস, আই লাভ দ্য আফগান স্টাইল অব এমব্রয়ডারি…গুলদোজি। তবে এখন কাবুলের স্মৃতি ঘাঁটতে ইচ্ছা হচ্ছে না, স্যরি।’
একটু ভেবেচিন্তে প্রশ্ন করি, ‘আপনার বায়োতে দেখলাম কেলিফোর্নিয়ার ওয়াইল্ডফায়ার সংক্রান্ত একটি ট্র্যাজেডির উল্লেখ করেছেন। উড লাইক টু ইলাবরেট অন দিস?’
সেলফোনের স্ক্রিনে দাবানলের বেশ কতগুলো ছবি স্ক্রল করে দেখাতে দেখাতে তিনি কথা বলেন। বছর চারেক আগের কথা। বাস করছিলেন কেলিফোর্নিয়ার পাহাড়ি এলাকায় নিজের বসতবাড়িতে। কাঠের ছোট্ট কটেজটি তামাম জিন্দেগির সঞ্চয়ের বেশির ভাগ ব্যয় করে তৈরি করিয়েছিলেন। ওখানে বুড়সুড়ো একজন মহিলার বসবাসে কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। তারপর তুমুল দাবানলের ঘটনাটি ঘটল। আশপাশের আবাসিক এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল আগুন। শত শত গৃহহীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। চালু হয়েছে একটি ক্লিনিক। পেশায় নার্স মিসেস অ্যাংস্টর্ম স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করছেন ওখানে। চিকিত্সা করছেন ধোঁয়ার কারণে বেড়ে যাওয়া হাঁপানি রোগের, যারা বাড়ি ছেড়ে আসার সময় সঙ্গে করে ওষুধবিষুধ নিয়ে আসতে পারেননি। তৈরি করে দিচ্ছেন তাদের জন্য ব্যবস্থাপত্র।
সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরতে গিয়ে দেখেন তাঁর এলাকাতে পড়েছে রোডব্লক। ফায়ার ফাইটাররা হোসপাইপ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হচ্ছে পানি। জানতে পারেন, ফিরতে পারবেন না নিজ ঘরে। কারণ তার কাঠের কটেজটি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। থাকতে হয়েছিল শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘদিন। বীমা কোম্পানি পেপার ওয়ার্কে ছোট্ট একটি ত্রুটির অজুহাতে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে। একমাত্র ছেলের মৃত্যু হয়েছে ক্যান্সারে, এগারো বছর আগে। ছেলের বউ ফের বিয়ে করে সংসার পেতেছে। সে-ই ছোটাছুটি করে প্রথমে পোড়া ভিটেমাটি বিক্রি করে ওই পয়সায় তাঁকে অতঃপর ব্যবস্থা করে দেয় অ্যাসিস্টেড ফ্যাসিলিটি বা বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসের। ওখানে একাকী দিন যেন কাটতেই চায় না, তাই প্রতি বছর একবার করে ক্রুজে আসেন। চলাফেরার জন্য ভরসা করেন ওয়াকারের ওপর। তাই জাহাজ কোনো বন্দরে ভিড়লে কোথাও ট্যুর করতে যেতে উত্সাহ পান না। তবে ক্রুজে প্রতিবারই কারো না কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কথাবার্তা বলার জন্যও জুটে যায় আগ্রহী দুয়েকজন মানুষ।
‘ডু ইউ মাইন্ড লুকিং অ্যাট দি পিকচার্স অব মাই বিলাভেড হাউস?’ বলে মিসেস অ্যাংস্টর্ম সেলফোনের স্ক্রিনে দেখান, জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া কাঠের কটেজটির আলোকচিত্র। দোরগোড়ার ওপর প্রথম বন্ধনীর মতো বাঁকানো এক চিলতে বেলকনি। বাঁধানো দাঁতে স্নিগ্ধ হেসে তিনি মন্তব্য করেন, ‘দিস ওয়াজ মাই জুলিয়েট বেলকনি। ওখানে আমি বিকেলে দাঁড়িয়েছি বহুবার, কিন্তু জোটেনি কোনো রোমিও।’ আলটপকা বলে বসি, ‘দ্যাট ওয়াজ আ মিসড অপরচুনিটি।’
ভুরু কুঁচকে ফের আমাকে নিরিখ করে তিনি এবার দেখান তাঁর সিটিংরুমের ছবি। দেয়ালে অ্যাপোলো-১১–এর চন্দ্রে অবতরণের পোস্টার সাঁটা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন বিলাতের রক ব্যান্ড বিটলসখ্যাত জন লেনন ও ইয়োকো ওনো। নিচে লেননের কণ্ঠে গীত অনবদ্য লিরিকের একটি ছত্র, ‘গিভ পিস আ চান্স…।’ দেয়ালচিত্রের তলায় বড় বড় হরফে ‘ওয়ার ইজ নট দ্য অ্যানসার’ স্লোগানের ইমেজটিও অবধারিতভাবে আমার মনে ফিরিয়ে আনে শৈশবে শোনা যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামযুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের প্রসঙ্গ। মনে হয়, খুঁজে পেয়েছি আজ সে যুগের একজন মানুষকে। বাড়িয়ে দেই হাত। মুঠোয় ধরেন তিনি আমার কব্জি।
প্রসঙ্গ বদলিয়ে মিসেস অ্যাংস্টর্ম এবার জানতে চান, ‘উড ইউ বি ইন্টারেস্টেড টু হ্যাভ ডিনার উইথ মি?’ ‘ওহ, ইয়েস,’ বলে প্রস্তাবটি কবুল করতেই তিনি বলেন, ‘দেন কাম অ্যাট সেভেন থার্টি। মাই ফেয়ার লেডি নামে একটি রেস্তোরাঁয় আমি টেবিল রিজার্ভ করে রাখব।’ বলি, ‘ঠিক নিচের ফ্লোরের প্রেক্ষাগৃহে বিকাল চারটায় দেখানো হবে পুরানো দিনের ফিল্ম রোমান হলিডে। উড ইউ লাইক টু জয়েন মি ফর ভিউয়িং দিস অ্যাজ ওল্ড মুভি?’
চোখমুখে চাপা কৌতুক ফুটিয়ে জবাব দেন, ‘হেল নো, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড টু গেট এক্সাইটেড উইথ সেকেন্ডহ্যান্ড ইমোশন।’ কিছু বলি না। তবে আঁড়চোখে রিস্টওয়াচের দিকে তাকাই। ‘সি ইউ অ্যাট সেভেন থার্টি,’ বলে মৃদু হাসেন মিসেস অ্যাংস্টর্ম। ‘গুডবাই ফর নাউ,’ বলে উঠে পড়ি আমি।
মিনিট বিশেকের মধ্যে আটতলার ডেকে অনুষ্ঠিত হবে লাইফবোট সংক্রান্ত ওরিয়েন্টেশন। এ অ্যাক্টিভিটিটি নৌযাত্রীদের জন্য ম্যান্ডেটরি, তাই রওয়ানা হই ওইদিকে। পাওয়া যায় কাঠের প্রশস্ত সিঁড়ি। তার গোড়ায় একহারা গড়নের বাহারে হ্যাট মাথায় শৌখিন প্যারাসল জাতীয় ছাতা হাতে এক মেমসাহেবের লাইফ-সাইজ ভাস্কর্য। ভাবি, হরেক অ্যাংগল থেকে মূর্তিমতি বিবিটির একাধিক ছবি তুলব। কিন্তু একবার স্ন্যাপশট নিতেই মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। দেখি, ধবধবে সাদাচুলো এক বৃদ্ধ লাঠি ঠুঁকে ঠুঁকে সিঁড়ির নিশানা খুঁজছেন। অ্যাপসে কথা বলতে আগ্রহীদের তালিকায় ইনার ছবি দেখেছি। তো এগিয়ে গিয়ে বলি, ‘মে আই হেল্প ইউ, স্যার?’ ততক্ষণে যষ্টির অগ্রভাগ দিয়ে তিনি স্পর্শ করেছেন সিঁড়ির প্রথম ধাপ। তার মুখ থেকে ছিটকে আসছে আকণ্ঠ শরাব পানের নোনা–মিঠে গন্ধ।
দেবদূতের নিষ্পাপ ভঙ্গিতে হেসে আমার প্রশ্নের জবাব দেন বয়োবৃদ্ধ, ‘নট রিয়েলি, বাট অ্যাপ্রিশিয়েট ইয়োর অফার। আর ইউ অ্যান ইন্ডিয়ান বাই অ্যানি চান্স?’ নিজ দেশের নাম উল্লেখ করে পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘আই গেস, ইউ আর ফ্রম সাউথ আফ্রিকা। সাউথ আফ্রিকার কোথাকার লোক আপনি?’ ব্লক হওয়া টেপে হঠাৎ করে তোড়েজোরে পানি আসার মতো খুলে যায় সফেদ-চুলো বৃদ্ধের বাতচিত করার উত্সমুখ। জেকোবাস বসহপ নামে এ শ্বেতাঙ্গ বুয়ার গোত্রের মানুষটির আদিনিবাস সাউথ আফ্রিকার অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের ব্লুমফোনটেইন নগরে। চোখে অত্যন্ত কম দেখেন, তবে সম্পূর্ণ অন্ধ নন। ছোট হরফে লেখা কিছু পড়তে পারেন না। তাই অন্ধদের জন্য ডিজাইন করা আইফোন ব্যবহার করেন।
সিঁড়ি ভেঙে আস্তে-ধীরে আমরা অতঃপর উঠে আসি পাঁচতলায়। ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে মি. বসহপের দিনযাপনের নানা কিছু। সাউথ আফ্রিকার মিলিটারিতে কাজ করেছেন অনেক বছর। তখনও পাশের দেশ নামিবিয়া শ্বেতাঙ্গ সাউথ আফ্রিকার উপনিবেশ। ওখানকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজন মেতেছেন মুক্তির মরণপণ লড়াইয়ে। চলছে গেরিলা কায়দায় চোরাগোপ্তা হামলা। সামরিক আউটপোস্টের অবজার্ভেশন টাওয়ারে বসে বাইনোকুলারে তাবৎ কিছুতে নজর রাখার কাজ ছিল জেকোবাস বসহপের। না, নিজে কাউকে খুন–জখম কিছু করেননি তিনি। তবে তার স্পট করা টার্গেটে স্নাইপারদের গুলি ছুড়তে দেখেছেন অজস্রবার। ১৯৯০ সালের দিকে পঁচিশ বছরের গেরিলা যুদ্ধের পর নামিবিয়ার স্বাধীনতা হাসিল হলে চাকুরীচ্যুত হন মি. বসহপ।
কয়েক বছর পর দ্বিতীয়বার পারস্য উপসাগরে লড়াই বাঁধলে কাজ পান যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে। ডেপ্লয়েড হয়েছিলেন ইরাকের অভ্যন্তরে একটি সেনাছাউনিসংলগ্ন অবজার্ভেশন টাওয়ারে। কাছেই ছিল ইনফারনো নামে সৈনিকদের কাছে পরিচিত একটি ফায়ারপিট, যাতে অষ্টপ্রহর জ্বলত আগুন। পুড়ে ভস্ম হতো অকেজো অস্ত্রশস্ত্র, হরেক ধরনের কম্পিউটার ও রসায়নিক বর্জ্য। এতে উত্পন্ন হতো প্রচুর টক্সিক ধোঁয়া, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাঁর দৃষ্টিক্ষমতা। নিজের প্রায়-অন্ধত্ব সম্পর্কে নির্লিপ্তভাবে মন্তব্য করেন, ‘লুক, আই হ্যাভ সিন এনাফ। নাউ পারহ্যাপ্স আই ডিজার্ভড টু বি হাফ-ব্লাইন্ড।’ পাঁচতলায় বিদায় নিতে যান জেকোবাস বসহপ। আমার কব্জিতে চাপ দিয়ে বলেন, ‘তুমি তো আটতলায় যাচ্ছ। ওখানকার খোলামেলা ডেকে আছে ছোট্ট একটি ওপেন এয়ার বার। দে মেক কিলার মার্টিনি। চেখে দেখো। ইউ ইউল ফিল লাইফ ইজ নট দ্যাট ব্যাড অ্যাট অল।’
আটতলার ডেকে ক্রুজকর্মী দীর্ঘাঙ্গী এক তরুণীকে ঘিরে জড়ো হয়েছেন। জাহাজের একই ফ্লোরে কেবিন পানেওয়ালা কয়েকজন যাত্রী। সুদর্শন মেয়েটির বোধ করি কোনো কারণে মেজাজ তেড়িয়া হয়ে আছে। তার লেপেলে পরা সিলভারের ব্রোচে পড়েছে সূর্যের কিরণ। তাতে ঝিলমিলিয়ে উঠছে ডানাওয়ালা হিপন্ড, যার মধ্যিখানে মিনা করে আঁকা চাঁদতারার মিনিয়েচারচিত্র। বলকান অঞ্চলের সুফিমার্গের পরিচিতিবাহক এ প্রতীকের সঙ্গে আমি পরিচিত। তাই চেষ্টা করি তাকে স্টাডি করতে। কায়ক্লেশে সে চোখমুখে শ্বেতপাথরের প্রতিমার মতো নিরাসক্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে পয়েন্টার দিয়ে দেয়ালজোড়া শেলফে সাজিয়ে রাখা লাইফবোটগুলো দেখায়। তারপর আনুনাসিক উচ্চারণে বর্ণনা করে যায়, জাহাজডুবি হলে সর্বত্র ছোটাছুটি না করে আমরা যেন অনুগ্রহ করে এখানে চলে আসি। কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে কীভাবে লাইফবোট ভাসাতে হয় তাও হাতে–কলমে দেখিয়ে মুখখানা ফের কষাবিসা করে ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষায় ধন্যবাদ দিয়ে সে আলোচনার ইতি টানে।
নৌযাত্রীরা লাইফবোট ওরিয়েন্টেশনের পর কোনো প্রশ্নাদি না করে ফিরে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। রাগী স্বরে চমত্কার গ্রীবাটি বাঁকিয়ে সে সওয়াল করে, ‘ডু ইউ হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন অ্যাবাউট লাইফবোট?’ জবাব দিই, ‘নো, মাদমোয়াজেল। আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড টু আস্ক ইউ আ কোয়েশ্চেন?’ এবার তার চোখেমুখে ক্রোধ আর চাপা থাকে না। তেড়িয়া হয়ে রিয়্যাক্ট করে, ‘হোয়াট দ্য হেল ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট মি?’ মনে মনে ভাবি, জাহাজডুবি হলে এর নৌকায় চাপাটা হবে রিস্কি। তবে মুখে মিনমিনিয়ে বলি, ‘আই হ্যাভ আ প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল কোয়েশ্চেন, মিস। হোয়াট কান্ট্রি আর ইউ ফ্রম?’
