ডেঙ্গু রোধের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা পেলেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার
স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবছরই বেশ বড় পরিসরে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইইই)। এ বছর রোবোটিকসের এই প্রতিযোগিতায় ১৬০টির বেশি দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের একটি দল, নাম টিম হকআই। দলের সবাই তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। সদস্যরা হলেন মায়িশা হক (দলনেতা), অঙ্কন দেব, আসিফ ইসলাম ও শেখ ইফতেখার আহমেদ। এ ছাড়া প্রজেক্ট সুপারভাইজার ছিলেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সেলিয়া শাহনাজ ও অধ্যাপক শেখ আনোয়ারুল ফাত্তাহ।
প্রতিযোগিতা হয়েছে মূলত আইইইই রিজিয়ন-১০, অর্থাৎ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি দেশের ৬০টি শাখার মধ্যে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই অঞ্চলের মধ্যে পড়ে।
যে প্রকল্পের জন্য পুরস্কার
‘রোবোটস ফর ম্যানেজিং ক্লাইমেট চেঞ্জ ফর আ বেটার ওয়ার্ল্ড’—এ-ই ছিল এবারের প্রতিযোগিতার প্রতিপাদ্য। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রোবটকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, প্রতিযোগীদের সে নকশাই করতে বলা হয়েছে। টিম হকআই ঠিক করেছিল, তারা কাজ করবে ডেঙ্গু নিয়ে। মশার বংশবিস্তার রোধে দলটি তৈরি করে ‘দ্য এরিয়াল ওয়ারিয়র: ফাইটিং অ্যাগেইনস্ট মসকিউটো মেনাস’ নামে এক বিশেষ প্রকল্প। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে তৈরি এই ড্রোনভিত্তিক ব্যবস্থায় ক্যামেরার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করা যায়।
মশা দমনে ড্রোনের মাধ্যমে বায়োলজিক্যাল কীটনাশক স্প্রেও করা সম্ভব। প্রকল্প সম্পর্কে দলনেতা মায়িশা হক বলেন, ‘বায়োলজিক্যাল কীটনাশক স্প্রে করার সুবিধা হচ্ছে, এতে লার্ভা অবস্থাতেই মশা মারা যাবে। পাশাপাশি ড্রোনের মাধ্যমে জিপিএস লোকেশন সেভ করে, ডেঙ্গু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানচিত্র (রিস্ক জোন ম্যাপ) তৈরি করা যাবে, যেন কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরা ড্রোনটির নির্মাণ খরচ যথাসম্ভব কম রাখার চেষ্টা করেছি, যেন একটি ভালো বিজনেস মডেল হিসেবে একে দাঁড় করানো যায়।’
সহজ ছিল না পথচলা
সরাসরি মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ হকআইয়ের ছিল না। চারটি ধাপে লড়তে হয়েছে। শুরুটা হয় গত ২৪ জুন। বাংলাদেশের দলগুলোকে নিয়ে একটি আইডিয়াথনের আয়োজন করেছিল আইইইই বাংলাদেশ শাখা। ১৭টি দলের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হকআই সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর আরও কয়েক ধাপে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে থাইল্যান্ডে আমন্ত্রণ পান তাঁরা।
