মাদিবা বলেছিলেন, ‘ক্ষমা আর শান্তিই একমাত্র সমাধান’
মাদিবা, মাদিবা...
হুট করেই লং ওয়াক টু ফ্রিডম দেখলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে সিনেমা। এই জুলাই মাসেই তাঁর জন্মদিন। সিনেমাটি নিয়ে ছোট্ট করে লিখতে বসে কানে বাজছে ‘মাদিবা’, ‘মাদিবা’। সিনেমার পর্দা থেকে মাথার ভেতরে উচ্চারিত হচ্ছে এই নাম। অধিকার, ন্যায়বিচার আর পরম আস্থার জায়গা হিসেবে ‘মাদিবা’, অর্থাৎ ম্যান্ডেলাকে গ্রহণ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ জনগণ।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লং ওয়াক টু ফ্রিডম থেকে নির্মিত একই নামের সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন ব্রিটিশ লেখক ও চিত্রনাট্যকার উইলিয়াম নিকলসন। পরিচালনা করেছেন জাস্টিন চ্যাডউইক। সিনেমায় ম্যান্ডেলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ অভিনেতা, র্যাপার ইদ্রিস এলবা। তবে সিনেমা দেখতে দেখতে একবারও মনে হয়নি মানুষটা স্বয়ং ম্যান্ডেলা নন, ইদ্রিস এলবা!
চলচ্চিত্রটির অনেক দৃশ্যই মনে গেঁথে আছে, তার মধ্যে কয়েকটির কথা বলি।
শ্বেতাঙ্গ–কৃষ্ণাঙ্গের বিরোধ তখন তুঙ্গে। কৃষ্ণাঙ্গদের দীর্ঘ সময়ের বঞ্চনা, নিষ্পেষণ, খুন আর হত্যাকাণ্ডের ফলে জমা হওয়া তীব্র ক্ষোভের বারুদে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল। সবাই মরিয়া হয়ে সহিংসতাকে মুক্তির পথ হিসেবে দেখছিল। সেই সময় ম্যান্ডেলা জাতির উদ্দেশে ভাষণে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছিলেন। রক্তের বদলে আরও রক্ত ঝরুক—কোনো অবস্থাতেই তা তিনি চাচ্ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘জীবনের সেরা সময়টা আমি জেলে কাটিয়েছি। প্রথম সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাঁকে শেষবারের দেখতে যেতে পারিনি। মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনেছি। সন্তানদের বড় হওয়া দেখতে পারিনি। আমার কন্যারা বাবার স্নেহ-ভালোবাসা ছাড়া বড় হয়েছে। আমি যদি তাঁদের (শ্বেতাঙ্গদের) ক্ষমা করে দিতে পারি, তাহলে আমার বিশ্বাস আপনারাও পারবেন। ওরা (শ্বেতাঙ্গরা) ক্ষমতায় থেকে যা করেছে, আমরা যদি ক্ষমতা পাওয়ার পর সেটাই করি, প্রতিশোধ নিই, তাহলে আমরা কীভাবে ওদের চেয়ে ভালো হলাম? ক্ষমা আর শান্তিই একমাত্র সমাধান।’ বলা হয়ে থাকে, শান্তিতে তাঁর যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এই সংক্ষিপ্ত ভাষণ।
আরেকটি দৃশ্যের কথা বলি। ম্যান্ডেলা যখন জেলে, একাধিকবার তাঁর স্ত্রী উইনিকে সশস্ত্র বাহিনী তুলে নিয়ে যায় ও জেলে নিয়ে গিয়ে জেরা করে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, তিন আর চার বছর বয়সী ছোট্ট দুই শিশুকন্যার চোখের সামনে মা উইনিকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়িতে তোলা, জেলখানায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় উইনি কেবল চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমার বাচ্চারা কোথায়? আমার বাচ্চারা কোথায়?’ এই দৃশ্যে উপস্থিত দর্শকদের প্রায় সবাই টিস্যু খুঁজেছেন, নীরবে চোখের পানি মুছেছেন।
ম্যান্ডেলার সেই দুই কন্যা জেনানি ও জিন্দাজি নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। জেনানি ২০১২ সালে সাউথ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেন আর্জেন্টিনায়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে সফলতার সঙ্গে পাঁচ বছর কাটানোর পর বর্তমানে তিনি মরিশাসের হাইকমিশনার। অন্যদিকে জিন্দাজি ১৯৮৫ সালে কেপটাউন ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি এখন ডেনমার্কে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে লং ওয়াক টু ফ্রিডম ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন ম্যান্ডেলা ও উইনির দুই কন্যা জেনানি ও জিন্দাজি। মেয়েরা যখন ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে লালগালিচা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনো জানতেন না এখানেই শুনতে হবে—বাবা আর নেই। সিনেমাটি চলতে থাকা অবস্থায় খবর এল, মারা গেছেন ম্যান্ডেলা। সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ার কথা ওঠে। কিন্তু ম্যান্ডেলার মেয়েরা তা চাননি। প্রদর্শনী শেষে উপস্থিত দর্শকদের ম্যান্ডেলার মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়। পালন করা হয় ১ মিনিটের নীরবতা।
১৯৬২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ২৭ বছর রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে ছিলেন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রোবেন দ্বীপের কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম সন্তানের মৃত্যুর খবর পান। ১৯৬৯ সালে ২৪ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ম্যান্ডেলার প্রথম সন্তান থেমবি। দ্বিতীয় সন্তান মাকাজিউয়ে ১৯৪৮ সালে মাত্র তিন মাস বয়সে মারা যায়। আর তৃতীয় সন্তান মাকগাথো ২০০৫ সালে ৫৫ বছর বয়সে এইচআইভি/এইডস–সংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ম্যান্ডেলার প্রথম কন্যা মাকি। এই নারী পরে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নাম করেন। কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা ও বছরের পর বছরের কঠোর পরিশ্রম তাঁকে এনে দিয়েছে সাফল্য। পেয়েছেন ফুলব্রাইট ডিসটিংগুইশড ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড।