শিশুরা কোন বয়সে কী ভয় পায়

শিশুরা একেক বয়সে একেক ধরনের বিষয় ভয় পায়। মডেল: রাদীনছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শিশুরা ভয় পায়। একেক বয়সে শিশুর ভয় পাওয়ার ধরনেও লক্ষ করা যায় ভিন্নতা। আট মাসের শিশু যে কারণে ভয় পাবে, দুই বছরে সেটি আর পাবে না। এই পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক। তবে চিন্তা, উদ্বেগ আর চাপের বেড়াজালে শুধু বড়রাই নয়, ছোটরাও এসব বিষয় মোকাবিলা করে। উদ্বেগ যদি আপনার সন্তানের মানসিক, শারীরিক বা সামাজিক বিকাশে বাধা দেয়, তখন সমাধান করার রাস্তাটাও বের করে ফেলতে হবে। বয়স অনুযায়ী শিশুদের চিন্তা আর উদ্বেগেও থাকে ভিন্নতা। তাই জেনে রাখুন, কোন বয়সের শিশু কিসে ভয় পেতে পারে।

তিন বছর বয়স পর্যন্ত

এক দিন থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা বেশ কিছু বিষয়কে ভয় পায়। এর মধ্যে আছে—

  • হঠাৎ নড়াচড়া করলে।

  • জোরে শব্দ হলে।

  • অপ্রত্যাশিত কিছু শিশুর সামনে ঘটলে।

  • অচেনা ঘটনা ঘটলে।

  • চেনা মানুষের কাছ থেকে অচেনা মানুষের কাছে এলে।

  • বাড়ির চেনা পরিবেশ বদলে গেলে।

অজানাকে ভয় পাওয়া বড় হওয়ার পথে একটি স্বাভাবিক অংশ। মস্তিষ্কের বিকাশের গতির কারণে শিশুরাও উদ্বিগ্ন হতে পারে। এই সময়ে শিশু নিয়মিত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। ব্যাখ্যা দিয়ে সেগুলো নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করে। এটা তাদের জন্য বেশ ব্যস্ত একটা সময়। কারণ, শিশুরা প্রায় তিন বছর বয়স পর্যন্ত ঠিকমতো তাদের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে উদ্বিগ্ন এবং হতাশ হয়ে পড়ে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) মেখলা সরকার জানালেন, ‘শিশু অনিরাপত্তাবোধ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তাই প্রথম যে চিৎকারটা দেয়, সেটাতেও অনিরাপত্তাবোধই প্রকাশ পায়। প্রথম এক-দুই বছর কিছু করতে পারে না তারা। মনে করে, এই মুহূর্তে সামনে যেটা নেই, সেটা আর কখনো আসবে না। এ কারণে আপনি ঘর থেকে ১০ মিনিটের জন্য বের হলেই, তারা ভেবে নেয় আপনি একেবারে চলে গেছেন। তাই সে ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। এই সময়টা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে, যেটা একদমই সাধারণ। আট মাসের পর থেকে শিশু অপরিচিত কোল ভয় পায়, হাঁটতে শুরু করলে বাইরের পৃথিবীকে ভয় পায়। এটা চলে প্রায় তিন বছর পর্যন্ত। ধীরে ধীরে এ সময়টার ভেতরে তারা সুগঠিতভাবে কথা বলতে চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য শব্দভান্ডার তৈরি করে। শিশুরা মা–বাবার কাছ থেকে সচেতনভাবে বা অবচেতন মনেই অনেক কিছু শিখে নেয়। এ সময় খেয়াল রাখা উচিত, আপনি ওদের সামনে কীভাবে কথা বলছেন, কী কাজ করছেন বা কেমন আচরণ করছেন।

প্রাক্‌-স্কুলের ভয়

তিন বছরের পর অনেক শিশুকেই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এ সময় ভয় বা মানসিক চাপ হিসেবে কাজ করে অনেক কিছু। যেমন—

নতুন জায়গায় ভয়, অন্ধকার পরিবেশ, রাতে কোনো আওয়াজ হওয়া, মুখোশ, ভূত আর রাক্ষস; প্রাণী, বিশেষ করে কুকুর।

চেনা পরিবেশের সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া নিয়ে একধরনের আতঙ্ক বা উদ্বেগ কাজ করে এই সময়। এত দিন পর্যন্ত আশপাশের পরিবেশের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল শিশুদের। এখন নতুন জায়গায় যাওয়া নিয়ে ভীতি কাজ করতে শুরু করে। মানসিকভাবে দুর্বল থাকে তারা। রাগ আর অস্থির ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের এ ভয়টাকেই যেন প্রকাশ করতে চায় সে। তেলাপোকা, লিফট, সামাজিক মেলামেশা, আবদ্ধ জায়গা তখন ভয়ের কারণ হয়। একা ঘুমাতে ভয়ের কারণটি মেখলা সরকার ব্যাখ্যা করলেন খুব সুন্দরভাবে, ‘অনেক মা সন্তানদের আগলে রাখেন প্রতিরক্ষামূলকভাবে। বেশির ভাগ সময় নিজের কাছেই আটকে রাখেন। শিশুকে মনে করান যে মায়ের কাছেই সে নিরাপদ। এ কারণে শিশু একা একা ঘুমাতে ভয় পায়। অন্ধকারের ভয় পাওয়ার বিষয়টি অনেক সময় ফবিক ডিজঅর্ডার থেকে হয়। সামাজিকভাবে মেলামেশার বিষয়টিও এই ফবিক ডিজঅর্ডার থেকেই হয়। যারা অন্তর্মুখী, তাদের অসুবিধা হয় বেশি।’

