ব্যক্তিগত কথা সহকর্মীর সঙ্গে কতটা বলবেন?
আমরা যাঁরা চাকরি বা ব্যবসা করি, কাজের প্রয়োজনে দিনের একটা বড় অংশই তাঁদের অফিসে থাকতে হয়। এমনও হয়, দিনে যত ঘণ্টা আমরা বাড়িতে কাটাই, তার চেয়ে বেশি সময় আমরা অফিসে ব্যয় করি। সে কারণেই অফিসে যাঁরা আমাদের সহকর্মী, তাঁদের সঙ্গে আমাদের একধরনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সহকর্মীদের মধ্যে হৃদ্যতা নানা কারণেই দরকার। এতে সবাই মিলে কাজ করা সহজ হয়, কাজে মনোযোগ ও দক্ষতা বাড়ে, অফিসে নিয়মিত যাওয়া ও সময় কাটানোর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে হৃদ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে যদি মন উজাড় করে সব কথাই বলে ফেলেন, তাহলে কিছু ঝামেলাও হতে পারে। চাণক্য বলেছিলেন, অতিরিক্ত সব কিছুই বিষ। এমনকি ভালো জিনিসের বাড়াবাড়িও ভালো নয়। অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যাপারটাও সে রকম। তাঁদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে, সহৃদয়ভাবে কথা বলতে হবে ঠিকই, কিন্তু কত দূর কী বলবেন, সে ব্যাপারে খানিকটা সতর্ক থাকা পেশাগত উন্নতি ও মানসিক শান্তি—দুটিই জন্যই জরুরি।
অফিসের সহকর্মীরা আমাদের বন্ধুর মতো, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধু নন—কথাটা সব সময় মনে রাখা ভালো। কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মীরা সহযোগিতা যেমন করেন, তেমনি প্রতিযোগিতাও করেন। সুতরাং পরিস্থিতি পাল্টে গেলে সহকর্মীর অবস্থান ও আচরণ পাল্টাতে পারে। সহকর্মীর কাছে ভরসা করে এমন কোনো মনের কথা বলা উচিত নয়, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি সবার সামনে বলে ফেললে আপনি বিব্রত হতে পারেন। আমি একবার এমন বোকামি করেছিলাম। অফিসের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি সিদ্ধান্ত পছন্দ না হওয়ায় নিজের অসন্তোষের কথা এক সহকর্মীকে জানিয়েছিলাম। কয়েক মাস পর অফিসের বার্ষিক কাজের মূল্যায়নের সময় জানলাম, সেই সহকর্মী আমার অসন্তোষের কথা শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে আমার পরিপক্বতা আর দূরদর্শিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এটা জেনে আমার মন খারাপ হয়েছিল। পরে বুঝলাম, আমার সহকর্মী ভুল কিছু বলেননি। যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার অসন্তোষ, তা নিয়ে আসলে সরাসরি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেই আলাপ করা উচিত ছিল। সহকর্মীর সঙ্গে ওই ব্যাপার নিয়ে আমার আলোচনা করতে যাওয়া ঠিক হয়নি। সেই থেকে কাজের ব্যাপারে যেকোনো অভিযোগ, ক্ষোভ বা অস্বস্তি নিয়ে আমি কেবল যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেই কথা বলি। সহকর্মীর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে, মনের ভার হালকা করার চেষ্টা করি না।
তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমরা সহকর্মীদের সঙ্গে কথাই বলব না। কথা বলার জন্য বহু ভালো বিষয় আছে। কাজের বিষয়ে কথা বলতে পারেন, দক্ষতা বাড়ানোর নানা উপায় নিয়ে কথা বলতে পারেন। কাজের বাইরে নিজেদের নানা আগ্রহের বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন। সহকর্মীদের কারও কোনো ভালো কাজ বা আচরণ দেখলে তাঁর প্রশংসা করতে পারেন, এর থেকেও অনেক সময় দারুণ সব আলোচনা শুরু হয়।
যেটা না করাই ভালো, সেটা হলো একে অন্যের সঙ্গে বেতন-বোনাস-সুবিধাদি নিয়ে আলোচনা। এসব নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদে আলোচনা হতে পারে, ব্যক্তিপর্যায়ে না হওয়াই ভালো। এসব আলোচনা থেকে ভালো কিছু হওয়ার বদলে বেশির ভাগ সময়ই ঈর্ষা আর বিদ্বেষের জন্ম হয়। এমন আলোচনা পাঁচকান হলে অফিস কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে, আপনার পেটে কোনো কথা থাকে না।
আরেকটা আলোচনা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবেন, সেটা হলো গুজব আর কুৎসার আলোচনা। দুর্নীতি, হয়রানি বা অপরাধের প্রমাণ পেলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে জানান, নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন বা নিতে বাধ্য করুন। কিন্তু বিনা প্রমাণে, শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে কিংবা অনুমানে দুয়ে-দুয়ে চার মিলিয়ে কেউ অন্য কারও নামে মুখরোচক গুজব ছড়াতে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে দূরে সরে যান। গুজব রটানো প্রত্যক্ষ অন্যায়, আর সে রটনায় সাহায্য করা কিংবা নীরব সমর্থন জানানো পরোক্ষ অন্যায়। অন্যায়ের ভাগীদার কেন হতে যাবেন?
