গল্পগুলো অনুপ্রেরণার
দরিদ্রতম পরিবারের প্রথম মেয়েসন্তান, যাঁরা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছান, তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে দেওয়া হয় আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তি। চট্টগ্রামে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) পড়ার সুযোগ পান তাঁরা। আবাসন, টিউশন ফি মওকুফসহ নানা সুবিধা তাঁদের দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০১২ সাল থেকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহযোগিতায় ৪২ এবং ২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহযোগিতায় ৬৬ জনসহ মোট ১০৮ জন এ পর্যন্ত এই বৃত্তি পেয়েছেন। ৫২ জনের স্নাতক শেষ হয়েছে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই দেশে–বিদেশে ভালো অবস্থানে আছেন। পড়ুন ২০২৩ সালে বৃত্তি পাওয়া ১০ অদ্বিতীয়ার গল্প।
৬ হাজার টাকায় চলত সংসার: চন্দ্রিমা দাশ
পরিবার বলতে আমরা দুজন—মা আর আমি। বাবা আছেন, তবে আমাদের খোঁজ রাখেন না। ২০১২ সালে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাধ্য হয়েই পোশাক কারখানায় কাজ নেন মা। বেতন ৬ হাজার টাকা। এর মধ্যেই বাসাভাড়া, ঋণ পরিশোধ, আমার পড়ালেখা, সব সামাল দিতে হতো। কবে আবার একটা নতুন মাস শুরু হবে, কবে আবার হাতে কিছু টাকা আসবে, এই অপেক্ষায় কাটত আমাদের একেকটা দিন। আমি যখন জেএসসি পরীক্ষার্থী, তখন পোশাক কারখানার চাকরিটাও চলে যায়। খুব কষ্ট করে পরীক্ষার ফি আর বেতনের ব্যবস্থা করেছিলেন মা। বিজ্ঞানে পড়ার সামর্থ্য ছিল না। মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করি। মা তত দিনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সাত হাজার টাকা বেতন। ধরেই নিয়েছিলাম, কলেজে পড়ালেখা আমার হবে না। কিন্তু মা হাল ছাড়েননি। আমাকে ভর্তি করিয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে।
বাড়তি কাজ করে উপার্জনটাকে সাত হাজার থেকে নয় হাজারে উন্নীত করতে সকাল সাড়ে ৬টায় বাসা থেকে বের হতেন মা। ফিরতেন রাত ১০টার পর। কলেজ পেরোনোর পর ভর্তি কোচিং করতে গিয়ে অনেকগুলো টাকা চলে গেল। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সুযোগ হলো না। আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম—পড়ালেখা আর হবে না। কিন্তু মা বললেন, ‘আমি তোকে এই ভার্সিটির (এইউডব্লিউ) স্টুডেন্ট হিসেবে দেখতে চাই। এখানকার মেয়েরা যখন ইংরেজিতে কথা বলে, দেখে খুব ভালো লাগে। আমার খুব শখ, তোকেও ওদের সঙ্গে দেখব।’ হ্যাঁ, মায়ের স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি। আমাকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ফর উইমেন্সের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
একটা ডিম চারজন ভাগ করে খেয়েছি: শাকিলা আক্তার
বাবা ছিলেন রিকশাচালক। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, সপ্তাহের দুই থেকে তিন দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন। বাকি দিনগুলোতে কাজ করতেন। বাবা কাজে গেলে আমাদের ঘরে খাবার জুটত, না গেলে চাল ধার করতে হতো। মা-বাবা অবশ্য বেশির ভাগ সময় না খেয়েই কাটাতেন। আমাদের দুই ভাই-বোনকে পাঠিয়ে দিতেন নানির বাড়ি, যেন অন্তত ক্ষুধাটা নিবারণ করতে পারি। না খেয়ে কাজ করে আমার দিনমজুর মা কতবার যে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন! এমনও হয়েছে, ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে পেটে ওড়না বেঁধে রেখেছেন শক্ত করে। এত পরিশ্রমের পরও কখনো পড়ালেখা বন্ধ করে দেননি। ধার করে বেতন দিয়েছেন। টাকা বাঁচাতে অনেক সময় আমরা একটা ডিমভাজা চারজন ভাগ করে খেয়েছি।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর পড়ালেখার খরচ বেড়ে গেল। বাধ্য হয়েই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো নানির বাড়ি। সেখানেও অবস্থা অত ভালো ছিল না। মামা-খালারা তখন ছোট, তবু তারাও কোনো না কোনো কাজ করতেন। সবার সাহায্যেই চলত আমার পড়ালেখা।
