অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম
সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন নবম পর্ব
অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের দলনেতা মারিওর চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল। প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে জাহাজের রিসেপশন থেকে সে বলে চলেছে, ‘সুপ্রভাত, সুপ্রভাত। কী অসাধারণ দৃশ্য! তোমরা বাইরে এসে দেখো...’
পরপর দুবার সুপ্রভাত বলে মারিও। তার ঘোষণাটা প্রতি কেবিনে পৌঁছে যায়। আজকের ঘোষণায় চমক লাগল, ‘আমরা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা বলয়ে ঢুকে পড়ব, আর মাত্র অল্প সময়।’ মনে হলো মাথা থেকে অবসাদ দূর হতে শুরু করেছে। অসুস্থ শরীরটা ভালো বোধ করতে শুরু করল। মনস্থির করলাম, গেল দুদিন নাওয়া-খাওয়ায় অনেক অনিয়ম করেছি, আজ ব্রেকফাস্ট করব।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
আমার কেবিন-বন্ধুকে বললাম, নাসতা, আমি এখন গোসল করতে চাই, তোমার কি এখন বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন?’
নাসতা মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে আমাকে আগে যেতে বলল।
সকালের খাবার টেবিলে বন্ধুরা আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত। অবশ্য অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে যাওয়ার ঘোষণায় জাহাজের রেস্তোরাঁ আজ আর রেস্তোরাঁ নেই, হয়ে গেছে উৎসবস্থল।
এভাবেই প্রায় দুপুর হলো। আবার মারিওর আহ্বান, ‘আমরা অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলায় ঢুকে পড়েছি, বাইরে অসাধারণ দৃশ্য।’
সবাই যার যার কেবিন থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল। আমি জাহাজের একেবারে নিচতলায় থাকি। বেরিয়ে দুতলায় জাহাজের ডেকে চলে এলাম। উচ্ছ্বাসে সবাই কলরব করছে।
৬৪ ডিগ্রি দক্ষিণে থেমেছে আমাদের জাহাজ। ৬০ ডিগ্রির পর থেকে অ্যান্টার্কটিক সার্কেল শুরু। অভাবনীয় দৃশ্যপট। শান্ত সাগরে ভাসছে জাহাজ, একদম ঢেউ নেই। সাগরের মধ্যে মাথা তুলে আছে পাহাড়। পানির মধ্য থেকে জেগে ওঠা এমন পাহাড় আমরা কমই দেখেছি। সাদা বরফে ঢেকে আছে পাহাড়; কর্পূরের মতো সাদা, সাবুদানার রঙের মতো সাদা—অ্যান্টার্কটিকা!
এমন সময় আবার শোনা গেল মারিওর ঘোষণা, ‘১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা প্রথম অপারেশন শুরু করব। এ জন্য আমরা চারটি গ্রুপ করেছি, শুরু করব এ গ্রুপ দিয়ে। প্রত্যেককে অনুরোধ করা যাচ্ছে নোটিশ বোর্ড দেখে নেওয়ার।’
অভিযাত্রীরা দ্বিতীয় দফার দৌড় শুরু করল। ১৫ মিনিটের মধ্যে এ গ্রুপের অভিযাত্রীদের তৈরি হতে হবে। প্রত্যেকে যার যার কেবিনে ছুটছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি নোটিশ বোর্ডের সামনে। এ গ্রুপে সবার ওপরে একেবারে ১ নম্বরে লেখা ‘মহুয়া রউফ’! আমার হাত-পা কেঁপে ওঠে, আমি সবার আগে নামব? এই প্রথম অপারেশনে? যদিও এই ১ নম্বরে থাকা এমন কোনো বাহাদুরির কিছু নয়। সবাই-ই নামবে। তবু আমার খুব আনন্দ হলো। নিজের আবেগের লাগাম টেনে ধরলাম।
কাপড়চোপড় কীভাবে পরতে হবে, তার একটা ধারণা গত রাতেই পেয়েছি। তিন-চার স্তর কাপড় পরতে হয়। কাপড় হতে হবে গরম এবং পাতলা। শরীরের সবচেয়ে ওপরের কাপড় হবে পানিরোধী। দুটি করে আন্ডার-গার্মেন্টস পরতে বলেছে মারিয়া। এই অভিযান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান লাল টকটকে একটা পারকা জ্যাকেট দিয়েছে। এটি পানিরোধী। সর্বশেষ বুকের ওপর এবং পিঠে বেঁধে নিলাম ফোলডিং লাইফ জ্যাকেট, ওজন কম করেও চার কেজি। আমার ঘাড় কষ্ট পাচ্ছে।