প্রাক্‌-স্কুল বয়সী শিশুর কল্পনাকে বাস্তব থেকে আলাদা করতে অসুবিধা হয়। শোয়ার সময় ভয়, অন্ধকারের ভয়, বিছানার নিচে দানব থাকে ভেবে একা ঘুমানোর ভয়—এগুলো এই বয়সের জন্য সাধারণ। এ কারণে এই বয়সে মুখোশ পরে নতুন কোনো সাজে কেউ এলে শিশুরা ভয় পেয়ে যায়। তিন বা চার বছর বয়সী শিশুদের কাছে ভবিষ্যৎ একটি চিন্তার কারণ। তাদের যখন বলা হয় সামনেই স্কুল শুরু হবে, এতে তারা শঙ্কিত হয়।

স্কুলে পড়ার সময় ভয়

স্কুলের পরিবেশে মানিতে নিতে পারবে কি না, সেটা নিয়েও শিশুরা শঙ্কায় থাকে
ছবি: প্রথম আলো

ছয়–সাত বছরে এসে ভয়ের কারণ হয় ভিন্ন রকম। এ সময় একটু বড় হওয়ার কারণে তারা অনেক কিছুই বুঝতে পারে। ভয়ের কারণগুলোও যেন একটু পরিপক্ব হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাপ, ঝড়বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাসায় একা থাকা আর শিক্ষকদের রাগ এই বয়সে ভয়ের মধ্যে অন্যতম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর শিশুরা মা–বাবার চেয়ে শিক্ষককেই যেন বেশি ভয় পায়। শিক্ষক কিছু বললে সেটা তারা মানার চেষ্টা করে অক্ষরে অক্ষরে। শিশুরা বাড়িতে একলা থাকতেও ভয় পায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা মা–বাবা ছাড়া পুরো বিশ্বকেই অনিশ্চিত ভাবে। তাঁদের ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে কি না, সেটা নিয়েও শঙ্কায় থাকে।

১২ বছরের ওপর গেলে

আরেকজন তাকে কীভাবে দেখছে বা কী ভাবছে, এটা তাদের কাছে বিশাল এক ভাবনার বিষয় হয়। অর্থাৎ ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তিত। বয়ঃসন্ধিকাল হলে প্রশ্ন করতে শুরু করে ‘আমি কে এবং এখানে কী করছি?’ এই বয়সে, কিশোর-কিশোরীরা সামাজিক মিথস্ক্রিয়াগুলোর গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে শুরু করে। সেলফি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু জানা থেকে বাদ পড়ল কি না, ফটোশপের মতো বিষয় তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ বিষয়গুলোতে না থাকলেই তারা ভয় পেয়ে যায়। কিশোর-কিশোরীরা ব্যর্থতার পরিণতি বুঝতে শুরু করে। পরীক্ষায় খারাপ নম্বর পাওয়া বা খেলার মাঠে ভালো খেলতে না পারাটা ভয়ের কারণ হয়। এ সময় শারীরিক কাঠামো, চুল, ত্বক, বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকে। অনেক বেশি আত্মসচেতন হয়ে ওঠে নিজের বিষয়ে।

শিশুর ভয় কাটানোর অনেক উপায় আছে। তবে আপনার শিশুর জন্য কোনটা ভালো হবে সেটা আগে বুঝে নিন। ভয় থেকে সন্তান যদি একেবারেই স্কুলে যেতে না চায়, অনেক সময় বাহানা করে পেটব্যথার। এ ব্যথাটা কিন্তু আসলেই ওর হচ্ছে, সেটা উদ্বেগ থেকে। মা অথবা বাবা শিশুর সঙ্গে স্কুলে যেতে পারেন। ভেতরে ঢোকার সুযোগ থাকলে ভেতরেও যান। না হলে অভয় দেন যে গেটের বাইরে আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন ওর জন্য। একদম যেতে না চাইলে স্কুলের পোশাক পরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন গেটের সামনে থেকে। ধীরে ধীরে বিষয়টি সে গ্রহণ করবে, আশঙ্কা কমে আসবে। মেখলা সরকার বলেন, ‘যে বিষয়ে শিশু ভয় পাচ্ছে সেটিকে ধীরে ধীরে কাটিয়ে তুলতে হবে। অন্ধকার আর একা ঘুমাতে ভয় পেলে, ঘরে প্রথমে ডিম লাইট বা হালকা আলোর টেবিল ল্যাম্প ব্যবহার করুন। সন্তানের সঙ্গে ঘুমান, তবে সে ঘুম থেকে ওঠার আগেই আপনাকে চলে যেতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, সে একলাই ঘুমিয়েছিল সারা রাত। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। মানুষের সঙ্গে মিশতে না চাইলে সেটাও বোঝাতে হবে অন্যভাবে।’

আরও পড়ুন