বাবা মারা গেছেন পাঁচ মাস হলো। এখনো মা কষ্ট করেই যাচ্ছেন, যেন আমি নিজের একটা পরিচয় দাঁড় করাতে পারি। আমি চাই পড়ালেখা শেষে ভালো একটা চাকরি করব। মাকে আর কাজ করতে দেব না। তাঁর দায়িত্ব নেব। এখন অবশ্য মাকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়। প্রায়ই তিনি অসুস্থ থাকেন, কাজে যেতে পারেন না। সংসারের খরচই চলে না, আমার হাতখরচ সেখানে বিলাসিতা। প্রথম আলো ও আইডিএলসির এই উপবৃত্তি তাই আমার খুব উপকারে আসবে।
খাওয়ার কষ্টও যে সহ্য করতে হবে, কোনো দিন ভাবিনি: প্রিয়ন্তী রানী
আমার পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৬। মা-বাবা-দাদি আর আমরা ৩ ভাই-বোন। আগে চামড়ার ব্যবসা করতেন বাবা। এখন কৃষিকাজ করেন। আমাদের কোনো জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে ঘর করে থাকি।
কয়েক বছর আগেও বাবার চামড়ার ব্যবসাটা ভালোই চলছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে এই ব্যবসার বাজার কমে গেল। একসময় বন্ধ করে দিতে হলো। তখন আমাদের পরিবারের খুব খারাপ সময়। একে তো আয় নেই, তার ওপর আমরা ভাইবোনেরা বড় হচ্ছি, খরচ বাড়ছে। খাওয়ার কষ্টও যে সহ্য করতে হবে, কোনো দিন ভাবিনি। বাবার জন্য আসলে এত বড় পরিবারের খাবার-পড়ালেখার খরচ মেটানো সম্ভব ছিল না। আমি যেহেতু পরিবারের প্রথম সন্তান, ভাইবোনদের পড়ালেখা চলমান রাখতে শুরুতেই আমার পড়ালেখা হুমকির মুখে পড়েছিল। কিন্তু বাবা পড়ালেখা বন্ধ হতে দেননি। কৃষিকাজ করে, অনেক পরিশ্রম করে তিনি আমাকে পড়িয়েছেন। উচ্চমাধ্যমিকে যখন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম, আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। প্রাইভেট পড়া তো দূর, কোচিংয়ে যাওয়া-আসার খরচ দেওয়াও সম্ভব ছিল না। তারপরও হাল ছাড়িনি। নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম আর পরিবারের সমর্থনেই এত দূর এসেছি।
প্রথম আলো ও আইডিএলসির উপবৃত্তি আমার পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে পারব। আমার পড়ালেখার খরচের চাপ কিছুটা কমলে বাবা আমার ভাইবোনের পড়ালেখায় ব্যয় করতে পারবেন। ওদের পড়ালেখায় কোনো বাধা না আসুক, এটুকুই আমার চাওয়া।
একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা: পপি রানী বাউরী
আমি চা-শ্রমিকের সন্তান। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের দেউন্দি চা-বাগানে আমার বাড়ি। বাবার নাম সুনীল বাউরী। মা অনিমা রানী বাউরী। মা-বাবা দুজনই চা-বাগানে কাজ করেন। আমাদের নিজস্ব কোনো জমিজমা নেই। তিন ভাই-বোন। ভাই বড়, আমি মেজ আর বোন ছোট। ভাইটা ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। বাগানের একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে ছোট বোন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের প্রি-আন্ডারগ্র্যাড (প্রাক্-স্নাতক) শিক্ষার্থী হিসেবে এখন আমার প্রথম সেমিস্টার চলছে।
অনেকে হয়তো জানেন, একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা। এই স্বল্প আয় দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ ও আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন আমার মা-বাবা। ২০১৯ সালে এসএসসি পাস করি। তবে ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পর শুরু হয় মূল সংগ্রাম। ইচ্ছা ছিল স্নাতক করব। বাংলায় পড়ার সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় ভর্তি হতে পারিনি। একটা সময় মনে হয়েছিল আর বোধ হয় পড়াশোনা করা হবে না। এরপর আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে এইউডব্লিউর কথা জানতে পারি। আবেদন করি। ভাগ্য ভালো, সুযোগ হয়েও যায়। আমার বাবার চা-বাগানে কাজ করার বয়স প্রায় শেষ। তাই পরিবারের পাশে দাঁড়াতে এই বৃত্তি আমার খুব কাজে আসবে। এখন ভাই ও বোনের পড়াশোনায় আর্থিক কোনো বাধা এলে আমি সাহায্য করতে পারব।
মামার দেওয়া পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে ক্লাস করেছি: প্রিয়া রানী দাস
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ গ্রামে আমার বাড়ি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি বড়। যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তাম, বাবা গ্রামে একটা ব্যাংকে দারোয়ানের কাজ করতেন। বেতন ছিল ৫ হাজার টাকা। এই সামান্য বেতনে সংসার চালানো সম্ভব হতো না। অনেক দিন অনাহারে কেটেছে, কখনো একবেলা খেয়ে পার করেছি পুরো দিন। বিপদের সময় কাছের আত্মীয়েরাও খারাপ আচরণ শুরু করেন। ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে মা কখনো কখনো আত্মীয়দের কাছে খাবার চাইতে যেতেন, খুব অপমান করতেন তাঁরা।
একসময় বাবা জুতা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। অনেক অভাবের পরও তিনি আমার লেখাপড়া বন্ধ করতে চাননি। যদিও টাকার অভাবে একবার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়েই গিয়েছিল। তখন শিক্ষকেরা আমাকে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। তাঁদের সহায়তাতেই জিপিএ ৪.৬১ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।
করোনার সময়টাও খুব কষ্টে কেটেছে। তখন ক্লাস হতো অনলাইনে। মামা একটা পুরোনো মুঠোফোন দিয়েছিলেন। সেই মুঠোফোনে ক্লাস করে, ইউটিউবে ভিডিও দেখে পড়ালেখা করে এইচএসসিতে ৪.৫ জিপিএ নিয়ে উত্তীর্ণ হই। যখন এইউডব্লিউতে পড়ার সুযোগ পাই, বাসা থেকে শুরুতে রাজি হয়নি। বলছিল, এত টাকা কোথায় পাব! পরে জানলাম, আমি শতভাগ বৃত্তি পেয়েছি।
বাবা এখন কুমিল্লায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। বেতন ১০ হাজার টাকা। এই টাকায় সংসার চালিয়ে আমার বই-খাতা কেনার টাকা দেওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তি আমার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দেবে।
গ্রাম থেকে বাজারে যেতেই লাগত ২ ঘণ্টা: ক্রাজাইরী মগ
একসময় নিজের জমিতেই চাষাবাদ করতেন আমার বাবা। পরে টাকার প্রয়োজনে বন্ধক রাখতে হয় সেই জমি। এখনো ছাড়াতে পারেননি। অন্যের জমিতে কাজ করে এখন সংসার চালান। মা-ও মাঝেমধ্যে অন্যের জমিতে কাজ করেন। ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়। মা-বাবা লেখাপড়া জানেন না বলেই সব সময় চেয়েছেন আমরা যেন শিক্ষিত হই। আমাদের গ্রামে কোনো ভালো স্কুল ছিল না। ছিল না রাস্তাঘাট। গাড়িও চলত না। হেঁটে বাজারে যেতেই লেগে যেত ঘণ্টা দুই। তাই লেখাপড়ার জন্য ছোটবেলাতেই আমাকে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অনেক পরিশ্রম করে মা-বাবা আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। অভাব-অনটন কখনো বুঝতে দেননি। বাবা সব সময় একটা কথা বলতেন, ‘ভালোভাবে লেখাপড়া করো। না হলে আমাদের মতো কষ্ট করে খেতে হবে।’ তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম, নিজের জন্য না হোক, মা-বাবার জন্য পড়ালেখায় মন দেব। যত বড় হয়েছি, পড়ালেখার খরচ তত বেড়েছে। এইচএসসির পর হয়তো আমার পড়ালেখাই বন্ধ হয়ে যেত, যদি না এইউডব্লিউ আমাকে বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ দিত। কোনো দিন ভাবিনি, গ্রাম থেকে উঠে এসে একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাব। এখন আমার পড়ালেখার খরচ নিয়ে মা-বাবাকে আর ভাবতে হয় না।
‘মেয়েকে এত পড়িয়ে কী হবে’: সাবেরা আক্তার
ছোটবেলা থেকে ইংরেজির প্রতি আমার একটা আলাদা টান। ইংরেজি পড়তে ভালো লাগত। ইংরেজি বলার দক্ষতাটাও ছিল অনেকের চেয়ে ভালো। এখন যখন একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দিয়ে হাঁটি, মনে হয় এ রকম একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার স্বপ্নই তো আজীবন দেখেছি।
তবে স্বপ্নটা যে সত্যি হতে পারে, কখনো ভাবতে পারিনি। সিলেটের একটা ছোট্ট চা-বাগানে বড় হয়েছি। বাবা পেশায় চা-শ্রমিক। মা গৃহিণী। ছোট ভাইটা মাদ্রাসায় পড়ে। বড় ভাই চাকরির খোঁজে আছেন। পরিবারে আমিই প্রথম যে উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ির বাইরে পা রেখেছি। স্কুলজীবনে পড়ালেখাটা সহজ হয়ে গিয়েছিল মেধাবৃত্তি পেয়েছিলাম বলে। কিন্তু কলেজে পড়তে পারব কি না, সেই নিশ্চয়তা ছিল না। আমাদের পরিবারে এসএসসির পরপরই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ‘নিয়ম’। তাই যখন মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হলাম, আত্মীয়স্বজন নানা কথা বলেছিল। ‘মেয়েকে এত পড়িয়ে কী হবে’, ‘বাড়ির মেয়ে এতবার বাইরে যায় কেন?’ কিন্তু বাবা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন সব সময়।
অনেক সংগ্রাম করে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর এক আপুর কাছ থেকে এইউডব্লিউর খোঁজ পাই। ভাগ্যিস এখানে সুযোগটা হয়েছিল। না হলে আমার আর পড়ালেখা করা হতো না। যে আত্মীয়স্বজন একসময় আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করতেন, এখন তারাও আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।
মা বলেন, ‘মেয়েরাই আমার ছেলে’: মিলিপ্রু মারমা
মা-বাবা দুজনই অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। এখন অবশ্য বাবা কিছু করেন না। মা স্থানীয় কাপড়ের একটা ছোট দোকান চালান। জমি বলতে ভিটেমাটিটুকু আছে খাগড়াছড়িতে, সেখানে কাঠের ঘর। দুই বোনের মধ্যে আমি ছোট। এইচএসসি দেওয়ার পর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমিই আমার পরিবারের প্রথম প্রজন্ম, যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছি।
ছোটবেলা থেকেই নারী-পুরুষের বৈষম্য দেখে বড় হয়েছি। আমাদের সমাজে এখনো এই বৈষম্য বিদ্যমান। মাকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার সন্তান কয়জন?’ মা বলেন, ‘দুই মেয়ে।’লোকে বলে, ‘ছেলে থাকলে ভালো হতো।’ মা অবশ্য এসব শুনে দমে যান না। বলেন, ‘মেয়েরাই আমার ছেলে।’
একটি উদ্ধৃতি আমার খুব পছন্দ। ‘সুযোগ আসার জন্য অপেক্ষা করবেন না। প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের সুযোগ নিজেই তৈরি করুন।’এই কথা সব সময় মনে রাখার চেষ্টা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে জনস্বাস্থ্যে ডিগ্রি নিতে চাই। কারণ, আমাদের পাহাড়ে এখনো অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা পর্যাপ্ত চিকিৎসাসুবিধা থেকে বঞ্চিত। পাহাড়ের মানুষের জন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাই। কেননা, ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, পাহাড়ের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষই উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়ালেখা করতে পারে না। তাই নিজে শিক্ষিত হয়ে সমাজবদলে কাজ করতে চাই।
