সবচেয়ে বেশি সময় শ্রীলঙ্কার রাজধানী ছিল এই শহর
শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব।
সপ্তম দিন: অনুরাধাপুরার আশপাশ। দূরত্ব ১০ দশমিক ৫১ কিলোমিটার।
আজ দীর্ঘক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। অনুরাধাপুরা নামক শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা আজকের দিনে। টানা হাঁটাহাঁটির বালাই নেই। কিন্তু অভ্যাসবশত দেহঘড়িটা আগেই উঠে পড়েছে। এই গেস্টহাউসের আশপাশে কাঠবিড়ালির ভিড়। ওদের হুটোপুটি চলছেই। এ ছাড়া আছে নানা প্রজাতির ব্যাঙ। গ্রিন–টির কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হলো সকালটা। ব্যাগপত্তর রেখে ঝাড়া হাত-পায়ে শুধু ডে–প্যাকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গেস্টহাউসের সামনে থেকেই বাস পাওয়া গেল। অনুরাধাপুরের ব্যাংক প্লেস ক্লক টাওয়ারে নেমে হাঁটা শুরু। দুই কিলোমিটার হাঁটতেই নদী পাওয়া গেল। নদীটার নাম মালওয়াতু ওয়া। শীর্ণ নদীখাত; আখের ছোবড়ার ন্যায় কেউ এর সব রস শুষে নিয়েছে। আমাদের দেশীয় খালের প্রশস্ততার সমান চওড়া আর গোড়ালি অবধি পানি। এটাই নাকি শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী! আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গের জলাশয়গুলোর কেস। জলাশয়ের অত্যল্পতার কারণে ওখানে পুকুর হয়ে যায় দিঘি আর নামের শেষে সাগর নাম ধারণ করে আছে দিঘিগুলো! সরু এই নদী মালওয়াতু ওয়ারও নাকি পাঁচটি শাখা নদী আছে!
ছায়াবৃক্ষের তল ঘেঁষে ফুটপাতে হাঁটছি। অধুনাকালের মূল অনুরাধাপুরা শহর পেরিয়ে পা রাখলাম প্রাচীন ও পবিত্র নগরীতে। শ্রীলঙ্কার রাজধানী হিসেবে আমরা সবাই কলম্বোর নাম জানি। কলম্বো শ্রীলঙ্কার কার্যনির্বাহী ও বিচারিক রাজধানী হলেও একই সঙ্গে আরও একটি রাজধানী আছে। এই বিধানিক রাজধানীর নাম শ্রী জয়াবর্ধনেপুরা কোট্টে। এত লম্বা নামে কেউ অভ্যস্ত নয়। কোট্টে নামেই চেনে সবাই। ক্যান্ডি শহরও একসময় এই রত্নদ্বীপের রাজধানী ছিল। তবে ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যাবে যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী ছিল এই অনুরাধাপুরা। তাও প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছর ধরে!
প্রথমেই গেলাম ইশুরুমুনিয়া মন্দিরে। মূল ফটকের সামনের জলাশয়ে ইংরেজিতে সাবধানবাণী; ‘কুমির থেকে সাবধান’! কুমিরের দুই শক্ত চোয়াল থেকে নিজের দুখানা পা বাঁচাতে তড়িঘড়ি ঢুকে পড়লাম মন্দিরের কমপ্লেক্সে। ঢুকতেই সিংহশয্যায় বুদ্ধ। অন্যপাশে গুহার অভ্যন্তরে শিষ্যবেষ্টিত ভগবান তথাগত। এর পাশের চত্বরের ‘দ্য লাভারস’ নামের জাদুঘরটি এ যাত্রায় দেখা অন্যান্য জাদুঘর থেকে বেশ আলাদা। বিশাল সব উপলখণ্ড কুঁদে বানানো নানান মূর্তি। সবচেয়ে সুন্দর সম্ভবত ডান্সিং ডোয়ার্ফ বা নৃত্যরত বামন। একটু এগিয়েই বিশাল একটা পাথরের ওপর মন্দির। সিঁড়ির সোপান আর রেলিংয়ে ভর করে উঠতে হয়। ওপরে ছোট আকৃতির স্তূপা। বিকট এক পাথর ফুঁড়ে ওঠা অশ্বত্থগাছের ঠিক পাশেই ছোট্ট একটা জলাশয়। নানা প্রজাতি আর আকারের মীনকুলের সদস্য আছে জলাশয়ে। এই মন্দির কমপ্লেক্সে ভ্রমণে আসা পশ্চিমা পর্যটকেরা পড়েছে মুশকিলে। ধর্মীয় কারণে শর্টস পরিহিত কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য এই মুশকিলেরও আসান আছে। শর্টসের ওপর তোয়ালে পেঁচিয়ে ঢুকছে ওরা!
