পরাণ, ঢাকা অ্যাটাক, ন ডরাইসহ ঢাকাই চলচ্চিত্রের শতাধিক পোস্টার ডিজাইন করেছেন তিনি
শখ থেকে শুরু। এখন পুরোদস্তুর পেশাদার শিল্পী। দামাল, পরাণ, ঢাকা অ্যাটাক, ন ডরাইসহ ঢাকাই চলচ্চিত্রের শতাধিক পোস্টার ডিজাইন করেছেন সাজ্জাদুল ইসলাম। নাটক–ওয়েবফিল্মের পোস্টারও নতুন রূপ পেয়েছে তাঁর হাতে। চেনা মহলে সায়েম নামেই পরিচিত তরুণ এই গ্রাফিক ডিজাইনার। তাঁর গল্প শুনেছেন সজীব মিয়া
ছোটবেলা থেকেই নাটক–সিনেমার পোকা। ভারতীয় সিরিয়াল দেখার কারণে ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে অনেক গালমন্দও খেতে হয়েছে। বন্ধুদের কাছে ঘরকুনো মানুষটা একটা সময় মনে মনে ভাবতেন চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখবেন। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা সাজ্জাদুল ইসলামকে সেটাও হতে দেয়নি। বদলে হয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলীর সহকারী।
চলচ্চিত্র-পরিচালক স্বপন আহমেদের সঙ্গে পরিচয় এই গৎবাঁধা জীবনে বাঁক আনল। সময়টা ২০১১ সাল। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তখন কাজ করেন সাজ্জাদ। সে সময় ঘটনাচক্রে স্বপন আহমেদের সঙ্গে পরিচয়। সিনেমা নিয়ে সুপ্ত ইচ্ছাটা আবার তাঁর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিজের আগ্রহের কথাটা পরিচালককে বললেন। পরবাসিনী নামে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন স্বপন আহমেদ। তত দিনে সাজ্জাদুলের আরেকটি গুণের কথাও জেনে গেছেন স্বপন। গ্রাফিক ডিজাইন পারেন সাজ্জাদ। সহকারী পরিচালক হিসেবে পরবাসিনী দলে যুক্ত হওয়ার পথ সহজ করে দিল এই বিশেষ দক্ষতা। সাজ্জাদুলের কাজ পোস্টার ডিজাইনসহ সিনেমার প্রচারণার জন্য গ্রাফিকসের কাজগুলো করে দেওয়া। সাজ্জাদুল ইসলাম বলছিলেন, ‘পোস্টার তৈরির আগে পরবাসিনীর গল্পটা ভালোভাবে শুনলাম। বিদেশি অনেক পোস্টার দেখলাম। তাঁরা কীভাবে ডিজাইন করে জানলাম। তারপর ছোট ক্যানভাসে আমিও একটা গল্প উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম—তৈরি হলো পোস্টার।’
পোস্টারের জন্য বাহবা পেলেন সাজ্জাদুল। প্রচার ডিজাইনার হিসেবে যেসব কাজ করলেন, সেসবের জন্যও জুটল বাহবা। মানুষের প্রশংসা তাঁকে ধীরে ধীরে গ্রাফিক ডিজাইনের দিকে আগ্রহী করে তুলল। তৃতীয় পক্ষের হয়ে পরে আরও কয়েকটা নাটক ও সিনেমায় কাজ করে দিলেন সাজ্জাদুল। ২০১২ সালে নিজেই গড়ে তুললেন পোস্ট প্রোডাকশন ও গ্রাফিকস ডিজাইন কোম্পানি ‘ওয়াইএফভিএফএক্স’ (ইয়ুথ ফিল্ম ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট)। সাজ্জাদুল বলেন, ‘ভারতের বিখ্যাত যশরাজ ফিল্মসের প্রতিটি ছবিই আমার দেখা। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করার সময় অবচেতনেই তাদের নামের সংক্ষিপ্ত রূপটা অনুকরণ করে ফেলেছি!’