৯ ও ১০ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় আইইইই রিজিয়ন-১০ রোবোটিকস প্রতিযোগিতার মূল আসর। প্রথম দিন রোবোটিকস বিশেষজ্ঞদের সামনে প্রকল্প উপস্থাপন করতে হয়। আর দ্বিতীয় দিন ছিল পোস্টার উপস্থাপন। টিম হকআই দুই দিনই পেয়েছে বিচারকদের প্রশংসা, জিতেছে চ্যাম্পিয়নের খেতাব। পুরস্কার হিসেবে সনদ ও ৫০০ মার্কিন ডলার তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে। মায়িশা হক বলেন, ‘থাইল্যান্ডে যাওয়ার সময়ই বাংলাদেশের একটা পতাকা সঙ্গে নিয়েছিলাম; পুরস্কার পেলে মঞ্চে সবার সামনে মেলে ধরব, এ আশায়। বিজয়ের মাসে নিজের দেশের নাম, নিজের দেশের পতাকা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামনে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছি, এটাই বড় সাফল্য।’ প্রকল্পের সুপারভাইজার অধ্যাপক সেলিয়া শাহনাজ বলেন, ‘ডেঙ্গু যেহেতু বাংলাদেশসহ অনেক দেশেরই ভয়াবহ সমস্যা এবং প্রচলিত সমাধান খুব একটা সুফল পাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রকল্পটি কার্যকর সমাধান হবে বলে আশা করি।’
বিচিত্র অভিজ্ঞতা
প্রায় সাত মাস প্রকল্পের পেছনে খেটেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরা। অম্লমধুর নানা অভিজ্ঞতায় এ সময় তাঁদের ঝুলিতে জমা হয়েছে। যেমন পোস্টার উপস্থাপন ধাপে বিচারক ছিলেন থাইল্যান্ডের একজন এভিয়েশন ও ড্রোন বিশেষজ্ঞ। তিনি হকআইয়ের প্রকল্প এতটাই পছন্দ করেন যে নিজের দেশেও এটি প্রয়োগের আশা ব্যক্ত করেন।
একই প্রকল্প আরও দুটি প্রতিযোগিতায় জমা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে একটিতে দ্বিতীয় এবং অন্য একটি প্রতিযোগিতায় ‘বেস্ট ট্রান্সফরমেটিভ বিজনেস’ আইডিয়া পুরস্কার পান তাঁরা। দ্বিতীয় পুরস্কার সনদ ছাড়াও পেয়েছেন আড়াই হাজার মার্কিন ডলার।
প্রকল্পের মূল ডিজাইন, হার্ডওয়্যার এবং অটোমেশন স্থাপনের (ডিপ্লয়) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অঙ্কন দেব। তিনি বলেন, ‘ড্রোন বানিয়ে এটাকে ওড়ানো একটা কঠিন কাজ। নকশায় সামান্য ত্রুটি থাকলেই পড়ে যেতে পারে। এ কাজ আরও কঠিন হয়ে যায়, যখন এর সঙ্গে অটোমেশন আসে, কোডিংয়ের কাজ আসে। কারণ, এ ধরনের কাজ আগে হয়েছে কি না, সে রকম কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে ছিল না।’
ইফতেখার আহমেদ এবারই প্রথম রোবোটিকস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এত দিন একাডেমিক পাঠ্যক্রমে যেসব তত্ত্ব পড়েছি, সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি। ক্লাস, ল্যাবের পড়াশোনা সামলে কীভাবে আমরা মাত্র তিন মাসে একটা ড্রোন তৈরি করলাম, শুনে বিচারকেরাও অবাক হয়েছেন। প্রশংসা করে তাঁরা বলেছেন, আমাদের প্রকল্পটিই ছিল সবচেয়ে জটিল।’ দলনেতা মায়িশা হক জানান, এ প্রতিযোগিতার জন্য তাঁদের ওয়েবসাইট তৈরি করা শিখতে হয়েছে। মেশিন লার্নিং-সংক্রান্ত কাজগুলোও ছিল তাঁদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। তবে যত বাধাই আসুক, খালি হাতে ফেরা যাবে না—এ প্রত্যয় তাঁদের শুরু থেকেই ছিল।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যের পর প্রকল্পটিকে দেশের কাজে লাগাতে চান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরা। মায়িশা হক বলেন, ‘মশা নিধন বা লার্ভার উৎপত্তি প্রচলিত ব্যবস্থায় ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, স্মার্ট ডেটাবেজড প্রযুক্তি ব্যবহার না করা। আমরা এ সমস্যা বা সীমাবদ্ধতার একটা সময়োপযোগী সমাধান বের করেছি। সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আশা করি খুব দ্রুত মশাবাহিত রোগ ও মৃত্যু ঠেকানো অনেকাংশেই সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমরা সহযোগিতা করতে চাই।’