বাঘের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো
ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন অভয়ারণ্য জিম করবেট জাতীয় উদ্যান। উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালে অবস্থিত এই উদ্যানে হাতি, চিতাবাঘ, নীলগাই, সম্বরের মতো প্রাণী যেমন আছে, তেমনি আছে বেঙ্গল টাইগার। মুক্ত পরিবেশে সামনে থেকে সেই বাঘ দেখতেই জিম করবেটের অরণ্যে গিয়েছিলেন আলোকচিত্রী নুরুন্নাহার নাফিসা
বন্য প্রাণীর ছবি তুলি প্রায় এক যুগ। শুরু থেকেই স্বপ্ন দেখতাম জঙ্গলের মুক্ত পরিবেশে বাঘ দেখব, বাঘের ছবি তুলব। সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই ভারতের জিম করবেট জাতীয় উদ্যানে যাওয়া।
গত ৬ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটা। মারুতি জিপসি গাড়িতে জিম করবেটের ঢিকালা অঞ্চলের উদ্দেশে যাত্রা করি। অরণ্যে ঢুকতেই জেঁকে ধরে হিম ঠান্ডা। কুয়াশার চাদরে মোড়া ঢিকালার সৌন্দর্য অপরূপ। শুনেছি এখানেই বেঙ্গল টাইগারের বসত।
গাইড বললেন, ‘গাড়ি থেকে যেন কিছু না পড়ে।’ কেন পড়লে সমস্যা কী? সমস্যা আছে। কিছু পড়লে গাড়ি থেকে নেমে আর তোলা সম্ভব হবে না। উদ্যানের বাঘগুলো ক্ষুধার্ত থাকলে অনেক সময় মানুষের ওপর আক্রমণ করতেও দ্বিধা করে না। গাইডের সতর্কবার্তা শুনে ভয় ভয় করতে থাকে। আরও সাবধান হয়ে গাড়িতেই চুপটি করে বসে রইলাম।
সূর্য ওঠে। গাছের পাতার ফাঁক গলে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর এসে পড়ে সূর্যের নিরুত্তাপ কিরণ। কুয়াশায় মোড়া অল্প আলো প্রকৃতিকে আরও রহস্যময়, আরও মোহনীয় করে তোলে। এভাবে করবেটের সৌন্দর্য উপভোগ করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। প্রথম দিন বাঘ মহাশয়ের দেখা মিলল না!
সাফারির দ্বিতীয় দিন সকাল সাড়ে ছয়টায় যাত্রা শুরু করি। বনে ঢুকে গাড়িতে বসেই মাটিতে খুঁজতে থাকি বাঘের পায়ের ছাপ। যেভাবে পথিকের পায়ের ছাপ তার পথ চলার তথ্য দেয়, সেভাবে আমরা বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে তাঁকে খুঁজি। বনের ভেতরটায় আজ ঠান্ডা বেশি, রীতিমতো জমে যাচ্ছিলাম। আঙুল বের করে ক্যামেরার সাটার চাপতেও কষ্ট হচ্ছিল।
এমন সময় খান খান হয়ে যায় চারপাশের নীরবতা। যেন হঠাৎই জেগে উঠে ঘুমন্ত প্রাণিকুল। চিত্রাহরিণের চিৎকার শোনা যায়। বানরের দল এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফিয়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা কার আগমনের বার্তা! গাইড তখনই ফিসফিস করে বলে ওঠে, ‘ম্যাডামজি, শের য়েহি কাহি পে হে! (ম্যাডাম, বাঘ এখানেই কোথাও আছে!)’
বাঘের উপস্থিতি মুহূর্তের জন্য আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। আমি খুলনার মেয়ে। সুন্দরবনঘেঁষা গ্রামে আমার বাড়ি। প্রায়ই শুনতাম গ্রামে বাঘের আক্রমণের কথা। যাদের মধ্যে কম মানুষই বেঁচে ফিরে আসত। আর বাঘের মুখ থেকে যারা ফিরে আসত, তাদের দিকে তাকানো যেত না। বাঘের থাবায় চেহারা বিকৃত হয়ে যেত। মনের কোণে ভেসে ওঠে সেসব মানুষের মুখ।
কিছুক্ষণের জন্য ভয়ে আমার পুরো শরীর অসাড় হয়ে যায়। তারপর দৃষ্টি স্থির করি। তখনো কুয়াশা চাদর মুড়ি দিয়ে আছে পুরো অরণ্যে। উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক দিয়ে শনশন করে বয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। সামনে লাল মাটির পথ। শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে রোদে জ্বলে যাওয়া সোনালি রঙের ঘাস। আর এই পথ ধরেই রাজকীয় ভঙ্গিমায় হেঁটে আসছেন তিনি! কিছুদূর এসেই বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়েন। মুহূর্তে আবার বেরিয়েও আসেন। এবার আমাদের গাড়ির দিকে আসতে শুরু করলেন। কাছাকাছি এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। সে যে কি চাহনি। ভয়ে পুরো শরীর কেঁপে উঠল। এরপর রাস্তার পাশে ডান দিকে একটা উঁচু ডিবিতে উঠে পড়লেন। এবার বনের রাজার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। দূরত্ব ৭-৮ হাত মাত্র। মনের ভয়টাকে গিলে ফেললাম। ক্যামেরা হাতে অনবরত ছবি তুলতে থাকলাম।
তিনি দাঁড়িয়েই আছেন। আমাদের দেখছেন। এবার ছবি তোলা বন্ধ করে মন ভরে তাঁকে দেখে নিলাম। খুব শান্ত দুটো চোখ, যেন কোনো শান্ত নদী। গাছের ফাঁক দিয়ে তাঁর গায়ে এসে পড়েছে একঝলক রোদ। দৃশ্যটি হয়ে উঠেছে পটে আঁকা ছবির মতো।
একটু পরই তিনি পাশের ঝোপের দিকে এগোতে থাকলেন। একসময় হারিয়ে গেলেন ঘন জঙ্গলে। আমার চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকল। এ পানি স্বপ্ন পূরণের, আনন্দের।