‘কিস্তিমাত’ দিয়ে কিস্তিমাত
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনয়ারিং পড়তেন সাজ্জাদুল ইসলাম। থাকতেন বড় বোনের বাসায়। গ্রাফিক ডিজাইনার ভগ্নিপতি বাসায় ডিজাইনের নানা কাজ করতেন। তাঁর মাধ্যমেই গ্রাফিকসে সাজ্জাদুলের হাতেখড়ি। ফটোশপে একজনের মুখ অন্যজনের গলায় বসাতে ভারি আনন্দ লাগে! মজা করতে করতেই ২০০৭ সালের দিকে গ্রাফিকসের খুঁটিনাটিও শিখে ফেলেন।
২০০৭ সালের শেষের দিকে এক বন্ধুর মাধ্যমে সিনেমার একটা কাজ পান! ফটোশপ ও গ্রাফিক ডিজাইনের প্রতি ভালো লাগা থেকে ইচ্ছা করে পোস্টার করে দেন। সাজ্জাদুলের কাজে তাঁরা খুশি হন। দীর্ঘদিনের বিরতির পর পরবাসিনী দলে ভেড়া। তবে সাজ্জাদুলের পোস্টার ডিজাইনে বাঁকবদলের বছর ২০১৪ সাল। সে সময় নির্মাতা আশিকুর রহমান কিস্তিমাত চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন। পোস্টার ডিজাইনের দায়িত্বটা পান সাজ্জাদুল ইসলাম।
সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের চলচ্চিত্রের পোস্টার দেখে একসময় ভীষণ মন খারাপ হতো। পোস্টারে অশ্লীলভাবে নারীদের তুলে ধরা হতো, সঙ্গে বানানো হতো মাথা কাটা পোস্টার। আমি গল্পটাকে উপস্থাপন করতে চাইলাম। মানুষ পোস্টার দেখে গল্পটা আঁচ করতে পারে, এমন একটা আবহ দিতে চাইলাম।’
কিস্তিমাত চলচ্চিত্রের পোস্টারটা প্রকাশিত হওয়ার পর দর্শক মহলে বেশ প্রশংসা পায়। সেই প্রশংসা প্রযোজক–পরিচালকদের কাছে সাজ্জাদুলকে আরও পরিচিত করে তোলে। পরবর্তী কাজ পেতেও সহায়তা করে। তারপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি বলছিলেন, ‘এখন বাংলাদেশের ৭০-৮০ শতাংশ চলচ্চিত্রের পোস্টার করছে আমার ওয়াইএফভিএফএক্স।’
কীর্তনখোলার পারে
পড়াশোনার সঙ্গে সাজ্জাদুল ইসলামের দূরত্বটা কোনো দিন ঘোচেনি। টেনেটুনে এসএসসি পাসের পর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ। ভেবেছিলেন সনদ হাতে পেলেই কোনো একটা কাজ জুটিয়ে চলে যাবেন বিদেশ। কিন্তু জীবনপথের বাঁক আবার তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বরিশাল। প্রতিষ্ঠা পেতে একদিন কীর্তনখোলাপারের যে শহর ছেড়ে এসেছিলেন, সাফল্য আবার তাঁকে সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ২০২০ সাল থেকে বাড়িতে বসেই গ্রাফিকস ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করছেন বঙ্গবিডিতে। সেখানে বসেই চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েবফিল্ম, ওয়েব সিরিজের পোস্টারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার নানা অনুষঙ্গ নকশা করে যাচ্ছেন একের পর এক। নাটক ও চলচ্চিত্রবিষয়ক ফেসবুক গ্রুপগুলোতে তাঁর তৈরি পোস্টার নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হয়। ভক্তদের কাছে পেয়েছেন ‘পোস্টার বয়’ বিশেষণ। সাজ্জাদুল বললেন, ‘আগামী বছর মুক্তি পাবে এমন কিছু চলচ্চিত্র, ওয়েবফিল্মের কাজও করছি এখন। আছে জাজ মাল্টিমিডিয়াসহ বেশ কিছু পরিচিত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাজের ফরমাশ।’
পোস্টারে নতুন ধারা
রায়হান রাফি, নির্মাতা
আমার প্রথম দুটি চলচ্চিত্র পোড়ামন ২ ও দহন। চলচ্চিত্র দুটির পোস্টার ডিজাইন করানো হয়েছিল ভারতে। ভালো পোস্টার ডিজাইনের জন্য আমাদের তখন বিদেশে যেতে হতো। তবে একটা সময় নজর কাড়ে (সাজ্জাদুল ইসলাম) সায়েমের কাজ। ছেলেটা তখন নতুন কিছু করার জন্য একাই চেষ্টা করে যাচ্ছিল। নিজেই ব্র্যান্ড তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। ওর চিন্তাধারা, ডিজাইন ভালো লাগল। বিদেশি যে ডিজাইনারদের সে অনুসরণ করে, তাদের রুচিবোধও আমার ভালো লাগে। শুরু হলো আমাদের একসঙ্গে পথচলা। আমার প্রায় প্রতিটি নাটক–সিনেমার কাজই এখন সায়েম করে। শুধু আমার নয়, সায়েম এখন সবার মনের ভেতর ঢুকে গেছে।
এফডিসিকেন্দ্রিক গৎবাঁধা পোস্টারের যে চল ছিল, সায়েমের কারণে তাতে পরিবর্তন এসেছে। অনেক নির্মাতা বাজেটের অভাবে দেশের বাইরে পোস্টারের ডিজাইন করাতে পারতেন না। তাঁরা দেশেই এখন করতে পারছেন।
অনেককে এখন বলতে শুনি, পোস্টার দেখে তো সুন্দর মনে হয়েছিল, ছবি তো সুন্দর না! পোস্টারের মাধ্যমে এই যে সিনেমার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলা, তার কৃতিত্ব সায়েমকে দিতে হবে। আর দেশে নাটক–সিনেমার পোস্টার নিয়ে কথা উঠলে এখন সায়েমের নাম আসবে। পোস্টারসহ ডিজিটাল প্রচারণার কাজ সে–ই প্রথম পেশাদারত্বের সঙ্গে শুরু করেছে। পেশাদারত্বের বিষয়টা আগে ছিল না। আমার ৭ নম্বর ফ্লোর, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, পরাণ সিনেমার পোস্টার ওর করা। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত দামাল–এর পোস্টার কিছু ভারত থেকে করিয়েছি, সায়েমও করেছে কিছু কাজ। তবে কোনটা ভারতের আর কোনটা সায়েমের, কোনোভাবে আলাদা করার উপায় নেই। এটাই হয়তো ওর সাফল্য।’