হঠাৎ করে সে যেন যেন ফিরে পায় তার পেশাদারি কম্পোজার বা আত্মস্থতা। চোখেমুখে আবার ফিরে আসে প্রতিমাশোভণ অভিব্যক্তি। নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়, ‘আলবেনিয়া।’ সঙ্গে সঙ্গে আমি তার পিতৃভাষায় তাকে শুভেচ্ছা জানাই, বলি, ‘পারসেন্দাতিয়া।’
ভ্রূকুটিতে রাজ্যের সন্দেহ ফুটিয়ে তুলে সে জানতে চায়, ‘হাউ ডু ইউ নো দিস ওয়ার্ড?’ বলি, আমি পাশের দেশ কসোভো ও মেসিডোনিয়াতে আলবেনিয়ান কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করেছি অফ অ্যান্ড অন বছর দুয়েক। তখন মেসিডোনিয়া থেকে ট্রেনে চড়ে আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানাতে তিন দিনের জন্য যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ‘ওহ, রিয়েলি। মাই ফ্যামিলি লিভস ইন তিরানা,’ বলে তার দুচোখ বড় হয়ে উঠলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমি পরিচিত হই।
তিরানা থেকে ক্রুজ বোটে কাজ করতে আসা মেয়েটির নাম ফাতমিরে, সংক্ষেপে ফ্রিতা। জাহাজের জুনিয়র কর্মী হিসাবে মাসে মাত্র একবার সে ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। তখন দেশে টেলিফোন করতে পারে। অফ আওয়ারে অবশ্য উচ্চমূল্যে অ্যাপস কিনে ইন্টারনেটে অ্যাকসেস করা যায়, কিন্তু ফাতমিরে আর্থিকভাবে সাপোর্ট করছে চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত তার মা-বাবাকে। দুজন ভুগছেন দোরারোগ্য ব্যাধিতে। মায়ের ডিমেনশিয়া দিনকে দিন প্রবল হচ্ছে। স্ট্রোকের পর বাবারও চলত্শক্তি সীমিত। তো মাইনার বিরাট অংশ ব্যয় করে তাকে রিং করতে হয় হামেশা।
একসঙ্গে আমরা ডেকের প্রান্তিকের দিকে হাঁটি। ফাতমিরে জানতে চায়, ‘হাউ ওয়াজ ইয়োর ট্রিপ ইন তিরানা।’ জবাব দিই, ‘পুরো একটি দিন আমি কাটাই, তিরানা থেকে সামান্য দূরে, গামতি মাউন্টেনে ডে ট্রিপ করে। পরদিন আরও পাঁচ জন পর্যটকের মতো দেখতে যাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমরেড এনভার হোজার স্মৃতিতে তৈরি তিরানার পিরামিড। গামতি পাহাড়ে হাইক করে ক্লান্ত ছিলাম। তাই আর সিঁড়ি-টিড়ি ভেঙে ওপরে উঠিনি। তবে ফুটপাথে খুঁজে পেয়েছিলাম স্থানীয় ভাষায় লেখা মোল্লা নাসিরুদ্দীন হোজার একটি সচিত্র পুস্তক। পড়তে না পারলেও ছবি দেখে সকালটা আমার মন্দ কাটেনি।’
ফাতমিরে জানায়, মোল্লাজির গল্পের চিত্রওয়ালা বইটি তার বাবার খুব প্রিয়। সমাজতান্ত্রিক জামানায় এ পুস্তকের প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। হালফিল সকলে এটি পড়ছে। তার পরবর্তী প্রশ্ন হয়, ‘তিরানা শহরে বিকালে কী করেছ?’ জবাব দিই, ‘সুফি মার্গের বাকতাশি তরিকার দরবেশ বাবা মন্ডির খানকাতে বিকালটা বেশ ভালোভাবেই কাটে।’ জানতে চায়, ‘ডু ইউ ফলো বাকতাশি তরিকা?’ জানাই, ‘ওই মার্গ অনুসরণ না করলেও মেসিডোনিয়ায় কাজ করার সুবাদে তাদের তাকে বা খানকাতে বারকয়েক যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।’ অন্যমনষ্কভাবে সে বলে, ‘মাই ফ্যামিলি, আই মিন মাই পেরেন্টস আর সিরিয়াস বাকতাশি। তোমার কী হাজি এথেম বের মসজিদটি দেখার সুযোগ হয়েছিল?’ জবাব দিই, ‘ইয়েস, তিরানাতে নেমে প্রথমেই গিয়েছিলাম ওই মসজিদে। প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো মসজিদটির দেয়ালের ফ্রেস্কো সত্যিই অসাধারণ। ভালো লেগেছে বৃক্ষ, জলপ্রপাত ও ব্রিজের চমত্কার মোটিফগুলো।’ ফের কথা বলে সে, ‘আমার বাবা প্রতি শুক্রবারে হুইলচেয়ারে সাড়ে তিন মাইলের মতো পথ ডিঙিয়ে নামাজ পড়তে যান এথেম বে মসজিদে।’
খোলা ডেকের এদিকে পাওয়া যায় ছোট্ট একটি বার। একজন কৃষ্ণাঙ্গ বারটেন্ডার ফাতমিরেকে দেখতে পেয়ে, ‘হ্যালো ফ্রিতা, সুইট গার্ল, লুকিং অল লাভলি অ্যান্ড নাইস,’ বলে শুভেচ্ছা জানান। তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ফাতমিরে ওরফে ফ্রিতা। নাতলান্তা মামালোদি জোহানেসবার্গের মানুষ। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘মি. নাতলান্তা মেইকস সুপার্ব মার্টিনি। এখানে আসলেই আমার তৃষ্ণা পেয়ে যায়।’ আন্দাজ করি, ঠিক এই বারটির কথা মি. জেকোবাস বসহপ উল্লেখ করেছিলেন। প্রস্তাব করি, ‘ক্যান আই বাই ইউ আ ড্রিংক, ফ্রিতা?’ ‘হেল, নো,’ বলে সে সেলফোনে টাইম দেখে। বলে, ‘আই মাস্ট গো ব্যাক টু ওয়ার্ক।’ তারপর কী ভেবে বলে, ‘মি. নাতলান্তার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। অফ টাইমেও তার বারে আমি কিছু কিনতে পারি না। ইটস টু এক্সপেনসিভ ফর মি। আগামিকাল আমার ডে অফ। কোস্তা মায়াতে জাহাজ ভিড়লে সমুদ্রপাড়ে নেমে কোনো রেস্তোরাঁয় বসে পান করব পুরো এক জগ বিয়ার। গুড বাই নাউ।’ বলে ফিরে যায় ফ্রিতা তার ডিউটিতে।
কোস্তা মায়া
ধলপহরের ঠিক পর পর আমি তপ্ত কফির তালাশে চলে আসি জাহাজের ডেকে। কিছু নৌযাত্রী মনে হয় ডেকচেয়ারে শুয়ে-বসে গুজরে দিয়েছেন পুরো রাত। দুয়েক জন আস্তে-ধীরে আড়মোড়া ভাঙছেন। ট্রলি ঠেলে ঠেলে ঘুরছে শরাবওয়ালা। ক্রেডিটকার্ড পাঞ্চ করে কারো কারো হাতে তুলে দিচ্ছে আই-ওপেনার গোছের পানীয়। সমুদ্রজল থেকে উত্থিত মিস্ট বা বাষ্পের বিস্তারে পুরো ডেক ধূসর হয়ে আছে। কুয়াশার আর্দ্রতা মেখে আমি চলে আসি ডেকের প্রান্তিকে। সন্ধান পাওয়া যায় কফি-কার্টের। আচমকা কানে ভেসে আসে শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠস্বরে, ‘লেট মি কল ইউ সু-ই-ট-হা-র্ট/ আই অ্যাম ইন লা-ভ উ-ই-থ ই-উ-উ…।’ দেখি, চেয়ারে বসে চোখ মুদে গান করছেন মি. জেকোবাস বসহপ। টেবিলে সিরামিকের ডিশে পরিবেশিত হয়েছে এগ বেনেডিক্ট। ভাবি, আরেক দফা বাতচিতের সুযোগ হলে সাউথ আফ্রিকার এ বুয়ার বৃদ্ধকে সওয়াল করে জেনে নেব, ভাটি বয়সে সুইটহার্টের তালাশ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি কী?
চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়ে হাটবাজারে অপ্রত্যাশিতভাবে হেডমাস্টারের সাক্ষাতে লুকিয়ে ফেলা সিগ্রেটের মতো মি. বসহপের গলা থেকে উপে যায় সংবেদনশীল সংগীত। ধবধবে সাদা ন্যাপকিনে দাড়িগোঁফ থেকে শিশিরের আর্দ্রতা মুছে আওয়াজ দেন, ‘সিট ডাউন প্লিজ, আই থিংক আই শুড টেল ইউ দিস।’
‘গো অ্যাহেড, স্যার,’ বলে আমি উত্সাহ দিই। তিনি লিক্যুর ডিকেন্টারের মিনি জারটি উপুড় করে কফিতে মেশান অ্যালকোহলিক আরক। তারপর রাগী স্বরে বলেন, ‘আমার গ্র্যান্ড ডটার কাল রাতেও ইমেইলে আমাকে অ্যাকিউজ করল, আমি নাকি সারা জীবন কিলিং মেশিনের দোসর হয়ে কাটিয়েছি। নট ফেয়ার।’ ওয়েটার আমার সামনে এনে রাখেন এক মগ তপ্ত কফি। জাহাজ কোস্তা মায়াতে ভিড়তে যাচ্ছে। সারাদিনভর আমি মেক্সিকোর ইউকাতান পেনিনসুলার ছোট্ট এ বন্দরের আশপাশে মায়ান যুগের একাধিক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে কাটাব। দানাপানি জোটানোর মওকা মিলবে না হয়তো। তাই স্প্যানিশ অমলেট ও টোস্টের অর্ডার করি।
‘হোয়াট আই ডিড ইন নামিবিয়া অর ইন ইরাক—দিজ ওয়ার জাস্ট টু জবস। আই কিল্ড নো বডি। জীবনে ভালো কাজও তো করেছি অনেক।’ বলে ফের মি. বসহপ বাতচিতের সূত্রপাত করেন। নাশতাপানি শেষ হওয়ার আগেই জানতে পারি, তার মেয়ে যাকে বিয়ে করেছে সে আমেরিকান জামাতাটি কৃষ্ণাঙ্গ। তাদের সন্তান কলেজ–পড়ুয়া গ্র্যান্ড ডটার ব্রেন্ডা তাকে ইমেইল পাঠিয়েছে। কালকেউটের মতো ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘মাই সন-ইন-ল, দ্যাট টল অ্যান্ড স্ট্রং নিগ্রো, সে তার ডেভিল-শয়তানের মতো আলট্রা–হ্যান্ডসাম শরীর দিয়ে আমার লাভলি লিটল মেয়েটিকে জাদু করেছে।’
যান্ত্রিক শব্দের তোড়জোড়ে জাহাজটি এসে ভেড়ে কোস্তা মায়ার জেটিতে। কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়ি। কিন্তু কানে আসে, ‘আই হ্যাভ ডান সাম গুডওয়ার্ক অ্যাজ ওয়েল। এ সবকিছু তো বলার সুযোগই পেলাম না। নট ফেয়ার।’ ঘুরে বলি, ‘অ্যানাদার টাইম। সো লং নাউ।’ প্রেক্ষাগৃহে একসঙ্গে জ্বলে ওঠা বেশুমার বাতির মতো ডেকটির হরেক স্পটে ঝলমল করছে তরতাজা রোদ।
‘সি পাস’ বলে একখানা কার্ড দেখিয়ে নেমে পড়ি জাহাজ থেকে। জেটি বলতে সিমেন্টের সাদামাটা একটি প্ল্যাটফর্ম, যা বেশ দীর্ঘ সেতুর মতো কজওয়ে দিয়ে বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত। যেতে যেতে খেয়াল করি, উপকূলে পুরো দিনের জন্য এক্সকারশন করতে দলে দলে ছুটছেন নৌযাত্রীরা। তাদের চোখেমুখে তীর্থ করতে যাওয়ার উদ্যম। এদের অনেকেই ক্রুজ কোম্পানি মারফত ট্যুরের রীতিমতো প্যাকেজ খরিদ করেছেন। আমি এ ধরনের কোনো গ্রুপে শরিক হইনি। তবে শ্যানন খোঁজখবর করে জুটিয়ে দিয়েছে একটি প্রাইভেট ট্যাক্সি।
শ্যাননের কথা মনে আসতেই সামান্য দূরে তাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠি। বুটিদার গাউচা স্কার্টের সঙ্গে ক্রিম কালারের থ্রি–কোয়ার্টার টপে বেশ জাঁক করে সে সেজেছে। একা নয়। তার হাতটি মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কাউবয় পুরুষ ব্র্যানডন মারফি। চোখচুখি হতেই গুয়ামুরি হেসে ব্র্যানডন ঘোষণা করেন, ‘আই অ্যাম গোয়িং টু হ্যাভ আ হট ডেইট উইথ দিস লাভলি লেডি।’ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাউবয়ের ব্যাকসাইডে চাটি মেরে শ্যানন আওয়াজ দেয়, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, মারফি ইজ আ প্যাথোলজিক্যাল লায়ার।’ আমি ওয়েভ করি, তবে শ্যাননের সদ্য রিক্রুট গরু–রাখালটির সঙ্গে এখনই গুলতানি করতে বাসনা হয় না। সুতরাং না দাঁড়িয়ে, ‘গুড ডে টু বোথ অব ইউ’ বলে মেলট্রেনটি ধরার উদ্যমে দ্রুত ছাড়িয়ে যাই এদের।
যন্ত্রসংগীতের চমত্কার সেরেনাদে সচকিত হয়ে দেখি, সামনে জেটির প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঝংকারে নিমগ্ন এক হার্পবাদক। একটু দাঁড়াই। ফিরোজা রঙের সমুদ্রজলে তোলপাড় করে ফিরছে অনেকগুলো সুঁচালো ঠোঁটের নিডল ফিস। এক ঝাঁক ডোরাকাটা রঙিন মাছ মনে হয় হার্পের মূর্ছনায় ভেসে উঠে চলে এসেছে জেটির খুব কাছে।
আমি আগ বাড়তে বাড়তে ইউকাতান পেনিনসুলার মায়া কৌমের একাধিক লোকালয়–অধ্যুষিত অখ্যাত এ জেলেপল্লী কোস্তা মায়ার কথা ভাবি। ক্রুজে আসা ওশান লাইনারগুলোর কল্যাণে এ বন্দরটি পর্যটনে হালফিল ব্যাপকভাবে জমজমাট হয়ে ওঠেছে। আশঙ্কা জাগে, অথেনটিক পোষাক–আশাকে সজ্জিত মায়া গোত্রের মানুষজনের সাক্ষাৎ পাব কী? আমার মনষ্কামনা এত চটজলদি পূর্ণ হবে, নিজেকে অতটা ভগ্যবান ভাবিনি!
জেটিকে যুক্ত করা কজওয়ে বা দীর্ঘ ব্রিজের গোড়ায় বাণিজ্যিক একটি দালানের টেরাসকে রীতিমতো মঞ্চ বানিয়ে সনাতনি পোষাকাশাকে সজ্জিত মায়া গোত্রের তিন সন্তান হাত-পা নেড়ে নেড়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে ওয়েলকাম করছেন পর্যটক পঞ্চজনকে। তাদের শিরোভূষণে পাখির সত্যিকারের সুদীর্ঘ পালক বারবার দুলে উঠে ছড়াচ্ছে পুরাতাত্ত্বিক আবহ। মায়ান মন্দির কিংবা পিরামিডের দেয়ালে উত্কীর্ণ রিলিফে, অথবা খুঁজে পাওয়া পাঁচ-সাতশ বছরের পুরোনো মূর্তিরাজিতে ঠিক এ ধরনের পোষাক–আশাকের চিত্রিত নিদর্শন পাওয়া যায়। খুশি হই চোখের সামনে তাদের দেখতে পেয়ে। পর্যটকরা সেলফোনে ছবি তুলতে তুলতে আগুয়ান হচ্ছেন, এমন কী দুয়েকজন তাদের কাতারে শরিক হয়ে ফটাফট তুলে নিচ্ছেন তসবির। বর্শা হাতে মায়া মেয়েটি আমাকেও ইশারা করে। এগিয়ে যাই এক পা–দু পা, কিন্তু তার সাথী পুরুষটির হাতে বলিদানে ব্যবহৃত ভোজালি দেখতে পেয়ে কিঞ্চিৎ নার্ভাস বোধ করি। বীরত্ব দেখানোর সুযোগটি স্বেচ্ছায় হাতছাড়া করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তো মায়া কৌমের তিন সুসন্তানের কল্যাণ কামনা করে পা বাড়াই ভিন্ন দিকে।
