প্রায় ৫০০ বছর আগে শুরু হওয়া এই মেলা এবারও বসছে ঈদের দিন
রাজশাহীর বাঘার মানুষের কাছে পবিত্র ঈদুল ফিতরে আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে ঈদমেলা। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এ মেলা হয়ে ওঠে সব মানুষের মিলনমেলা। প্রায় ৫০০ বছর আগে শুরু হওয়া এই মেলা এবারও ঈদের দিন থেকে পরবর্তী সাত দিন চলবে। শৈশব থেকেই ঐতিহ্যবাহী এই মেলাটিতে যান বাঘার মানুষ আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
নলখাগড়ার কাণ্ড কেটে ছোট ছোট বাঁশি বানানো হয়। তার এক মাথায় বাঁধা থাকে রঙিন বেলুন। ফুঁ দিয়ে বেলুন ফোলাতে হয়। তারপর দম দেওয়া বাঁশিটি একা একাই অনেকক্ষণ ধরে বাজতে থাকে। সে বাঁশির সুর আলাদা। জীবনে অনেক বাঁশি শুনেছি। নলখাগড়ার বাঁশি আমার শৈশবকে যেখানে বেঁধে ফেলেছে, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়াও সেখানে যেতে পারেননি। জানি না, সেই বাঁশির সুরে কোন জাদু মিশে আছে।
শৈশবের ঈদের স্মৃতির কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমে নলের বাঁশির সেই সুরই যেন কানে এসে লাগল। রাজশাহীর বাঘায় আমার গ্রামের বাড়ি। বাঘার মানুষের কাছে ঈদের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে ঈদমেলা। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এ মেলা হয়ে ওঠে সব মানুষের মিলনমেলা। প্রায় ৫০০ বছরের এই মেলা প্রতিবছর ঈদের দিন থেকে শুরু হয়। চলে এক সপ্তাহ।
মেলায় এখনো থাকে সার্কাস, নাগরদোলা, মৃত্যুকূপ, জাদুসহ নানা বিনোদনমূলক আয়োজন। আসবাবসহ হরেক পসরা ও মিষ্টির দোকানে উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকে।
ছোটবেলায় আমাদের ঈদের আনন্দ বলতে ওই একটা জিনিসই ছিল। মেলা থেকে চার আনা দিয়ে বাঁশি কিনে সারা পথ বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফেরা। এর চেয়ে সুখাবহ কোনো আনন্দভ্রমণের স্মৃতি সারা জীবনে আর কোথাও মেলেনি। এটা শুধু কথার কথা নয়, একটু উদাহরণ দিলে শৈশবের এই কাঁচা আবেগের বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
তখন বয়স কত বা কোন ক্লাসে পড়ি, ঠিক মনে নেই। শুধু এইটুকু মনে আছে, বাড়ি থেকে একাই পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বাঘায় ঈদমেলায় যেতে পারি।
আমার টাইফয়েড জ্বর। আগের দিনে এই জ্বর হলে চিকিৎসকেরা রোগীকে ১৫-২০ দিন ধরে না খাইয়ে রাখার পরামর্শ দিতেন। না খাওয়ার এই পর্বটিকে গ্রামের মায়েরা ‘রঙ্গনা’ বলতেন। রঙ্গনা শেষ হলে রোগীর মুখে পথ্য তুলে দিতেন। বার্লি আর পানি জ্বাল দিয়ে বানানো হতো সেই পথ্য। স্যুপের মতো একটা জিনিস, মাছের ঝোল দিয়ে রোগীর মুখে এক-আধচামচ করে দেওয়া হতো। কয়েক দিন পরে মিলত নরম ভাত।
আমার সবে রঙ্গনা শেষ হয়েছে। মা পথ্য দিচ্ছে। ১০-১৫ দিন ভাতের দেখা মেলেনি। এরই মধ্যে ঈদের বাঁশি বেজে উঠল। মানে, ঈদের প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই আমার কানে বাজতে থাকে নলখাগড়ার বাঁশি। সেবার বাঁশি বাজতে শুরু করেছে কিন্তু মা ভাত দিচ্ছে না। আরও কয়েক দিন পথ্যতেই থাকতে হবে। এই নিয়ম অমান্য করলে আবার টাইফয়েড ফিরে আসতে পারে। তাহলে আবার না খেয়ে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। এভাবেই ঈদ চলে এল। মা ঘোষণা দিয়েছে, কিছুতেই বাইরে যাওয়া যাবে না। গেলেই টাইফয়েড ফিরে আসবে, কিন্তু বাঁশি আমাকে কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছে না। বাঁশির সুর আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেলায়। দেখতে পাচ্ছি গাঁয়ের ছেলেরা দল বেঁধে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে। আর দেখাচ্ছে, কার বাঁশির দম কত বেশি। তখন আমার দেহটাই শুধু বিছানায় পড়ে রয়েছে। মনটা উড়ে গেছে।
৫০০ বছরের ঈদমেলা
