নবদম্পতিরা চারপাশের লোকের কথায় এই ৫ ফাঁদে পা দেবেন না

সংসার বিষয়ে বিনা মূল্যে অনেক পরামর্শ পেয়ে থাকেন নতুন দম্পতিরা। এত পরামর্শে ভিড়ে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। লোকের এসব পরামর্শে কান দিয়ে বৈবাহিক জীবনের শুরুতেই অনেক সময় ভুল করে ফেলেন দম্পতিরা। অন্যের কথা শোনার আগে এই পাঁচটি বিষয়ে অবশ্যই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেওয়া ভালো।

বিয়ের পর চারপাশের লোকজন নানা পরামর্শ দেয়, তবে কোনটা শুনবেন সেই সিদ্ধান্ত নিজেদের নিতে হবেমডেল: ফারহান ও জেসিয়া। ছবি: কবির হোসেন

বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়ালের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিয়ে ও সম্পর্কবিষয়ক পরামর্শক হুরায়রা শিশির বলেন, নতুন যেকোনো কিছুর শুরুতে ভুল হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পরেও তা–ই। নতুন দাম্পত্যে ভুলকে খুব বড় করে দেখা যাবে না। ভুল থেকে সমস্যা তৈরি হলে একে অপরের প্রতি সহনশীল থেকে সেগুলো সমাধান করতে হবে।

১. সামর্থ্যের বাইরে বাসা ভাড়া

শহরে বাস করেন এমন নতুন দম্পতির আয়ের একটা বড় অংশই থাকার ব্যবস্থা করতে চলে যায়। নিজ নিজ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের মতো গুছিয়ে নিতে চাইলে খরচ এমনিতেই বেড়ে যায়। তার ওপর যদি দেখনদারির চাপে পড়েন, তাহলেই শেষ। অনেক সময় স্ট্যাটাস ঠিক রাখতে গিয়ে বাড়তি বাসাভাড়ার চাপে পড়েন দম্পতিরা। এ সময় পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধুদের কথায় ব্যয়বহুল বাসা নিয়ে বিপদ বাড়ান দম্পতিরা। কয়েক মাস যেতে না যেতেই বাসাভাড়ার বাড়তি খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।

এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও কাপল কাউন্সিলর রউফুন নাহার। তিনি বলেন, সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে অনেক সময় দম্পতিরা শুরুতেই ব্যয়বহুল বাসা নেন। কিন্তু নতুন সংসারে আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। না হলে কদিন পরই শুরু হয় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। তাই স্থান-কাল এবং নিজেদের সামর্থ্য ও চাহিদা বিবেচনা করে বাসা নিতে হবে। লোকে কী বলবে না ভেবে দেখতে হবে, বাসাটি নিজেদের কর্মস্থলের কাছে কি না, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ঘর আছে কি না এবং দুজনের রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। বাড়তি খরচ ছাড়াই বাসাটি যেন দুজনের থাকার উপযোগী হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর আয় যদি বেশিও হয় বাড়তি টাকাটা বাসাভাড়ায় না দিয়ে সঞ্চয় করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আরও পড়ুন

২. দামি আসবাব

অনেকেই বিয়ের পর একসঙ্গে অনেক দামি আসবাব কিনে ঘর ভরে ফেলেন
মডেল: মাশিয়াত ও ইমন। ছবি: প্রথম আলো

নতুন সংসারের সবকিছুতেই নতুন করে কিনতে হয়। অনেকে এ সময় নবদম্পতিকে দাম দিয়ে ব্র্যান্ডের আসবাব কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর এমনটি করতে গিয়ে অল্প সময়ে বেশ বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়ে যায়। এ বিষয়ে রউফুন নাহার বলেন, নতুন সংসারে অনেক বেশি আসবাবের প্রয়োজন নেই। সেগুলো দামি হতে হবে, এমনটাও না। আসবাব কেনার আগে নিজেরা আলোচনা করতে হবে। একে অপরের রুচির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। একান্তই প্রয়োজনীয় আসবাবগুলো প্রথমে কিনতে হবে। পরে সময় নিয়ে শখের আসবাবগুলো একে একে কেনা যেতে পারে।

হুরায়রা শিশিরের পরামর্শ, শুরুতেই খুব আহামরি দামি বাসা, দামি আসবাবে খরচ করার আগে দুজন মিলে ভাবতে হবে, এটি তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে চালিয়ে নিতে পারবেন কি না। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সংসারের শুরুতেই লোকদেখানোর জন্য বড় বাসা, দামি আসবাব না নেওয়াই ভালো।