চলে আসি বন্দরের ক্যাফে-রেস্তোরাঁ-বার ও লাইভ মিউজিকে সরগরম সরণীতে। দেখি, সামান্য দূরে লাঠিতে ভর দিয়ে অনিশ্চিত পদক্ষেপে একাকী হাঁটছেন জেকোবাস বসহপ। উনি তো চোখে তেমন দেখতে পান না। এখানে গন্তব্য মাত্র দুটি, শোর এক্সকারশনে কোনো না কোনো মায়ান মন্দিরে বেড়াতে যাওয়া অথবা ক্যাফের টেরাসে বসে পান করতে আকাশ–পাতাল ভাবা। ঠিক বুঝতে পারি না, কোথায় চললেন বসহপ সাহেব।
ফার্মেসির সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফাতমিরে। আজ সে পরে আছে ধবধবে সাদা টার্টলনেকের সঙ্গে ম্যাচ করা একটি সফেদ হ্যাট। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত তুললে আমি ‘হাই ফ্রিতা’ বলে তাকে গ্রিট করি। সঙ্গে সঙ্গে নজরে পড়ে মেয়েটির শুভ্র টপে নীলসুতোয় লেখা, ‘লেটস প্রমোট মাই ফেভারিট রাইটার ইসমাইল কাদারে (১৯৩৬-২০২৪)।’ মন্তব্য করি, ‘সো ইউ লাভ ইসমাইল কাদারেজ নভেলস?’ রেসপন্স করে সে, ‘নট এভরি বুক, বাট রিয়েলি লাভ হিজ ক্যারেক্টার কুরফারমানি।’ জানতে চাই, ‘কী করছ আজ?’ জবাব দেয়, ‘নট মাচ রিয়েলি, ফোয়ারার চত্বরে যাচ্ছি। জলে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্লেমিংগো দেখে পুরো দিনটি কাটিয়ে দেব।’ আমার ক্যাবওয়ালার কাছ থেকে ম্যাসেজ আসে, মিনিট বিশেক মধ্যে তিনি আমাকে পিক করবেন। বলি, ‘গুডবাই, ফাতমিরে।’
আমার পাশ দিয়ে হনহনিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যান মিউজিশিয়ান রুডিয়ার্ড সাবদিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে আপালাচিয়া অঞ্চলে প্রচলিত লোকগীতি হিলিবিলি ধারায় ইনি গেল রাতে জাহাজের ‘ফোক বার’ নামক পানশালায় গিটার বাজিয়ে গান করছিলেন। ডিনারের পরে কেবিনের দিকে যাওয়ার পথে তাঁর ধবধবে সাদা দাড়িওয়ালা চেহারা–সুরত দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম লাইভ মিউজিকে জমজমাট বারটিতে। হিলিবিলি অঙ্গের সংগীতে গল্প বলার একটা ব্যাপার থাকে। রুডিয়ার্ডের গাওয়া পর পর দুটি গানে বর্ণিত হয়েছিল, পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তান প্রদেশের রাজধানী স্কার্দু নামে একটি শৈলশহরের প্রসঙ্গ। ওই শহরটিতে যেহেতু আমিও ঘোরাফেরা করেছি, কাটিয়েছি দিন-দশেক, সুতরাং বসে পড়ি চেয়ার টেনে। আর শুনতে পাই চমত্কার লিরিকের বাখানিতে ফুটে উঠছে কারাকোরাম পর্বতের প্রাচীন প্রস্তরে খোদাই করে নির্মিত সহস্র বছরের পুরানো বিশাল এক বৌদ্ধ বিগ্রহের মহিমা।
গিটারে রুডিয়ার্ড সাহেবের দারুণ বাদন আমাকে স্মৃতিবিধুর করে তুললেও প্রলম্বিত স্বরে বার বার ‘স্টানিং বুডা রক…ওহ লর্ড…ট্রুলি ম্যাগনিফিশেন্ট বুডা রক…,’ অথবা ‘কাম অন…লেটস গো অ্যান্ড হিট দ্য কারাকুরাম হাইওয়ে…পে অ্যাটেনশন…লুক…থ্রি মাউন্টেনস…কারাকোরাম, হিন্দুকুশ অ্যান্ড হিমালয়াস আর ইন ফর্মেশন’ প্রভৃতি চরণ ব্যাপকভাবে উত্যক্ত করে তুলেছিল কিছু শ্রোতাকে। না, তেমন একটা হাততালি পাননি রুডিয়ার্ড ওরফে রাড। তবে মঞ্চ থেকে খিন্ন মুখে নেমে আসলে আমি তাঁকে অফার করেছিলাম এক পাত্তর মার্গারিতা।
আমার পাশ দিয়ে অনেকটা কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো দেখতে রাড এই যে হেঁটে গেলেন হনহনিয়ে, উনি কি আমাকে দেখতে পাননি? দিস ইজ স্ট্রেঞ্জ! এগিয়ে যাই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। দেখি, একটি দোকানের বারান্দায় বসে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছেন কয়েকজন সিনিয়র গোছের ক্রুজযাত্রী। তাদের সামনে সড়কে সটান দাঁড়িয়ে রাড মহোদয় গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন অদৃশ্য কিছুর দিকে। এ মুহূর্তে তাঁর ধ্যান ভাঙার প্রয়োজন দেখি না, তাই একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াই।
পর পর পাত্র-দুই মার্গারিতা পান করে রাড দারুণ খোশমেজাজে স্কার্দুর গল্প করছিলেন। পুরো একটি বছর কাটিয়েছেন ওই অঞ্চলে। কারাকোরাম পর্বতটি তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে বার তিনেক ওখানকার পাথুরে বেজায় র্যাগেড টেরেইনে ব্যাকপ্যাক কাঁধে ট্র্যাক করেছিলেন। এমনকি লং ডিসটেন্স ট্র্যাকে নাঙ্গা পর্বতের তলা অব্দিও গিয়েছিলেন। গানবাজনা করে কোনো খ্যাতি জোটেনি রুডিয়ার্ডের। ও নিয়ে কোনো খেদও নেই তাঁর।
ব্লু রিজ পাহাড়ের একটি পড়ো-ঝুরঝুরে লগকেবিনে বাস করেন একাকী। পোষেন মৌমাছি। পেশা হিসাবে রাড ছোট্ট এক পাহাড়ি শহরের পাবে গিটার বাজিয়ে হিলিবিলি অঙ্গের গান করেন। লিরিকগুলো তার নিজেরই রচনা। এ ছাড়া অবসরে বিওয়াক্স দিয়ে তৈরি করেন বর্ণাঢ্য মোমবাতি। তাতে মেশান রোজমেরি, সিনামন কিংবা ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ। নিজস্ব লিরিকের দুটি সিডিও প্রকাশ করেছিলেন রাড। পাবে গান শুনে কেউ কেউ তাঁর ঝুড়িতে পাঁচ-দশ ডলার গুঁজে দেন বটে, কিন্তু কেউ তাঁর সিডি-ফিডি কিনতে চায় না। তবে নিজ হাতে সংগৃহীত পোষা মৌমাছির নির্যাস হানি-জারগুলো বিক্রি হয়, এমনকি রোমান্টিক গোছের শ্রোতাদের কিঞ্চিৎ চড়া মূল্যে সুগন্ধি মোম গছাতেও কোনো সমস্যা হয় না।
ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে যেন ধ্যান ভেঙে জেগে ওঠেন রাড সাহেব। ‘দিস ইজ দ্য গাই আই অ্যাম লুকিং ফর রাইট অ্যাট দিস মোমেন্ট,’ বলে ছুটে এসে আমার হাতটি জাপটে ধরেন। এক জামানায় মায়ান সম্প্রদায়ের স্থপতিদের মেহনতে নির্মিত কোহুনলিচ মন্দিরের কম্পাউন্ডে তিনিও যেতে চাইছেন। প্যাকেজ ট্যুরে কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মতো গাইড-তাড়িত হতে চান না। শেয়ারে ট্যাক্সি নেওয়ার তালে আছেন রাড। বলি, ‘ওয়েট আ বিট। আমার ক্যাবটি মিনিট দশেকের মধ্যে এসে পড়ছে। লেটস রাইড টুগেদার, রাড।
দারুণ খুশি হয়ে দুচোখে ঝিলিক তুলে বলেন, ‘দেয়ার ইজ আ সুপার সেনসিটিভ গার্ল আই মেট ইন দি ক্রুজ। তোমার মতো সেও আমার গান খুব পছন্দ করেছে। গুগল ম্যাপ না কী ঘোড়ার ডিমে স্কার্দু, কারাকোরাম মাউন্টেন রেঞ্জের ছবি-টবি দেখে এক্সাইটেড হয়ে উঠেছে। ডু ইউ মাইন্ড ইফ আই ইনভাইট হার টু রাইড ইউথ আস…ইয়েস ব্রো?’ কোনো দ্বিধা না করে বলি, ‘গো অ্যাহেড, রাড। ফাইন্ড দ্য গার্ল। বি কুইক প্লিজ। এক সঙ্গে মায়ান মন্দিরে যেতে আমার আপত্তি কিছু নেই।’
অজানা নারীটির সন্ধানে রাড লাপাত্তা হলে তাঁর ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন’–এর মতো মেজাজের উত্স নিয়ে ভাবি। চটজলদিই ফিরে আসেন তিনি। সঙ্গে ওভার-সাইজ চশমায় চোখ ডাকা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তবে কিঞ্চিৎ অন্যমনষ্ক গোছের এক নারী। হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের নাম পালমিরা এসপোসিতো বলে নিরুত্তাপভাবে পরিচিত হয় মেয়েটি। আমি তেমন কিছু বলার সুযোগ পাই না, কিন্তু তপ্ত হয়ে ওঠা ড্রিপ কফির মতো উত্সাহে ফুটতে ফুটতে রাড সিনোরিনা পালমিরার কিছু বৈশিষ্টের উল্লেখ করেন। জানতে পারি, এই পিএইচডি ডিগ্রিধারী নারীটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কলেজে লেকচারার হিসাবে পড়াচ্ছে। আমারও তারিফ করতে গিয়ে রাড বলেন, ‘দিস গাই অলসো হ্যাভ আ ডক্টরেট ডিগ্রি, কিন্তু আমি যে রকম কলম দিয়ে আমার লিরিকগুলো কম্পোজ করি, ঠিক সে রকম সুলতানও নোটবুকে কলম দিয়ে কবিতা লিখে, অষ্টপ্রহর টেলিফোন ব্যবহারটা এরও পছন্দ নয়।’
‘সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং,’ বলে সিনোরিনা পালমিরা মন্তব্যে বাকসংযমের পরিচয় দেয়। এ ধরনের রেসপন্সেও রাডের উত্সাহে ঘাটতি পড়ে না। বলেন, ‘আই ফিল সো হ্যাপি টু মিট। নট ওয়ান, টু পার্সনস ইন দ্য ক্রুজ হু অ্যাপ্রিশিয়েট মাই মিউজিক।’
ট্যাক্সিটি এসে পড়ে স্ট্যান্ডে। গাড়িতে উঠতে উঠতে শুনি, রাড গুনগুনিয়ে গাইছেন বিটলস-খ্যাত ইয়োকো ওনোর কণ্ঠে গীত একটি লিরিক, ‘গুডবাই, স্যাডনেস। গুডবাই, গুডবাই। আই ডোন্ট নিড ইউ অ্যানিমোর…’
কোহুনলিচের মায়ান মন্দির ও পিরামিড
ট্যাক্সিওয়ালা আমার শুভেচ্ছা-সম্ভাষণের কোনো জবাব দেন না। গাড়ি স্টার্ট দিতেও গড়িমসি করেন। আমি তাড়া দিই। পোকায় কাটা দাঁতে গোলগাল মুখের মাংশপেশী কাঁপিয়ে নিঃশব্দে হাসেন তিনি। একটি ভিউকার্ড দেখিয়ে কোহুনলিচ মন্দিরের ছবিটির উল্টোদিকে কলম দিয়ে আঁকিবুকি করতে করতে জানান, শ্যানন নাকি তাঁকে অনুরোধ করেছে মায়া সম্প্রদায়ের ভাষায় লেখাপড়া করতে পারেন তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ তিনি যেন একটি কাগজে প্রায়-বিলুপ্ত মায়ান হরফে কিছু লিখে দেখান। রেখাচিত্রে তৈরি কিউবের মতো দেখতে গোটা চারেক সদ্যলেখা অক্ষর দেখিয়ে বলেন, ‘দিস ইজ মাই নেম, ইতঝেল চিমালমাত।’ এবার আমার নামটি লিখতে চাইলে, ‘পরে হবে, সিনিওর চিমালমাত, গাড়িটি স্টার্ট দিন প্লিজ’ বলে ধৈর্যধারণে আমি অপারগতার পরিচয় দেই।
ইগনিশন কি ঘোরাতে গিয়ে মহাশয় চোখে চোখ রেখে আমাকে স্টাডি করে নেন। ছুটে চলে ট্যাক্সি। এক নজরে সিনিওর চিমালমাতকে যা দেখেছি, তা নিয়ে ভাবি। তাঁর ফোলা ফোলা গালে মানচিত্রে মুছে যাওয়া রেখার মতো দাগগুলোকে ঠিক উল্কি নয়, মনে হয়, ধারালো চাকুতে কাটাকুটির শুকিয়ে যাওয়া জখম।
কোস্তা মায়ার বন্দর ছাড়িয়ে জেলেপল্লীর কিনার ঘেঁষা সড়কে চলছে গাড়িটি। জানালা দিয়ে নোনা হাওয়ার সঙ্গে ঢুকে পড়ছে সামুদ্রিক মাছের আঁশটে গন্ধ। কাচ উঠিয়ে দিয়ে চিমালমাত ফের কথা বলেন, ‘শ্যাননের কাছ থেকে জেনেছি, আপনি গল্পের সন্ধানে ক্রুজ করছেন। সে আমাকে দরাজ হাতে পেমেন্ট করেছে। নাউ আই উইল টেল ইউ রিয়েল গুড স্টোরিজ ফ্রম মাই লাইফ।’
আমি তেমন উত্সাহ দেখাই না। তিনি স্টিয়ারিং থেকে ডান হাতটি তুলে আমাকে দেখান, গাড়ি ততক্ষণে এসে উঠেছে পিচঢালা সড়কে। গতি বেড়েছে বেশ খানিকটা। বাঁ হাতে ড্রাইভ করা মায়া গ্রোত্রের সন্তানটিকে নার্ভাসভাবে দেখি। তাঁর ডান হাতের করতলে আঙুলের মাত্র তিনটি অবশিষ্ট আছে। বাকি দুটি খোয়া গেল কী প্রক্রিয়ায় সে বিষয়ে কোনো কৌতূহল না জানিয়ে অনুরোধ করি, ‘সিনিওর চিমালমাত, প্লিজ পুট ইয়োর রাইট হ্যান্ড অন দ্য স্টিয়ারিং।’ অনুরোধটি রাখেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে গল্প বলাটাও জারি রাখেন।
কৈশোরে হতদরিদ্র চিমালমাত সমুদ্রজলে স্পিয়ার ফিশিং বা বর্শা দিয়ে মাছ শিকার করতেন। ডুবসাঁতারে তাঁকে যেতে হতো জলতলের বেশ গভীরে। অক্সিজেন ট্যাংক জাতীয় কিছু জোটানোর রেস্ত ছিল না। বর্শায় মাছ গাঁথা অব্দি তাঁকে থাকতে হতো দম বন্ধ করে। তো একদিন একটি মোটাতাজা ট্রাউট মাছ বর্শায় বিঁধে উঠে আসছিলেন জলের সারফেসে। বেতমিজ প্রকৃতির এক হাঙর চেষ্টা করে মাছটি ছিনিয়ে নিতে। তিনি মুমুর্ষ মাছটিকে ডান হাত দিয়ে আগলানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু মিন দস্যু হাঙরটি কামড়ে এক খাবলা মাছের সঙ্গে ধারালো দাঁতে কেটে নেয় তাঁর দুটি প্রয়োজনীয় আঙুল।
