১৮ বছর পর সেই মিলি আবার কলম ধরলেন, লিখলেন নিজের হার না মানার কথা
বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি থেকে একদল শিক্ষার্থী এসেছিলেন। আমার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন, ‘এই হচ্ছে মিলি, ও যখন স্কুলে পড়ে, তখন তার বিয়ে হয়ে যায়। তবে সে থেমে যায়নি। লেখাপড়া শেষ করে এখন সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। থেমে না যাওয়া, হার না মেনে নেওয়াই বাংলাদেশ।’
লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কাউটিং ও খেলাধুলা ছিল আমার দুরন্ত শৈশব-কৈশোর। পরিবারে আর্থিক সংকট থাকলেও তিন সন্তানের লেখাপড়ার চাকা সচল রাখতে তৎপর ছিলেন আমাদের মা–বাবা। হঠাৎ পারিবারিক সিদ্ধান্তে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার যখন বিয়ে হয়ে গেল, সবাই একবাক্যে বলেছিলেন, মেয়েটার ভবিষ্যৎ শেষ! লেখাপড়া তো হবেই না, জীবনটাও শেষ হয়ে গেল। এত পারব না, হবে না, সম্ভব না শুনে আমার কেবল মনে হয়েছিল, পারতে আমাকে হবেই। লেখাপড়া শেষ করে নিজের পরিচয় আমাকে তৈরি করতেই হবে।
লেখাপড়া শেষ করার পথে সহযোগিতা-অসহযোগিতা দুটিই ছিল। তবে লক্ষ্য ছিল স্থির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর শৈশব-কৈশোরের স্বপ্নটা বাস্তব হয়ে উঠতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম আলোতে ‘আশার প্রদীপ জ্বালি’ শিরোনামে একটা ফিচার লিখেছিলাম। ২০০৫ সালের ১৬ মার্চ ‘নারীমঞ্চ’ পাতায় সেটি প্রকাশিত হয়।
অন্য অনেক সহপাঠীর মতো বিশ্ববিদ্যালয়েই শুরু হয় আমার কর্মজীবন। প্রথম বর্ষে থাকতে আমাদের এক শিক্ষকের সূত্রে আমরা তিন বান্ধবী খণ্ডকালীন চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলাম। অতি সুপরিচিত সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানতে চাইলেন, আমরা কে কোথায় থাকি। আমি জানিয়েছিলাম, আমি বিবাহিত, স্বামীর সঙ্গে থাকি। বাকি দুই বান্ধবীর চাকরি হলেও আমার হলো না! কাজ কী পারি, দক্ষতা কতটুকু, এসব গুরুত্ব পায়নি। বিবাহিত বলেই চাকরিটা সেদিন হয়নি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, লেখাপড়া ও সংসার করে কাজে মন দিতে পারব না!
আমার দুই বান্ধবীর যেদিন চাকরি হলো, বাসায় ফিরে আমার অনেক মন খারাপ হয়েছিল। আমার স্বামী বললেন, মন খারাপ কোরো না। বিবাহিত হওয়ার জন্য যেখানে চাকরি হয়নি, সেখানে চাকরি না করাই ভালো।
ঢাকায় যখন আসি, তখন কাউকে চিনতাম না। তবে কাজ করতে চাওয়া আর শিখতে চাওয়ার প্রবল আগ্রহে নিজের চেষ্টাতেই পথ তৈরি করলাম। বান্ধবীদের চাকরি পাওয়ার দুই মাসের মাথায় তাদের দ্বিগুণ বেতনে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি পেলাম। নিজের আগ্রহে প্রথম আলোয় প্রদায়ক হিসেবে লেখালেখির সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। লেখাপড়া, সংসার, খণ্ডকালীন চাকরি, প্রথম আলোয় লেখালেখি—সবই করেছি সমান তালে। তখনো অনেকে বলেছেন, অল্প কিছুদিন পারবে, তারপর দেখবে সব ছেড়ে দিচ্ছ। সেসব নেতিবাচক মন্তব্য পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করেই এগিয়েছি। ক্লান্তি আসে, হতাশ হই, হোঁচট খাই, কিন্তু হেরে যাই না, থেমে থাকি না।
লেখাপড়া শেষ করে যখন পূর্ণকালীন চাকরি শুরু করব, আমার কোলজুড়ে এলো আমাদের প্রথম সন্তান। আবার রব উঠল—মিলিকে এবার থামতেই হবে।
ইচ্ছাকে সঙ্গী করলে সব ক্ষেত্রেই উদাহরণ তৈরি করা সম্ভব, সেটি আমি পেরেছি। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’-এর যোগাযোগ বিভাগে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করে চলেছি। বড় বড় সংবেদনশীল প্রকল্পের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করার পর চারপাশের মানুষের কাছ থেকে যখন আস্থা, মর্যাদা ও প্রশংসা পাই, তখন ‘না’ শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়।
‘না’ বলা মানুষেরা কিন্তু থেমে নেই, এখনো কিন্তু হামেশা সেসব শুনি। যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে গাড়ি চালানো শিখব পরিকল্পনা করলাম। বেশির ভাগ মানুষ বললেন, পারব না। এখন নিজে গাড়ি চালাই। তাঁরা এটা শোনার পর মন্তব্য করেন, এই শহরে ট্রাফিকের যা অবস্থা, কেন ঝুঁকি নিচ্ছেন? কীভাবে পারেন? যেসব পুরুষ নিজেরা গাড়ি চালান, তাঁরা একজনও এমন মন্তব্য শুনেছেন বা শোনেন বলে আমার মনে হয় না! অনেকেই আবার ভাবেন, পেশাজীবনকে যখন এত গুরুত্ব দিই, সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি; তাহলে সংসার–সন্তানদের খেয়াল মনে হয় রাখি না, নিজের জন্য কোনো সময় থাকে না, বিশ্রাম হয় না—এমন অনেক কিছু!
আমার বড় মেয়ের বয়স এখন ১৫ বছর, ছোট মেয়ের ১১। আমি ওদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ওদের সংবেদনশীল কৈশোরকে মাথায় রেখে ওদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদের লেখাপড়া, সংসার সব কাজের দায়িত্ব আমি আর আমার স্বামী দুজনে ভাগাভাগি করে পালন করি। বাচ্চাদের নিজেদের কাজটুকু ওরা যেন নিজেরা করতে পারে, তা নিয়ে শুরু থেকেই সচেতন ছিলাম আমরা। সব মিলিয়ে সবাই মিলে সময়ের পরিকল্পনা করে চলাই আমাদের প্রতিদিনের ভালো থাকাকে নিশ্চিত করে। আমার সন্তানদের জন্য আমি হয়ে উঠি অনুপ্রেরণা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছ থেকে শুনি, ‘হার না মেনে নেওয়াই বাংলাদেশ।’