ডেটিং অ্যাপে কি সত্যিই ‘মনের মানুষ’ পাওয়া যায়?
‘আমরা মুঠোফোনে কথা বলতাম না, চিঠি লিখতাম। আমার কাছে অনেক চিঠি আছে আমার প্রথম জীবনের, সোনার মতো দামি সেগুলো,’ বিস্তৃত হাসি দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন এক মধ্যবয়স্ক নারী। কিছুক্ষণ পরপরই তাঁর চোখ চলে যাচ্ছিল পাশে দাঁড়ানো পত্রপ্রেরকের দিকে, বর্তমানে যিনি তাঁর স্বামী। সাংবাদিকের চকিত প্রশ্নে অতীত জীবনের প্রেমময় দিনগুলো স্মৃতি হাতরে বের করতে তাঁর যেন এক সেকেন্ডও লাগছিল না। ভালোবাসার স্মৃতি বলে কথা। পুরোনো হয়েছে কিন্তু মলিন হয়ে যায়নি। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায় এই দৃশ্য। মুহূর্তেই তা ভাইরাল!
কিন্তু নেটিজেনদের কাছে চিঠি চালাচালির এই প্রেম এখন প্রাগৈতিহাসিক বিষয়। হবে না–ই বা কেন, এ সময়ে এসে প্রেমের মাধ্যম যেমন বদলেছে, তেমনি বদলে গেছে প্রেমে পড়ার ধরনও। চিঠি ছেড়ে মুঠোফোনের খুদেবার্তায় একসময় প্রেম নিবেদন হয়েছে, এরপর এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যন্ত্রগুলো যত ডিজিটাল হয়েছে, যোগাযোগও হয়েছে তত সহজ। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে প্রেমের ভাষা। ক্রমেই অ্যালগরিদম–শাসিত প্রেমের দুনিয়ায় বাধা পড়ছে প্রেমিক মন। একসময় মনের মানুষ খুঁজতে বিয়ে বাড়ি, দাওয়াত বা স্কুল–কলেজই ছিল প্রধান মাধ্যম। যেখানে একজনকে দেখে গায়ে গায়ে ধাক্কা না খেলেও মনের মধ্যে হোঁচট খেতেন তরুণ–তরুণীরা। এরপর বন্ধুবান্ধব ধরে অথবা পরিবারের ছোট ভাই–বোনেরা একজনের মনের কথা পৌঁছে দিতেন পছন্দের জনকে। অপর পক্ষের সম্মতি পাওয়া গেলেই সেটা প্রেমের দিকে গড়াত। তারপর চিঠি লিখে কোনো মার্কেট, রাস্তার মোড় বা রেস্তোরাঁয় দেখা করার মাধ্যমে চলত ডেটিং। সেই যুগ পেরিয়ে প্রেম এখন এগিয়ে গেছে আরও এক ধাপ। প্রবল শক্তি নিয়ে ডেটিং সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে এখন ডেটিং অ্যাপ। যেখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলির ডান-বাম ঘূর্ণনেই চোখের পলকে মিলছে ভালোবাসার মানুষের খোঁজ। টিন্ডার, বাম্বেল কিংবা হিঞ্জের এই বর্ণিল দুনিয়ার প্রেম ঠিক কেমন, তা-ই এবার জানার পালা।
লকডাউনের সময়টা ঘরবন্দী থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন সালসাবিল রশীদ। তখন তিনি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অনেকটা নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার আগ্রহ থেকেই ডেটিং অ্যাপ টিন্ডারে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন তিনি। সেই সুবাদেই দুই-তিনজনের সঙ্গে পরিচয়। কথাও হলো। কিন্তু একজনের সঙ্গে সখ্যটা যেন একটু বেশিই হলো। সখ্য আরেকটু বাড়ার পর দেখা গেল, বাস্তবেও তাঁদের ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ আছে। ফলে পরিচয়ের পরিধি আরও বেড়ে গেল। অন্তর্জাল ছেড়ে বাস্তব দুনিয়ায় বেরিয়ে এলেন দুজন। সরাসরি দেখা হলো। সালসাবিল বলেন, ‘ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছিল। হাতে তখন অফুরন্ত সময়, প্রচুর কথা চলতে লাগল। দুজনের চাওয়া-ইচ্ছা-স্বপ্ন-মূল্যবোধ নানা বিষয়ে অনেকটাই মিলে গেল। মাসখানেক পর লকডাউন কাটলে দেখাও করেছিলাম কয়েকবার।’
টিন্ডারে পাওয়া সালসাবিলের সেই প্রেম ওই একটি মাসেই শেষ হয়ে যায়নি। মাস পেরিয়ে বছর হলো, চেনাজানার সম্পর্ক ভালোবাসায় রূপ নিল। প্রণয় থেকে ২০২২ সালে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এখন তাঁরা একই ছাদের নিচে সংসার করছেন। ডেটিং অ্যাপে বিশ্বস্ত সঙ্গীর অস্তিত্ব নিয়ে নানান জনের সন্দেহ থাকলেও সালসাবিল মনে করেন ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’ না থাকলে ভিন্ন দুজন মানুষ হয়তো টিন্ডারে পরিচিত হয়ে বিয়ে করে ফেলতে পারতেন না।
শুধু সালসাবিলই নন, আরও অনেকেই আছেন যাঁরা মনে করেন—ডেটিং অ্যাপ থেকেও সত্যিকার ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রাজধানী ঢাকার একটা বহুজাতিক স্বাস্থ্য প্রকৌশল কোম্পানিতে কর্মরত মুহতাসিম আবিদও শোনালেন ডেটিং অ্যাপ বাম্বেল থেকে তাঁর সহচরী খুঁজে পাওয়ার গল্প। তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর প্রায় তিন বছর কোনো সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু একটা সময় এই একাকিত্ব আর ভালো লাগছিল না। ডেটিং অ্যাপগুলো নিয়ে তাই নাড়াচাড়া শুরু করলাম। সেখান থেকেই টিন্ডার ও বাম্বেলে অ্যাকাউন্ট খুলি। তবে টিন্ডারের চেয়ে বাম্বেল অ্যাপটা আমার কাছে বেশি কার্যকর মনে হয়েছে; কারণ, বাম্বেলে স্প্যামিংয়ের সম্ভাবনা কম। সেখান থেকেই মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছি। আপাতত আমরা গভীর প্রেমে আছি।’ একাধিক ব্যবহারকারীর কাছেই বাম্বেল খানিকটা নিরাপদ মনে হয়েছে। নারীদের কয়েকজন জানালেন, নারী ব্যবহারকারীদের জন্যও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এই অ্যাপ। কারণ, চাইলেই পুরুষেরা বাম্বেলে প্রথম বার্তা পাঠাতে পারেন না।
কিন্তু মুদ্রার এ পিঠে যখন ভালোবাসার উষ্ণ বায়ু বয়, তখন অন্য পিঠে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার ঠান্ডা হওয়া। ডেটিং অ্যাপ থেকে ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়ার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি আছে প্রতারিত হওয়ার শঙ্কাও। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’র সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর নাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘অনেকেই ভালোবাসা খুঁজতে ডেটিং অ্যাপের দ্বারস্থ হলেও মনমতো সঙ্গী পান না বলে একাকিত্ব আরও বেড়ে যায়। এতে নিজের ওপর অনাস্থা জন্মায়। আত্মবিশ্বাস কমে যেতে শুরু করে।’ তাই এসব ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারে সতর্ক থাকাও জরুরি। নাদিয়া নাসরিন যোগ করেন, ‘সদ্য ভেঙে যাওয়া প্রেমের কষ্ট লাঘব করতে অনেকেই ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করছেন এখন। বিশেষ করে যাঁদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার নয়, আবার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও মন খুলে কথা বলতে পারছেন না, এ রকম মানুষেরাই অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে চান। তাৎক্ষণিক গড়ে ওঠা সম্পর্ক যখন শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় গড়ায়, ভুলটা তখনই হয়। এটা তখন একটা বড় ইস্যু হয়ে ওঠে। নতুন গড়ে ওঠা সম্পর্কটিতে যখন ফাটল ধরে, তখন হিতে বিপরীত ঘটে। ফলস্বরূপ, ব্যক্তি নিজেকেই সব ঝামেলার মূল হোতা হিসেবে দায়ী করতে থাকে। তবে প্রতিটি জিনিসেরই ভালো খারাপ আছে, এর সম্পূর্ণটাই নির্ভর করে ব্যক্তির উদ্দেশ্যের ওপর।’
বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর—এ চলিত প্রবাদের সুর ধরেই বলতে হয়, ডেটিং অ্যাপে প্রেম কতটা সফল বা বিফল হবে, নির্ভর করছে ব্যবহারকারীর ওপর। ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের মনে রাখা জরুরি, এই অ্যাপগুলো শুধু একটা মাধ্যম। যেখানে সেট করা অ্যালগরিদম আপনার পছন্দ–অপছন্দ অনুযায়ী কিছু মানুষকে শুধু খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। তবে সঠিক মানুষটাকে চিনে–বুঝে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়াটা আপনার কাজ। প্রেম অ্যাপে হোক বা সরাসরি, দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করতে বিশ্বস্ততার বিকল্প নেই।