মায়ের সমর্থনেই এত দূর এসেছি: আকলিমা আক্তার
আরও অনেকের মতো একটা উচ্ছল, সুন্দর শিক্ষাজীবন আমি পাইনি। পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। বাবা সংসারের ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। আমাদের জন্য তিনি থেকেও নেই। এত দূর এসেছি শুধু আমার মায়ের সমর্থন আর মেধার জোরে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সহযোগিতা তো ছিলই।
জীবনে যতগুলো বোর্ড পরীক্ষা দিয়েছি, সব কটিতেই সর্বোচ্চ ভালো ফল ছিল। জেএসসি, এসএসসিতে বৃত্তি পেয়েছি। বৃত্তি, উপবৃত্তির টাকা যদি না পেতাম, শিক্ষকেরা যদি আমার টিউশন ফি কমিয়ে না দিতেন, তাহলে হয়তো উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো হতো না।
এইউডব্লিউতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ঠিক, কিন্তু মা আর ভাইয়ের কথা ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হয়। সংসার চালানোর পাশাপাশি আমাকে হাতখরচ দেওয়া মায়ের জন্য এক রকম অসম্ভব। ‘অদ্বিতীয়া বৃত্তি’ এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সাহায্য করবে। জেনে হয়তো খুশি হবেন, ২০২৩ সেমিস্টারে সব বিষয়ে ৯৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। এইচএসসি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়ে হঠাৎ ইংরেজি মাধ্যমে আসা আমার জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু দৃঢ় সংকল্পই আমাকে এগোতে সাহায্য করেছে। যতবার ভেঙে পড়েছি, ততবারই মায়ের কষ্টের কথা মনে করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।
নানা রকম বৃত্তি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছেছি: লিজা আখতার
নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। এই পথ পাড়ি দিতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাবার অসুস্থতার কারণে মাধ্যমিক পর্যায়েই পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটে যাচ্ছিল। শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে তখন কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পেরিয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আরেকবার দ্বিধার মুখে পড়েছিল পরিবার। আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে, নাকি আরও পড়ালেখা করাবে? পড়ালেখা যদি করানোই হয়, তাহলে খরচ আসবে কোথা থেকে? সেই সময়ও শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছি বলেই উচ্চমাধ্যমিক করতে পেরেছি।
পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোই যেখানে দুষ্কর, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সেখানে বিলাসিতা। ছোট ভাইটা দশম শ্রেণিতে পড়ে। বড় ভাই বাধ্য হয়েই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। নানা রকম বৃত্তির মাধ্যমে আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছেছি, এখনো বৃত্তি পাচ্ছি। এই ঋণ শোধ করার জন্য হলেও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। অন্যকে সহায়তা করার জন্য আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যার জন্য আরও পথ আমাকে অতিক্রম করতে হবে। আশা করি ‘অদ্বিতীয়া বৃত্তি’ এই পথচলা সহজ করবে।