ইসলাম প্রচারক হজরত শাহ্ মোয়াজ্জেম দানিশমন্দ শাহ দৌলা (রহ.) ও তাঁর ছেলে হজরত শাহ্ সুফি মাওলানা আবদুল হামিদ দানিশমন্দ কতুবুল আফতাব (রহ.)-এর ওরস মোবারক উপলক্ষে ঈদুল ফিতরের দিন ও তার পরের দিন বাঘা দরগাহ শরিফে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাঘা মাজার ওয়াক্ফ এস্টেট পরিচালনা কমিটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও তবারক বিতরণ করে থাকে। এতে প্রচুর লোক অংশ নেন। এই আয়োজনকে ঘিরে বাঘা ওয়াক্ফ এস্টেট চত্বরে মেলা বসে। মেলাটি শাহ্ দৌলা সরকারি কলেজ ও বাঘা হাইস্কুল মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। এবার হজরত শাহ্ মোয়াজ্জেম দানিশমন্দ শাহ দৌলা (রহ.)-এর ৪৯৬তম ওরস মোবারক। মেলার বয়স ধরা যায় প্রায় ৫০০ বছর। আগে এই আয়োজন উপলক্ষে সারা দেশ ও ভারত থেকেও দর্শনার্থীরা আসতেন। হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মাহবুবর রহমানের মতে, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ঈদমেলা হচ্ছে বাঘার মেলা।
আমার মতিগতি বুঝতে পেরে আমাকে ঘরে রাখা হলো। আমিও তক্কে তক্কে রইলাম, কোনো কাজে কেউ একবার ঘরে ঢুকলেই আমি পালাব। সুযোগও পেয়ে গেলাম। যে কাপড়ে ছিলাম সেই কাপড়েই বেরিয়ে পড়লাম, কিন্তু বাড়ি থেকে ৫০০ গজ যাওয়ার আগেই ধরা পড়ে গেলাম। আজ আর মনে নেই, কে আমাকে ধরেছিলেন। হয়তো বড় ভাই অথবা চাচারা কেউ হবেন। প্রায় ১৫-২০ দিনের না খাওয়া টিংটিঙে শরীর কিছুতেই তাদের বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। আমাকে চ্যাংদোলা করে এনে ঘরে তালা দিয়ে রাখা হলো। মনে আছে, সারা জীবনে কোনো দিনই এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি কাঁদিনি। বড় হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি, সেই দীর্ঘ কান্নার ভেতরেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পরিবারের সবাই ভেবেছিলেন, এই দীর্ঘ কান্নার পরে আমি থিতু হবো। ঝড়ের পরে যেমন গাছপালা থ হয়ে থাকে। কিন্তু বাঁশি আমার ভেতরের ঝড় থামাতে দেয় না। পরের দিন আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। এক ফাঁকে সুযোগ মিলেও গেল। তখন মেলা দেখার জন্য ছোটদের দুই টাকা দেওয়া হতো। আমার কান্না থামানোর জন্য মা বোধ হয়, আমার ভাগের দুই টাকা আমাকে দিয়েছিলেন। সেই টাকা আর গায়ের জামাটা জড়ো করে হাতে নিলাম। দরজা খোলা পেয়ে খালি গায়ে বাইরে বের হয়ে এলাম, কেউ দেখলেও যাতে সন্দেহ না করে। রাস্তায় কত দূর গিয়ে জামাটা পরেছিলাম, ঠিক মনে নেই। সেদিন মনে হয়েছিল, আমার চেয়ে ভাগ্যবান আর কেউ নেই। মা–বাবার চোখকে ফাঁকি দিতে পেরেছি। মনে হলো বিশ্ব জয় করে ফেলেছি।
চার আনায় নলের বাঁশি কিনলাম। আর চার আনায় একটা ব্যাঙগাড়ি আর একটা চশমা। এক হাতে ব্যাঙগাড়ির রশি ধরে আরেক হাতে বাঁশিতে দম দিতে দিতে কড়া রোদের মধ্যে ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি ফিরলাম।
জীবনে এই প্রাপ্তির সঙ্গে আজও আর কিছু মেলাতে পারি না। বড় হয়ে অনেক জায়গায় গিয়েছি। অনেক শহর দেখেছি কিন্তু ওই মেলার আনন্দ আর কোথাও পাইনি। এখনো আনন্দের কথা ভাবতে গেলে মনের মধ্যে শৈশবের সেই ঈদের মেলাই ঘুরেফিরে ফিরে আসে। এখনো সেই তেঁতুলগাছ আছে, যার পূর্ব পাশে নাগরদোলা, আর পশ্চিম পাশে সারি সারি সেই বাঁশির দোকান। বাঘা হাইস্কুল মাঠে সার্কাস, পুতুলনাচ সব ছবির মতো দেখতে পাই।
সেইবার আমার চিকিৎসকের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আমার আবার জ্বর এল। দ্বিতীয়বারের মতো টাইফয়েডে আক্রান্ত হলাম। সেবার কত দিন রঙ্গনা চলেছিল, কত দিন পরে বার্লির পথ্য পেটে পড়েছিল, মনে নেই। কিন্তু বুকের ভেতরে সেই ঈদমেলার বাঁশি আজও বেজে যায়। হায়! মধুর বাঁশি।
মেলায় যেতে
মেলায় আপনিও যেতে পারেন। ট্রেনযোগে বাঘার আড়ানী স্টেশনে নেমে সিএনজি বা অটোরিকশা নিয়ে অনায়াসে যাওয়া যায়। রাজশাহীর পুঠিয়া থেকে ও ঈশ্বরদী থেকেও একইভাবে মেলায় যাওয়া যায়। আবার রাজশাহী থেকে বাসে এক ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে যাওয়া যায় মেলায়। জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। অথবা মেলা দেখে সন্ধ্যায় বের হলেই রাজশাহী বা নাটোরে গিয়েও রাত যাপন করা যায়।