ইশুরুমুনিয়ার পেছনেই থিসসা ওয়েয়া। উঁচু পাড়ের প্রকাণ্ড এক জলাশয়। ‘সিংহলা ওয়েয়া’ শব্দের অর্থ ‘জলাশয়’। থিসসা ওয়েয়ার জল মাথায় সফেদ ফেনা নিয়ে ঢেউ ভাঙছে পাড়ের কালচে পাথরে। পুরো জলাশয়কে বেষ্টন করে আছে পায়ে চলার লাল মাটির রাস্তা। এই জলাশয়ের বয়স প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর। এখান থেকে নিচে নেমে বাঁয়ে কয়েক শ মিটার গেলে রনমাসু উয়ানা। ‘রনমাসু’ শব্দের অর্থ ‘গোল্ডফিশ’। জলজ জীবন নিয়ে একটি পাথরের ওপর আঁকা সুন্দর শিলালিপি আছে। এটির বয়সও প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছর। একটু এগিয়ে ছোট্ট পকুনা বা পুকুর। সামনে আরও একটা ছোট্ট জলাশয়। ধারণা করা হয় যে থিসসা ওয়েয়ার জল এই রনমাসু উয়ানাতে সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে আশপাশের ধান খেতে সেচের কাজে সরবরাহ করা হতো।
আমাদের পরের গন্তব্যে দুইভাবে যাওয়া যায়। বনের মধ্য দিয়ে মাটির রাস্তার শর্টকাট, যদিও এটি অপেক্ষাকৃত নির্জন; বালুময় রাস্তাটুকু বাদে চারপাশের পুরোটাই সবুজ। অন্য বিকল্প হলো, মূল গাড়ির রাস্তা ধরে এগোনো। আমরা সবুজে ছাওয়া মাটির রাস্তাই বেছে নিলাম। মিরিসাওয়েতিয়া রাজমহা বিহারে ঢোকার জন্য খালি পায়ে পাথুরে জমিনে পা রাখতেই মনে হলো, কেউ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ফেলে দিয়েছে আমাদের। মাটিতে পা রাখাই দায়। সাদা রঙের গম্বুজাকৃতি এই বিহারে নতুন রঙের ছোপ লেগেছে। তীব্র দাবদাহে বেশিক্ষণ তিষ্ঠানো গেল না। অবশ্য পুণ্যলোভাতুরেরা এসব থোড়াই কেয়ার করছেন! ওই গনগনে তপ্ত পাথরের ওপর নগ্ন পায়ে প্রদক্ষিণ করেই যাচ্ছেন তাঁরা। একটু এগিয়ে পুরোনো জেলখানা পড়ল। স্থাপনকাল ১৮৬৭ সাল।
কাছেই অশ্বত্থতলে দুপুরের খাবার খাচ্ছে স্কুলের শিশুরা। এখান থেকে বেরিয়ে আর্কিওলজিক্যাল জাদুঘর। অন্য প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের তুলনায় এটি বেশ বড়। পঞ্চম থেকে একাদশ শতাব্দীর নানা গ্রানাইট পাথরের মূর্তি আর শিলালিপি আছে এখানে। জাদুঘর পর্ব শেষ করে বাসাউক্কুলামা জলাশয়ের পাশে গাছের ছায়ায় বসলাম। মনপ্রাণজুড়ানো হাওয়া অশ্বত্থতলে। এখানে জয়া শ্রী মহাবোধি চত্বরে প্রবেশ করার জন্য টিকিট কাউন্টার আছে। এই মহাবোধি ভারতের বুদ্ধগয়ায় অবস্থিত বোধিগাছের কলম থেকে সৃষ্ট। মহাবোধিগাছের নিচেই আলোকত্ব লাভ করেন একসময়ের শাক্য রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। এই চত্বরে প্রবেশ করতে হলে গুনতে হবে ৯ হাজার শ্রীলঙ্কান রুপি। গত কয়েক দিনে হাজারখানেক বোধিবৃক্ষ দেখে ফেলায় ও পথে যাওয়ার জন্য জুমন ভাই আর আমি কেউই আগ্রহ দেখালাম না। এর চেয়ে জলাশয়ের পাড়ের বোধিদ্রুমের ছায়ায় আরও কিছুটা সময় কাটানো যাক!
