আপনারও কি মনে পড়ে উল বোনা সেই দিনের কথা
মানুষের হাতে এখন সময় বড় কম। উল দিয়ে পোশাক বানানোর মতো এত সময় তাঁর কই? বাড়িতে বোনা উলের পোশাক এখন তাই দেখা যায় খুবই কম। তবে বাজারে উলের পোশাকের কদর কিন্তু কমেনি; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে।
ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শ্রেণিতে স্কুলের সেলাই পরীক্ষায় উলের মোজা বুনতে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম, চাপ নেই, উল তো আমি বুনতেই পারি। বুনেও ছিলাম। কিন্তু সেলাই শিক্ষকের কাছে উলের এক পাটি রঙিন মোজা যখন জমা দিতে গেলাম, আবিষ্কার হলো, মোজার মাঝামাঝি দুটো ঘর পড়ে গেছে। এই যা, আর তো সময় নেই।
এত সতর্ক থেকে মনোযোগ দিয়ে উল বুনতে গিয়েও ভুল করলাম! আর মা, খালা, চাচিদের যে দেখি কথা বলতে বলতে, বাসে–ট্রেনে যেতে যেতে, টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখতে দেখতে একটুও ভুল না করে বানিয়ে ফেলেন বাবার জন্য একখানা উলের হাফ সোয়েটার, ভাইয়ের জন্য নকশা করা মাফলার কিংবা পরিবারে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর জন্য রঙিন টুপি। এমনকি অফিসে আসা–যাওয়ার পথেও থেমে থাকত না তাঁদের হাত। যেন হাত দুটোতে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে, দুটো কাঁটা তার অস্ত্র। বাঁ হাত দিয়ে একটা কাঁটা ধরে ডান হাতের তর্জনী বরাবর আরেকটি কাঁটা দিয়ে উল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক এগিয়ে যেতেন লক্ষ্যে। কী অনায়াস! পায়ের কাছে ঝুড়িতে রাখা উলের রঙিন গোলা ছোট হতে থাকত ক্রমেই।
স্মৃতিতে আছে স্কুলে ছাত্রীদের শ্রেণির কাজ দিয়ে আপারা ব্যাগ থেকে বের করতেন অর্ধসমাপ্ত উলের কাজ। মেয়েরা যতক্ষণ লিখত বা অঙ্ক করত, খাতা জমা পড়ার আগপর্যন্ত ঠিক হাত দুটো চলত রোবটের মতো। মায়েরা যাঁরা স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিতে আসতেন, গেটের বাইরে অভিভাবক–ছাউনিতে পরস্পরের সঙ্গে গল্প করতে করতে বুনতেন উল।
এটা ঠিক, এসব দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না। হয়তো কেউ কেউ বোনেন, তবে সংখ্যায় যে কমেছে, তার জন্য জরিপ–গবেষণার দরকার নেই। তাই তো এখন কেউ যদি কারও জন্য নিজ হাতে বুনে কোনো উলের কিছু উপহার দেন, তার দাম লাখ টাকা! ২০০২ সালে ছেলের জন্মের পর দেশ–বিদেশের আপনজনদের কাছ থেকে ওর জন্য অনেক উপহার পেয়েছি। তবে কিছু স্মৃতি মাখানো জিনিসের মধ্যে দুটো জিনিস যত্নে রেখে দিয়েছি এতটা বছর ধরে—মা ও আমার এক চাচির হাতে বোনা দুটো উলের সোয়েটার। যতবার আলমারির তাক ঝাড়পোছ করি, ততবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি সাদা উলের ধারে চকলেট রঙের বর্ডারের হাফ সোয়েটারটি আর গাঢ় নীল, হালকা নীল উলের ফুলহাতা ছোট দুটো সোয়েটার দেখে। তবে এটা ঠিক, বাড়িতে বোনা উলের পোশাকের হার কমলেও বাজারে উলের পোশাকের কদর কমেনি এতটুকু; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এগুলোর নকশা–বৈচিত্র্য।
মানুষের হয়তো এখন সময় কম। পথে গাড়িঘোড়ার চাপ থেকে শুরু করে মানসিক চাপ। সময় কোথায় সময় নষ্ট করার? দেশে তৈরি পোশাকশিল্পের উত্থান স্বল্প মূল্যে গরম কাপড় কেনার সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। পথের ধারের ভ্যানগাড়িতেই পাওয়া যাচ্ছে পছন্দের শীতপোশাক। কে হায় এক সোয়েটারের জন্য এক মাস অপেক্ষা করে?
তবে এটা ঠিক, নরম নরম তুলতুলে রঙিন উলের গোল্লাগুলোকে বড় মনে পড়ে। শীতের আগমনের সঙ্গে বাড়িতে ওই রঙিন উলের আগমনের একটা যোগসূত্র ছিল।
উল বোনার নস্টালজিয়া যে শুধু আমাদের দেশেই, তা কিন্তু নয়। ছাত্রজীবনে একটা অনুষ্ঠানের জন্য জাপানি গান শিখেছিলাম। অর্থ না বুঝেই আমরা গেয়েছিলাম। যেন শুধু কিছু সুরেলা শব্দ। বাঙালি একজনকে বিয়ে করে এ দেশে থেকে যাওয়া এক জাপানি নারী আমাদের বুঝিয়েছিলেন গানের অর্থ। ...যুদ্ধে গেছে এক জাপানি মায়ের সন্তান। তার পথ চেয়ে বসে আছেন মা। অপেক্ষা করছেন আর ছেলের জন্য বুনছেন উলের দস্তানা। উলের প্রতিটা ঘর বুনছেন আর তাঁর চোখ থেকে ঝরছে এক ফোঁটা করে পানি। ...সঙ্গে সঙ্গেই ওই গানের আবেগ আমাদের স্পর্শ করেছিল। চোখের সামনে ভাসছিল সেই জাপানি মায়ের মমতা মাখানো উলের দস্তানা বোনার ছবি।
আমাদের আজকের ‘নকশা’র ফটোসেশনে অংশ নিয়েছেন চিরসবুজ অভিনেত্রী দিলারা জামান। পুরো আয়োজনের সময়টিতে নিজেই বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন নিজের অতীতে। নিজের হাতে মেয়েদের জন্য বুনতেন উলের শীতকাপড়। মমতায় মাখানো। কী আশ্চর্য, তাঁর বর্ণনার চিত্র আর সেই অদেখা জাপানি মায়ের যে কল্পনা, দুজনের মধ্যেই যেন বড় মিল!