৩. পরিবার থেকে দূরে দূরে থাকা

বিয়ের পর পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজ নিজ পরিবার থেকে আলাদা বাসস্থানে থাকতে শুরু করেন অনেক নবদম্পতি। এ সময় অনেকেই বলেন, নবদম্পতিদের শুরুর দিনগুলোয় সবার থেকে আলাদা হয়ে একবারে একান্তে থাকা উচিত। অন্যদিকে নতুন পরিবার পরিস্থিতি সামলে নিজ নিজ পরিবারের জন্য সময় দিতে ব্যথ৴ হন তাঁরা। লোকের পরামর্শ মেনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার খুব একটা চেষ্টা করেন না। এতে নিজ নিজ পরিবার ছাড়াও একে অপরের পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা-মা, ভাই-বোনের সম্পর্কে ছেদ পড়তে শুরু করে। কিন্তু বাসস্থান আলাদা হলেই যে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না, ব্যাপারটি এমন না। হঠাৎ আলাদা থাকা শুরু করলে অভিভাবকেরা দুশ্চিন্তা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁদের সঙ্গে আগের মতো প্রতিদিন দেখা না হলেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। কেননা, আপনার যেকোনো বিপদে বা প্রয়োজনে তাঁরাই প্রথম এগিয়ে আসবেন।

আরও পড়ুন

৪. নিজেকে তৈরি না করেই সন্তান নেওয়া

বাচ্চা নিচ্ছ কবে? এ ধরনের প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যাবেন না
ছবি: প্রথম আলো

‘তুমি তো বুড়িয়ে যাচ্ছ, দেরিতে সন্তান নিলে বড় করবে কবে?’, ‘আর বেশি দেরি হলে যদি সন্তান না হয়?’ বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই নবদম্পতিকে দেওয়া হয় দ্রুত সন্তান নেওয়ার এমন নানা পরামর্শ। নতুন জীবনে নিজেদের খাপ খাওয়াতেই হয়তো কাহিল তাঁরা। ‘তোমরা বাচ্চা নাও, আমরা পেলে দেব’ বলা লোকের কথায় সন্তান নিয়ে লালন–পালনের সময় আর পরামশ৴দাতাদের খুঁজে পান না দম্পতিরা। যাঁর সন্তান তাঁকেই পালতে হয়। তাই লোকের কথায় সন্তান না নিয়ে নিজেরা ভেবেচিন্তে, দুজন আলোচনা করে, মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে তারপর সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করা ভালো।

সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শক হুরায়রা শিশির বলেন, বিয়ের পর কেউ দ্রুত সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিলে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, তবে, সন্তান নিতে চাইলে আগে নিজেদের বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনা করতে হবে। সর্বোপরি, স্বামী–স্ত্রীকে একে অপরের ইচ্ছা–অনিচ্ছাকে সম্মান করতে হবে।

৫. নিজেদের মধ্যে ‘পারসোনাল স্পেস’ না রাখা

নিজের জন্য শুরু থেকেই কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখুন
ছবি: প্রথম আলো

বিয়ের আগের দীর্ঘ একটা জীবনের অভ্যস্ততা ছেড়ে নতুন করে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন নবদম্পতিরা। একে অপরের জীবনব্যবস্থা, চিন্তাধারা, ভালো-মন্দ অভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত হন তাঁরা। অনুভব করতে শুরু করেন একে অপরের ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকেও। কিন্তু অনেক সময় দুজনের একজন বা দুজনই ‘পারসোনাল স্পেস’ বা ব্যক্তিগত পরিসরের অভাব বোধ করেন। এমন পরিস্থিতিতে মনে হতে পারে, একান্ত ব্যক্তিগত বলতে আর কিছুই থাকল না। অনেকে আবার সহকর্মী বা কাছের মানুষজনের চাপে সঙ্গীর ওপর নজরদারি শুরু করেন। চেয়ে বসেন ফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাসওয়ার্ড, যা একেবারেই ঠিক না।

‘বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিগত কিছু থাকে না’, লোকের এমন পরামর্শ না শোনার পরামর্শও দেন রউফুন নাহার। তিনি বলেন, বিয়ের পরের সময়টা একই সঙ্গে যেমন আনন্দময়, তেমনি আবেগপূর্ণ। একে অপরের সবকিছু জানতে ইচ্ছে হয়, সব সময় একসঙ্গে থাকতে ইচ্ছে হয়, ব্যাংকের অ্যাকাউন্টও অনেকে একসঙ্গে খুলতে চান। তবে এটাও স্বাভাবিক যে এই অনুভূতি ও ইচ্ছা সবার সমান না–ও হতে পারে। তাই নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়গুলো একে অপরের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করতে হবে। একে অপরের ইচ্ছাকে সম্মান করতে হবে। বুঝতে হবে, এটি তাঁর ব্যক্তিগত স্থান। উদাহরণস্বরূপ, দাম্পত্যের সম্পর্কেও একে অপরের আর্থিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করাই শ্রেয়।

আরও পড়ুন