গাত্রোত্থান করে গেলাম লোক জাদুঘরে। সংস্কারের জন্য বন্ধ থাকায় ফিরতে হলো বিফল মনোরথে। আরও খানিকটা পথ এগিয়ে অনুরাধাপুরার বিখ্যাত দক্ষিণ স্তূপা। লাল পোড়ামাটির তৈরি বিশাল ব্যাসার্ধের স্তূপায়ও চলছে সংস্কারের ঝনঝনানি। ইট-সুরকিসমেত শ্রমিকদের ব্যস্ততা পুরো প্রাঙ্গণেই। ডানে মোড় ঘুরে কিছুটা এগিয়ে টিনের ছাউনির নিচে সারানান্দ প্রিভেনা বুদ্ধমূর্তি। অনুরাধাপুরায় এত বড় বুদ্ধমূর্তি আর চোখে পড়েনি। পাশেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মঠ। শ্রীলঙ্কান ছাড়া অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীও আছে এই মঠে।
আরও ছোট ছোট অনেক দর্শনীয় স্থান দেখা হলো পথে। কিছু নির্মাণাধীন বৌদ্ধবিহারও দেখলাম। এবার ফিরতি পথে চলা। অনুরাধাপুরার পবিত্র নগরীতে রাস্তার ধারে হঠাৎ একটা কিংবা দুটো দোকান মেলে। এক জায়গায় আম কিনে খেলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, রাস্তার ধারে এক জায়গায় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার পেঁয়াজের আকার বেশ ছোট! আমাদের দেশে এমন পেঁয়াজ ঘরে আনলে বাড়ির কর্তার সঙ্গে গৃহিণীর রীতিমতো গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে! পেঁয়াজের ঝাঁঝের চেয়ে কথার ঝাঁঝে কুপোকাত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা!
বিবেকানন্দ তামিল মহাবিদ্যালয় পেলাম পথে। বিকেলছোঁয়া দুপুরে হন্যে হয়ে খাবারের দোকান খুঁজেও সুবিধা করতে পারছিলাম না। হঠাৎ জামে মসজিদের সামনে একটা মুসলিম হোটেল পাওয়া গেল। ওখানে ভরপেট খেয়ে আবার ব্যাংক মোড়ের ক্লক টাওয়ারের সামনে। কবজিতে সেঁটে থাকা ঘড়ি বলছে, বিশ্রামের দিনেও হেঁটেছি প্রায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এখানেই বাসের জন্য অপেক্ষা। ফিরব কালাট্টেওয়ার গেস্টহাউসে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও কোন বাস কালাট্টেওয়ায় যাবে, সেটার সুরাহা করতে না পেরে পাশে দাঁড়ানো এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম। ও শুধু কালাট্টেওয়া শব্দটুকু বুঝেছে। ফোন টেপাটিপি করে সিংহলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফোনের স্ক্রিনে দেখিয়ে বলল, ‘কাম উইথ মি, আই অ্যাম অলসো গোয়িং টু কালাট্টেওয়া।’
ছেলেটার পিছু পিছু বাসে উঠতেই আবার সিংহলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্থানীয় শ্রীলঙ্কান তরুণের সঙ্গে এসব করছি, অন্যদিকে জুমন ভাই বাসের একদম পেছনের সিটে বসে পাশের ছেলেটার ওপর ঘুমে গড়িয়ে পড়ছেন! অবশ্য ছেলেটার গায়ে হেলে পড়লেই পাশে বসা গার্লফ্রেন্ড জুমন ভাইয়ের মাথা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে! গেস্টহাউসে এসে সোজা সুইমিং পুলে। আগের দিন দেখলেও কাপড় ধোয়ার তাড়ায় নামা হয়নি। দুই হাজার বাংলাদেশি টাকার সমমূল্যের কক্ষে সুইমিং পুল পাওয়া যেতে পারে, এটা ভাবিনি। এটা অবশ্য মালকিনের পরিবার ব্যবহার করে। মালকিন আগের দিনই জানিয়ে রেখেছিলেন যে আমরা চাইলেই এটা ব্যবহার করতে পারি। সন্ধ্যায় গেস্টহাউসের মালকিন কেক বানিয়ে দিলেন আমাদের জন্য। আর রাতে কেয়ারটেকার আন্টির সবজি রান্নার সঙ্গে তিন পদের ফলাহার! এত যত্নআত্তি শেষ কবে পেয়েছি, মনেই পড়ছে না! (চলবে)
৩ অক্টোবর ২০২৪