আরেকটি নচ্ছার জিনিস ওই বুট জুতা। হাঁটু অবধি উঁচু আর ভীষণ ভারী। প্রথম দিন কেবিনে প্রবেশ করেই টেবিলে দুটি কার্ড পেয়েছি। একটি কক্ষের দরজা খোলার; এটি চাবির আধুনিক ভার্সন। আরেকটি পাঞ্চিং কার্ড, জাহাজে প্রবেশ ও প্রস্থানে ব্যবহারের জন্য। একটি বিষয়ে বারবার আমাদের সাবধান করা হয়েছে। অপারেশনে যাওয়ার সময় অবশ্যই রিসেপশনের পাঞ্চিং মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করে জাহাজ থেকে নামতে হবে। জাহাজে প্রবেশের সময়ও কার্ড পাঞ্চ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ তাতে বুঝতে পারবে সব অভিযাত্রী ঘরে ফিরেছে। মনে করে কার্ডটা পকেটে নিলাম।
কম করেও ১৫ কেজির পোশাক শরীরে জড়িয়েছি। বাংলাদেশ ছাড়ার ১৪ দিন আগেই বাঁ পায়ে ছোটখাটো একটা অপারেশন হয়েছিল। যেদিন প্লেনে উঠব, তার আগের রাতে সেলাইয়ের সুতা কাটা হয়েছে। ডাক্তার বলেছিলেন মাইনর, আমিও ভেবেছি, এ আর এমনকি, মাইনর! ব্রাজিল আর চিলির সীমান্তে অধিক হাঁটাহাঁটির কারণে কিন্তু বাঁ পায়ে ব্যথা বেড়েছে। ট্যাক্সি না পেয়ে উসুয়াইয়া শহরে দীর্ঘ পাথুরে পাহাড়ি পথে দুই হাতে লাগেজ টানতে হয়েছে। সেই থেকে বাঁ হাতটাও বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছে।
রিসেপশনে এ দলের সব অভিযাত্রী দাঁড়িয়ে। এ দল থেকে প্রথমে ১০ জন নৌকায় উঠবে। আমার পেছনে কানাডীয় এক অভিযাত্রী। পেশায় পুলিশ। অবসরপ্রাপ্ত। আগে কথা হয়েছে দুবার। আমাকে দেখে খুব পরিচিতজনের মতো হাসলেন। বললেন, ‘লাইফ জ্যাকেটটা তুমি ভুলভাবে পরেছ, ঠিক করে দিতে পারি?’ অজ্ঞতার জন্য খানিকটা লজ্জিত হয়ে সম্মতি দিলাম।
পানিতে জোডিয়াক নামের ছোট নৌকা ভাসছে। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত পৌঁছাতে নৌকায় নদী পার হতে হতো। ওঠার সময় নৌকায় এক পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই খানিক দূরে সরে যেত নৌকা, সে সময় ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হতো। শৈশব-কৈশোরের সে স্মৃতি মনে পড়ায় ভীষণ রকম শঙ্কিত হলাম। তবে দুজন ক্রুর সহযোগিতায় সহজেই জোডিয়াকে উঠে বসলাম। গাইড বলল, ‘বুকে বা পিঠে কোনো ব্যাগ নেওয়া যাবে না। হয় পাটাতনে রাখো অথবা দুই পায়ের মাঝে।’
জানতে চাইলাম, কেন?
গাইড জানাল, ‘এই লাইফ জ্যাকেটে একটা সেন্সর আছে। সেন্সরের কারণে এই জ্যাকেট পানির সংস্পর্শে এলে খুলে যাবে আর অভিযাত্রীকে পানি থেকে ভাসিয়ে তুলবে। লাইফ জ্যাকেটের ওপর কোনো কাপড় বা ব্যাগ থাকলে সেন্সর কাজ করবে না।’
বুঝলাম, জ্যাকেটটা ওজনে যেমন ভারী, গুরুত্বেও!
হিমশীতল বাতাস ঘিরে ধরেছে আমাদের। মুখ ছাড়া শরীরের আর কোনো অংশে বাতাস বাহাদুরি দেখাতে পারছে না। প্রথম সামনাসামনি হিমশৈল দেখছি। সূর্যের রোদ এসে পড়েছে হিমশৈলের ওপর। সূর্যকিরণে চিকচিক করছে। তার পাশ ঘেঁষে মিনিট বিশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অজানা এক দ্বীপে।
আরও পড়ুন
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি
৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি
৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়