রাজনীতি, ধর্ম, মতাদর্শের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার সময় একটু সংযত থাকা ভালো। মত প্রকাশ করুন, কিন্তু সংঘাত এড়িয়ে চলুন। মানুষ সহজে মত বদলায় না। আপনার যুক্তি যতই প্রবল হোক, আপনার সহকর্মী তা গ্রহণ না–ও করতে পারেন। চাপাচাপি করলে হিতে বিপরীত হবে।
যতই আমরা পেশাজীবন আর ব্যক্তিজীবনকে আলাদা করতে চাই না কেন, একটা আরেকটার মধ্যে কিছুটা ঢুকে পড়বেই। কিন্তু সব যেন মিলেমিশে একাকার না হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ রাখুন। সহকর্মীর দুঃখ, শোক, বিষাদে সান্ত্বনা দিন; কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রেম, বিচ্ছেদ, বিয়ে, সংসার, সন্তান, সম্পত্তি নিয়ে গভীর আলোচনায় যাবেন না। আমরা মনোবিশ্লেষক নই, ম্যারেজ কাউন্সেলর নই, উকিল নই, পুলিশ নই। জটিল সমস্যা সমাধানের ভার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দিন।
স্বাস্থ্য নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে আলোচনা হওয়া স্বাস্থ্যকর। কিন্তু এখানেও সীমা বজায় রাখা দরকার। সহকর্মীদের সঙ্গে গায়ে পড়ে স্বাস্থ্য সমস্যার যাবতীয় খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করবেন না, ওটা বরং চিকিৎসকের সঙ্গে করুন। সহকর্মীর স্বাস্থ্য সমস্যার সময় তথ্য দিয়ে সাহায্য করুন, কিন্তু রোগনির্ণয় বা চিকিৎসার উপায় বলে দেবেন না।
সংসারযাত্রায় কিছু সংঘাত অনিবার্য। এটা কমবেশি সবার জীবনেই হয়। কিন্তু বাড়িতে ঝগড়া হলেই সহকর্মীর কাছে জীবনসঙ্গীর নামে অভিযোগ করবেন না। ঝগড়া মিটে যাবে, কিন্তু ঘরের লোকের নামে বাইরের লোকের কাছে অভিযোগ করার গ্লানিবোধ সহজে মিটতে চায় না। একই কারণে কাজের ক্ষেত্রে মতবিরোধ হলেও এক সহকর্মীর নামে অন্য সহকর্মীর কাছে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করবেন না। মতবিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে, কাজের ক্ষতি করলে মানবসম্পদ বিভাগ বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানান। যে কারও নামে তাঁর আড়ালে নেতিবাচক মন্তব্য করলেই দেখবেন, সেই কথা নানা মুখ ঘুরে আরও নেতিবাচক অবস্থায় ওই ব্যক্তির কাছেই পৌঁছায়। মন্তব্যটি যে আপনি করেছেন, সে তথ্যও পৌঁছে যায়। অথচ তাঁর কাছে যে তথ্য পৌঁছাল, হুবহু সেটা হয়তো আপনার কথাটি নয়! এর ফল কখনোই ভালো হয় না।
অতীত জীবনের কোনো অন্ধকার দিক বা ভুলত্রুটি যদি থাকে, সেটা নিয়েও সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা না করা ভালো। কেউ আহত হতে পারেন, কেউ বিদ্বিষ্ট হতে পারেন, কেউ আবার তথ্যটুকু তুলে রাখতে পারেন যথাসময়ে আপনার অযোগ্যতা বা অনুপযুক্ততার প্রমাণ হিসেবে পেশ করার জন্য।
শেষে আরেকটা কথা। সহকর্মীদের কারও পোশাক, সাজগোজের ধরন, কথা বলার ভঙ্গি আপনার ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু তাঁকে সে কথা যদি জানাতে হয়, তাহলে মার্জিত ও শোভনভাবে জানাবেন। ‘উফ, আপনাকে এই শাড়িতে ফাটাফাটি লাগছে’ বা ‘চেহারা এত ঝলমল করছে কেন, বাড়িতে বউ কি খুব আদর করছে?’এ জাতীয় কথা শুধু অপেশাদার আচরণ নয়, একধরনের যৌন হয়রানি এবং সেই সঙ্গে শাস্তিযোগ্যও।
অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলুন এবং মন দিয়ে তাঁদের কথা শুনুন। কিন্তু আপনার বলা ও শোনার নিয়ন্ত্রণ যেন আপনার হাতেই থাকে। সহকর্মীদের জন্য আপনার সহমর্মিতা থাকুক, সহানুভূতি থাকুক, সেই সঙ্গে থাকুক সম্মানবোধ। আর কে না জানে, সব সম্মানের সঙ্গেই একটুখানি দূরত্ব থাকে আর থাকে অনেকখানি সংযম।