স্লো হয়ে পড়ে গাড়ির স্পিড। এদিকে জঙ্গল কেটে সাতসুতরো করে তৈরি হচ্ছে রেললাইন। শাবল-গাইতি হাতে যাঁরা কাজ করছেন, সকলেই আশপাশের মায়া সম্প্রদায়ের দীনদরিদ্র মানুষজন। এঁদের পূর্বপুরুষরা এক জামানায়, ৩০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ভেতর মেক্সিকোর চল্লিশটি আলাদা লোকেশনে বিপুল মেহনতে গড়ে তুলেছিলেন মন্দির-ভিত্তিক নগরী। নির্মাণ করেছিলেন পাথরের পিরামিড, পয়োঃপ্রণালী ও প্রাসাদ। ঠিক বুঝতে পারি না, নিম্নবর্গের মানুষজনের দিনযাপনে পরিবর্তন এসেছে কতটা? ড্রাইভার চিমালমাত জানতে চান, আরেকটি গল্পের জন্য আমি প্রস্তুত কিনা। বলি, ‘আপনি একটু বিরতি নিন। আমি এবার সহযাত্রী সিনোরিনা পালমিরার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাকসিটের দিকে নজর দেই, পালমিরা চোখ থেকে গো-গো স্টাইলের সানগ্লাসটি খুলে নিয়ে বলেন, ‘ইউ মে কল মি মিরা, হোয়াট ইজ ইয়োর কোয়েশ্চেন?’ সৌজন্যবশত তাঁকে একটি–দুটি সাদামাটা সওয়াল করি। যেন সার্ভেয়ারের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, এ রকম ভঙ্গিতে টু দি পয়েন্ট অ্যানসার দেন মিরা। তার প্রয়াত জননী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকো নগরীর শহরতলীর বাসিন্দা, বাবা ইতালিয়ান। বর্তমানে কাজ করছেন ভেটিক্যানে। ধর্মযাজক নন, প্রকৌশলী হিসাবে বিরাট সব প্রাসাদ-গীর্জা প্রভৃতির মেইন্টেনেন্সে কাজ করেন। কেলিফোর্নিয়ার দূর মফস্বলে অখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসাবে বছর দুয়েক হলো মিরা কাজ করছেন। এখনো টেনিওর পাননি।
আমাদের কথাবার্তা এগোয় না বেশি দূর। খাতাটি খুলে ধরে স্বরচিত একটি লিরিকের বাণী মিরাকে দেখাতে শুরু করেন হিলিবিলি সিংগার রুডিয়ার্ড ওরফে রাড। আমি খামোশ মেরে গিয়ে তাকাই চলমান সড়কের দিকে। সড়কের এক পাশে বসেছে বাজার। বিক্রি হচ্ছে ঝিনুক, গুগলি ও অক্টোপাস। ফলমূলও উঠেছে প্রচুর। বিরাট একটি মাহী-মাহী মাছকে কেটে শতখণ্ড করে বিক্রি হচ্ছে টুকরো টুকরো গাদা ও পেটি
স্লো হয়ে এসেছে ফের গাড়ির গতি। চিমালমাত এবার আমার অনুমতি না নিয়েই সূত্রপাত করেন আরেকটি গল্পের। বলেন, ‘লুক অ্যাট মাই ফেস, স্পিয়ার ফিশিংয়ের কাজে ইস্তফা দিয়ে আমি চলে যাই সীমান্তের কাছাকাছি একটি শহরে। কাজ জোটে না। উল্টো পড়ি গ্যাংয়ের পাল্লায়। ইউ নো অ্যাবাউট মেক্সিকান কার্টেল। তারা আমাকে ড্রাগ মিউল হতে বাধ্য করে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দিনের পর দিন ড্রাগস ক্যারি করে পৌঁছে দিতে হতো যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডারে। কাজটি করতে আপত্তি তুললে লুক হোয়াট দে ডিড টু মাই ফেস। দ্যাট ওয়াজ দ্য পানিশমেন্ট। সেরে উঠে নদী ক্রস করে আমি ঢুকে পড়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে।’
এ পর্যন্ত বলে আচমকা ব্রেক কষেন চিমালমাত। ঝাঁকি সামলে নিয়ে বলি, ‘প্লিজ সড়কে একটু নজর দিন। কোহুনলিচের মন্দির চত্তরে পৌঁছে, আই প্রমিজ, পুরো গল্পটি পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ সব কিছু শুনব।’ মায়াদের সনাতনি পোষাক–আশাকে সজ্জিত বেশ কিছু নারী, পুরুষ ও শিশু গাড়ির সামনে দিয়ে পাড়ি দেয় সড়ক। দেখতে পাই, তিন তরুণী ক্যারি করছে তিনটি ডালা। তাতে বৃত্তাকারে সাজানো তাজা ফুলের কেন্দ্রে রাখা বিরাটাকারের একটি করে সূর্যমুখী। পেছনে বৃদ্ধরা হাঁটছেন। তাঁদের কাঁধ থেকে ঝুলছে ক্যাকটাস পাতার ফেসোতে বোনা গোছা গোছা রঙিন সুতো। বৃদ্ধাদের হাতে মিউজিক কন্ডাক্টরের ব্যাটনের মতো দেখতে হৃষ্টপুষ্ট দীর্ঘ সব মোমাবাতি। বেজায় বড় শঙ্খ হাতে একজন শামানও আছেন। আর আছে ফলমূল সবজির পশরা নিয়ে চটুল পদক্ষেপে হেঁটে চলা কিশোরীরা।
ট্যাক্সি ফের এগোয়। খোলা জানালা দিয়ে ধূপধুনোর গন্ধের সঙ্গে উড়ে আসে মায়ান ভাষায় বাতচিতের শব্দ। ড্রাইভার চিমালমাত মন্তব্য করেন, গ্রামের লোকজন কাছাকাছি আরেকটি পিকচারেস্ক মায়ান রুয়িন কাকচোবিনের দিকে যাচ্ছেন। সূর্যদেবতা মধ্যগগনে পৌঁছে যখন ছড়াবেন তুমুল কিরণ, ঠিক ওই সময় এরা অর্পণ করবেন নৈবদ্য। জঙ্গলাকীর্ণ এক মেঠোপথ ধরে নুড়িপাথর ছিটকিয়ে এবার আগুয়ান হচ্ছে গাড়িটি। দেখতে দেখতে আশপাশের গাছপালা ও ঝোপঝাড় ঘন হয়ে ওঠে। ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় একহারা গড়নের সুদর্শন একটি বৃক্ষের পাশে। নেমে পড়ি আমরা। কথা হয়, যে যার মতো ঘুরেফিরে ঠিক এ জায়গায় ফিরে আসব এক ঘন্টা পর। রাড ও পালামিরা রওয়ানা হন সামনের দিকে। আমিও অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবছি। তখনই খেয়াল করি বৃক্ষটির ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। গাছ এখানে একটি নয়, দুটি। মূল বৃক্ষটিকে জাপটে ধরে বেয়ে উঠতে উঠতে সম্পূর্ণ ফ্রিজ হয়ে আছে অন্য একটি তরুবর।
আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন চিমালমাত। তাঁর সওয়াল একটাই, ‘গল্পের বাকিটুকু শুনবেন না? শ্যানন আমাকে পেপলে পেমেন্ট করেছে?’ দরাজ টিপসের সঙ্গে নতুন একটি নোটবুক তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলি, ‘লাঞ্চব্রেকে অবশ্যই শুনব। এখন আমি কোহুনলিচের মন্দির চত্বরে একটু একা একা ঘুরতে চাই। আপনি কোথাও বসে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয় এ ধরনের পনেরো-বিশটি মায়ান শব্দ ইংরেজি তর্জমাসহ লিখে দিন।’
গাছপালায় ছায়ানিবিড় পথরেখা ধরে হেঁটে যাই। একুশ একরজুড়ে বিস্তৃত কোহুনলিচ নামক মন্দির, প্রাসাদ ও ছোটখাটো একটি পিরামিডের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা, দেড়-দু হাজার বছরের পুরানো উপশহরের চত্বরের দিকে। পাখির প্রবল কলতানকে ছাপিয়ে কান ঝালাপালা করে দিতে থাকে ঝিল্লির তুমুল নিনাদ। এসে দাঁড়াই দেবদেউলের ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি। দেড় হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা উত্সর্গ-মন্দিরের তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। শুধু দাঁড়িয়ে আছে ক্ষয়িষ্ণু একটি প্রাচীর, যা নিমিষে আমাকে নিয়ে যায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ধূসর এক পূরাতাত্ত্বিক পরিসরে। জঙ্গলের নীরবতা তোলপাড় করে ভেসে আসে পালের গোদা গোছের মর্দা হাউলার মাঙ্কির ডাক। বনানীর নানা দিক থেকে ব্যাকুল স্বরে সাড়া দেয় পরপর তিন মাদি বানর।
সিঁড়ি ভেঙে আমি উঠতে শুরু করি। উপশহরটির শাসক মায়া কৌমের সামন্ত রাজার প্রাসাদে। এ এলাকার ট্রেডরুটের কেন্দ্র কোহুনলিচ থেকে অজ্ঞাত কারণে সরে গিয়েছিল লোকালয়। ঘন অরণ্যে ঢাকা পড়েছিল পাঁচ থেকে সাতশ বছরের মতো জনবিরল কমপ্লেক্সটি। ১৯১২ সালের দিকে রেমন্ড মারউইন নামে এক পুরাতাত্ত্বিক মায়ান কিংবদন্তির সূত্র বিশ্লেষণ করে পাশ্চাত্যের বোদ্ধা সম্প্রদায়কে এ লোকেশন সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন। খোঁড়াখুঁড়িতে আপাতত এক্সপোজড হয়েছে মাত্র কয়েকটি ইমারত। বাদবাকি আরো দুশটি দালানকোঠার তালাশ পাওয়া গেছে্ তবে ওগুলো এখনো খুঁড়ে পয়পরিষ্কার করে পর্যটকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি।
প্রাসাদের উপরিতলে হরেক রকমের কামরার ভিত ও দেয়ালের কিয়দংশ ছাড়া দেখার মতো আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। তবে পেছন দিককার ঘন বনানীতে ফুটেছে প্রচুর ফুল। তাতে দীর্ঘ চঞ্চুতে হুল ফোটাচ্ছে অত্যন্ত ছোট্ট ছোট্ট হামিংবার্ড। ঝুলন্ত লতা থেকে পোকা খুঁটে নিতে নিতে দোল খাচ্ছে অজানা কিছু পাখি। তাদের দোদুল্যমানতায় তৈরি হচ্ছে মিউজিক্যাল নোটেশনের মতো বিমূর্ত চিত্রলিপি।
সেলফোনে কথা বলার শব্দে ছত্রখান হয় প্রাসাদের নির্জনতা। দেখি, রাজন্যের শয়নকক্ষের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে ডিজাইনার জিন্সের সঙ্গে লেদার ভেস্টপরা অত্যন্ত সুদর্শন এক পুরুষ। তার শরীর থেকে যেন ছিটকে বেরুচ্ছে ব্যায়ামঋদ্ধ পেশীর দাপট। সানগ্লাসে চোখ দুটি ঢাকা থাকায় তাকে ফিল্মে চিত্রায়িত সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টের মতো দেখায়। চাপা স্বরে তিনি বলেন, ‘বিলিভ মি হানি, আই অ্যাম স্ট্যান্ডিং অন দি ফ্লোর অব দি রয়েল বেডচেম্বার।’
চলে আসি সূর্যমন্দিরের কাছাকাছি। এ চত্বরে পিকচারেস্ক দালানকোঠা নেই তেমন। তাই ভেবেছিলাম, সেলফি-প্রিয় টুরিস্টদের সাক্ষাৎ পাব না তেমন, কিন্তু আধভাঙ্ প্রবেশপথে ঢুকে পড়ে আমার ভুল ভাঙে। দেখি, নিঝুম পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধ্বংসস্তূপের মহিমায় নিমগ্ন হয়ে হাঁটছেন জনাকয়েক পর্যটক। জোড়া ট্র্যাকিং স্টিকের ওপর ভরসা করে আমি আস্তে–ধীরে মান্দিরের সিঁড়ি ভাঙি। মাঝবয়সী এক নারী নাকের ডগায় নেমে আসা হাইপাওয়ারের চশমাটি সামলাতে সামলাতে তসবিহ জপার মতো এক-দুই করে গোনেন সিঁড়ির ধাপ। হঠাৎ হাওয়ায় বিস্ফোরিত ফুলঝুরির মতো ওড়ে তার আধময়লা চুল। এক যুগে নাকি বেদির চারপাশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল ফ্রেস্কোর কারুকাজে সমৃদ্ধ দেয়াল। অবশিষ্ট নেই কিছুই আর। আমার পদশব্দে বিরক্ত হয়ে উড়ে যায় কয়েকটি কাক।
এ চত্বরের হাইলাইট হচ্ছে টেম্পল অব মাস্ক বা রাজন্যের মুখোশপরা পাথর-কোঁদা মূর্তির মন্দির। ওটি নিশানা করে যাওয়ার পথে এক পাশ থেকে নজর করে দেখি, তেমন উঁচু নয়, তূলনামূলকভাবে ছোট সাইজের পিরামিডটি। অবাক লাগে, তার সোপানরাজির একটি ধাপে আস্ত এক বৃক্ষ দেখে।
টেম্পল অব মাস্কের আদি দেউলটির সিঁড়িও ভেঙেচুরে স্তূপীকৃত হওয়া দেয়ালটি কোনোক্রমে টিকে আছে। সিঁড়িগুলো বেজায় উঁচু। তাই উঠতে হয় অত্যন্ত সাবধানে। আমার পাশে পাশে সিঁড়ি ভাঙেন নাদুসনুদুস দেহের কামানো চুলে উটপাখির ডিমের মতো চকচকে মুণ্ডুওয়ালা এক পুরুষ। তিনি ইয়ারপিসে সম্ভবত কমিক বা জোকস কিছু শুনছেন। থেকে থেকে হাসেন একা একা। হাসির গমকে তার নোয়াপাতি ভূঁড়িটি জলে পড়া ফুটবলের মতো নড়েচড়ে।
রাজন্যের মুখোশগুলোর কাছাকাছি সিঁড়িগুলো ভেঙেচুরে শ্যাওলা জমে এমন হালত হয়েছে যে দড়ি টেনে ওদিকে আগুয়ান হতে নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। পরপর শাসন চালানো আটজন রাজন্যের মুখোশগুলেরা মধ্যে কোনাকাঞ্চি ভেঙে, রঙ জ্বলে–ক্ষয়ে-ধ্বসে রোদবৃষ্টির অভিঘাতে এখনো কায়ক্লেশে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি মুখোশ। বাকি তিনটির কী হয়েছে বলা মুশকিল। এগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যে ভোরবেলাকার পয়লা রশ্মি এদের আলোকিত করে নিত্যদিন। আর ইনারা যে সূর্যদেবতা কিচিন আহুর আশীর্বাদধন্য, তা প্রতীকীভাবে জানিয়ে দেয় নৈবদ্য অর্পণ করতে আসা মায়া কৌমের মানুষজনদের।
ক্যমেরার ভিউফাইন্ডারে ধাপে ধাপে স্থাপন করা মূর্তিগুলোর ছবি নিতে গেলে স্বেচ্ছায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয় ধারালো পাথরে আকীর্ণ খাদে। তবে ঝুঁকি না নিয়ে একটি মূর্তিময় মুখোশের দিকে ফোকাস করি লেন্স। স্ন্যাপশট নিতে নিতে অনুভব করি, নাম না জানা রাজাটির অবয়বের সঙ্গে সূর্যদেবতার কল্পিত বিগ্রহের কোথায় যেন খানিকটা মিল আছে। পাশ থেকে একা একা হাসতে থাকা মানুষটি বলে ওঠেন, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইট ওয়াজ আ ম্যাজেস্টিক টেম্পল।’ ‘আই অ্যাম শিওর ইট ওয়াজ গর্জিয়াস,’ বলে আমি তার দিকে হাত নাড়ি।
হাঁটু ও কোমরে ব্রেইস বেঁধে এবার প্রস্তুতি নিই পিরামিডের উপরিতলে ওঠার। সামনে এসে দাঁড়ান ড্রাইভার চিমালমাত। হাতে তার মোবাইলের স্ক্রিনে ফোটে ওঠা শ্যাননের টেক্স। অনুরোধটি পরিষ্কার, পিরামিডে আমি যেন একা না উঠি। অবচেতন থেকে বলকে উঠে অনভিপ্রেত খিস্তি, কিন্তু পিরামিড আরোহনের শিষ্টাচার সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল নই। সুতরাং সংযত রাখি জবান। বুঝতে পারি, এবার সাথী হতে যাচ্ছেন হচ্ছেন চিমালমাত। তো গ্রাউন্ডরুল হিসাবে বলি, ‘সিনিওর, নো পোয়েদেস আবলার।’ অর্থাৎ, ‘কথা বলতে পারবেন না আপনি।’ অবাক হয়ে রেসপন্স করেন, ‘কিয়ারেস সিলেনসিও, সিনিওর।’ ‘নীরবতা চাচ্ছেন আপনি?’ একটু জোরেই বলি, ‘ইয়েস।’ সিঁড়ির সংখ্যা একেবারে কম নয়। খানিকটা ওপরে ওঠে অঙ্গীকার ভাঙেন চিমালমাত। বলেন পিরামিডচূড়ায়, ‘লা ভিসতা অ্যাস মারাবিওসো।’ ‘পাওয়া যাবে মার্ভেলাস ভিউ।’ আমি প্রত্যাশিত সেই ভিউর তালাশে আবার ভাঙি পিরামিডের সিঁড়ি।