সন্তান প্রেম করছে প্রথম শোনার পর কী করবেন
১০ থেকে ১৯ বয়সটি বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় কিশোর–কিশোরীদের শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনের কারণে পরস্পরের প্রতি আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে মনে আবেগের ঝড় ওঠে। হঠাৎ করে কাউকে দারুণ ভালো লাগতে থাকে। মনে হয়, তাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন। সব যুক্তি ও বাস্তবতা হার মানে সেই আবেগের কাছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মা–বাবারা একটি চরম ভুল করে বসেন। বেশির ভাগ সময় মা–বাবা সন্তানের এই প্রেমকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ‘যুদ্ধে’ নেমে পড়েন।
সন্তান ভুল করছে ভেবে উত্তেজিত হয়ে বাধা দিতে চান অভিভাবকেরা। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতেই পারে, সেটিকে ব্যাখ্যা না করে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা না বলে উত্তেজিত হয়ে পড়া ঠিক নয়। কখনো আবার মা–বাবার এই খারাপ আচরণ সন্তানের ব্যক্তিত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। যা থেকে সন্তানের আচরণজনিত সমস্যা তৈরি হয় এবং পরিণত বয়সে সন্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনে পড়তে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা-বাবা এমনিতেই চিন্তায় থাকেন। এসব চিন্তার মধ্যে একটি বড় চিন্তা হচ্ছে, সন্তান কার সঙ্গে কখন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তা নিয়ে। যেকোনো ধরনের আবেগীয় সম্পর্ক বা প্রেমকে মা–বাবা ভয় পান। তাঁরা সন্তানকে কঠোরভাবে শাসন করেন, মুঠোফোন কেড়ে নেন, বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন, কখনো সন্তানের বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবীকে শাসান এবং তাদের মা–বাবার কাছে নালিশ করেন। কেউ কেউ সন্তানদের মারধরও করেন; কিন্তু এ ধরনের আচরণ সন্তানের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। হঠাৎ যদি জানতে পারেন, আপনার কিশোর বয়সী সন্তান কোনো আবেগীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, তখন অভিভাবক হিসেবে আপনাকে মনে রাখতে হবে, এই বয়সে আবেগীয় সম্পর্ক কোনো অপরাধ নয়, অস্বাভাবিকও নয়।
সরাসরি সন্তানকে প্রেম করতে দেখলে তো বুঝলেনই, বয়ঃসন্ধিকালের সন্তানের কিছু আচরণ দেখেও ধারণা করা যেতে পারে।
যেভাবে বুঝবেন সন্তান প্রেম করছে
এই বয়সে সন্তান যে আবেগীয় সম্পর্কে জড়িয়েছে তা যেভাবে বুঝবেন—
হঠাৎ তার একটি আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছে, কিছুটা গোপনীয়তা বজায় রাখছে।
সে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে দিন দিন অনাগ্রহী হয়ে উঠছে।
একটু আড়াল হয়ে ফোনে কথা বলছে, কখনো নিচু স্বরে। কেউ কেউ সারা রাত কথা বলছে।
মাঝে মাঝে কিছু মিথ্যা বলছে। বাড়ির বাইরে থাকলে কখনো কখনো নিজের অবস্থান আড়াল করছে।
কেউ কেউ মা-বাবার কাছে তার সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি সরাসরি বা ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছে।
নিজেকে প্রায় সময়ই আগের চেয়ে ধোপদুরস্ত রাখার চেষ্টা করছে।
কারও কারও ক্ষেত্রে আচরণে পরিবর্তন ঘটছে, আগের মতো রূঢ় বা উগ্র ভাব নেই। অথবা কেউ কেউ একটু খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে।
পড়ালেখায় মনোযোগ কমে যাচ্ছে।
কিশোর সন্তানের প্রেমে অভিভাবকদের করণীয়
খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। এটিকে বয়সের স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গণ্য করুন।
সন্তানের সম্পর্কের কথা জেনে কখনো রাগ করবেন না বা উত্তেজিত হবেন না।
সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন। সম্পর্কটি আসলেই প্রেম, নাকি সাময়িক ভালো লাগা বা মোহ, তা জানা ও বোঝার চেষ্টা করুন। সুন্দর, অন্তরঙ্গ পারিবারিক পরিবেশে বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করুন। সন্তানের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটান। যদি মনে করেন, তাদের এই সম্পর্কে পারস্পরিক দায়বদ্ধতা আছে, তখন তাদের সম্পর্কটির মূল্য দিন। অথবা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে জানিয়ে দিন।
তার সম্পর্কের প্রতি অত্যুৎসাহী হয়ে ‘খুব ভালো’ উদার মা–বাবা হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। মনে রাখতে হবে, আপনার সন্তানের বয়স খুব বেশি নয়, তাই তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর আগে সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করুন।
সন্তানের বয়স যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী না হয়, তবে তাকে উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিরত থাকতে বলুন। অপেক্ষা করতে বলুন। হুট করে সম্পর্ক ভেঙে ফেলার জন্য তাকে চাপ দেবেন না।
সবার আগে পড়ালেখা। সব সময় উৎসাহিত করবেন তাদের পড়ালেখাকে। সম্পর্কটি যেন তাদের পড়ালেখার চেয়ে বড় হয়ে দেখা না দেয়।
সম্পর্কটির পরিণতির ভালো-মন্দ সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিন।
যার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক রয়েছে, তার বিষয়ে না জেনে শুরুতেই বিরূপ বা অশোভন মন্তব্য করবেন না। সন্তানের প্রেমিক–প্রেমিকাকে বা তার পরিবারকে হুমকি দেবেন না।
প্রয়োজনে আপনার সন্তান ও তার পছন্দের সঙ্গীকে একসঙ্গে ডেকে যুক্তি দিয়ে আলোচনা করুন।
যদি মনে করেন আপনার সন্তান কোনো বিপজ্জনক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, তখন তাকে বিপদের পরিণতি ব্যাখ্যা করুন।
সন্তান রাগ বা উদ্ধত আচরণ করলে তার সঙ্গে সরাসরি বিরোধে জড়াবেন না। নিজেকে শান্ত রাখবেন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
একটি সম্পর্ক থেকে সন্তানকে দূরে সরিয়ে নিতে আপনার পছন্দের আরেকজনের সঙ্গে তাকে জোর করে (প্রেম বা বিয়ে) জুড়ে দেবেন না।
বয়ঃসন্ধিকালে সে সম্পর্কে জড়াক বা না জড়াক, সন্তানের বয়স অনুযায়ী তাকে বিজ্ঞানসম্মত যৌনশিক্ষা (সেক্স এডুকেশন) দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এই শিক্ষার ফলে সন্তান কোনো সম্পর্কে হঠাৎ জড়িয়ে পড়লেও সে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ শারীরিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত হবে না।
আপনার সন্তান তার ভালোবাসার মানুষকে কোনো বিপদে ফেলছে কি না, সেদিকে নজর দিন। সন্তান নিজেও কোনো বিপদে পড়ছে কি না, খেয়াল রাখুন।
আপনার সন্তান সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রস্তুত কি না, সেদিকে নজর দিন। প্রয়োজনে তাকে প্রস্তুতির জন্য সুযোগ দিন এবং প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্কের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বুঝিয়ে বলুন।
তার সম্পর্কটি অনুমোদন করবেন কি করবেন না, বিষয়টি সার্বিক পরিস্থিতি ও আপনার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করবে। যদি অনুমোদন করেন, তাহলে আপনার সন্তানকে কিছু নিয়মরীতি বেঁধে দিন। এ নিয়মগুলো মেনে চলতে তাকে উৎসাহিত করুন।
শৈশব থেকেই সন্তানের আস্থা অর্জন করুন। এমন পরিবেশ তৈরি করুন, যাতে তারা কখনো কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আপনার কাছে তাদের সম্পর্ক ও এর জটিলতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে।
অনেক সময় দেখা যায়, মা-বাবা একে অপরের কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখেন। এমনটি করা যাবে না। মা–বাবা পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসতে
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট