ভালোবাসায় ব্যর্থ হৃদয়ের কি কোনো দাওয়াই হয়
ভালোবাসা নিয়ে ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারবিশের উক্তিটি বিশ্বব্যাপীই তুমুল জনপ্রিয়।
‘তুমি-ই আমাকে মেরে ফেলছ, আবার তুমি-ই আমাকে মরতে দিচ্ছ না, বাঁচিয়ে রাখছ।’
ভালোবাসা নিয়ে লাখো কথা আছে। সেসবকে ছাপিয়ে কথাটি কেন এত জনপ্রিয়তা পেল?
কেননা উক্তিটির সঙ্গে ভালোবাসার দুষ্টচক্রে আটকে যাওয়া সবাই নিজেদের অবস্থা আর অনুভূতি মেলাতে পেরেছেন।
ভালোবাসা মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি, সন্দেহ নেই। নচিকেতা গানে গানে যখন বলেন, সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা, তখন পাথর কঠিন হৃদয়ের মানুষের হৃদয়টাও মোচড় দিয়ে ওঠে, তলপেটে শুরু হয়ে যায় প্রজাপতির নাচানাচি।
কিন্তু প্রেম কি সব সময়ই প্রজাপতির মতো সুন্দর? এই প্রেমই কি মানুষকে একটা সময় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়ে যায় না? একটা সময় এই তীব্র কষ্টে আমরাও কি বলে উঠি না, সখী ভালোবাসা কারে কয়?
প্রেম-ভালোবাসা আমাদের বেঁচে থাকতে শেখায়। আবার এই প্রেম আমাদের মেরেও ফেলে। অবাক হচ্ছেন? হেলথলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, গবেষণা বলছে, প্রতিবছর যত মানুষ আত্মহত্যা করে, এর সবচেয়ে বড় করে সম্পর্কজনিত জটিলতায়। ৪২ শতাংশ মানুষ এই প্রেম-ভালোবাসা-সম্পর্কিত কারণে বিশেষ করে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা সংসারের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। এর বড় অংশই আবার তরুণ-তরুণী। এসব মানুষের বড় একটা অংশ মারা যায় স্রেফ ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে।
প্রেম বা ভালোবাসা আমাদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু কত বড়? ভালোবাসা কি আমাদের জীবনের চেয়েও বড়? না। বরং বেশির ভাগ মানুষই সিদ্ধান্তটা নেয় ঝোঁকের মাথায়। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার যে প্রাথমিক ধাক্কা, ধাক্কাটা সামলাতে না পেরেই মূলত মানুষ সব কষ্টের সমাধান খোঁজে নিজেকে শেষ করে দেয়। অথচ সচেতন কিছু পদক্ষেপই পারে হার্ট ব্রেকের ধাক্কা সামলিয়ে আপনাকে আরও শক্তিশালী, আরও পরিপূর্ণ একজন মানুষে পরিণত করতে।
‘সত্যেরে লও সহজে’
সত্যকে গ্রহণ করে নিন। কষ্ট সহ্য করে নিতে শিখুন। সবকিছু ঠিক আছে— এরকম কোন মিথ্যে মনোভাব রাখার প্রয়োজন নেই। কারণ, জীবনে সব সময় সবকিছু ঠিক থাকবে না। আপনাকে সব সময়ই জোর করে হাসিখুশি থাকার দরকারও নেই, বরং কাঁদুন। নিজের ভেতরে জমে থাকা কষ্ট, আবেগ বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিন। দুঃখ কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং দুঃখ আপনার জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ, অন্য সব অনুভূতির মতো একটা অনুভূতিমাত্র। আর এরও শেষ আছে।
নিজের প্রতি দয়ালু হোন
দয়া মানবসভ্যতার অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে সবার আগে নিজের প্রতি দয়ালু হোন। নিজেকে ভালোবাসুন। নিজেকে ক্ষমা করে দিন। যেকোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর আমরা নিজেদের দোষারোপ করতে থাকি। মনে হয়, সবকিছুর জন্য আমিই বোধ হয় দায়ী। এই দোষারোপ থেকে বের হয়ে আসুন। নিজের প্রতি সমব্যথী হোন।
সাহায্য চান
মা, কাছের মানুষ, বন্ধুদের কাছে সাহায্য চান। আপনার মনের কথা খুলে বলুন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার কঠিন সময়ে পাশে থাকার মতো অনেক মানুষই আপনার আশপাশে থাকে। এসব মানুষকে কাছে টেনে নিন। এই সময় বেশি করে সামাজিক জীবন যাপন করুন। বিকেলে খেলতে যান। আড্ডা দিন। শপিং করুন। যদি আপনার আর আপনার প্রাক্তনের বলয় একই হয়ে থাকে, তখন নিজের নতুন আরেকটা বলয় তৈরি করে নিন। একজন ভালো বন্ধু আপনার এই কঠিন যাত্রাকে অনেকখানি সহজ করে দিতে পারে।
সময় নিন, সময় দিন
নিজের শখ, আগ্রহ আর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করুন। এত দিন যে বই পড়ব পড়ব করেও পড়া হয়নি, যে জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হয়নি বা যে সিনেমা দেখতে চেয়েও দেখতে পারেননি, এবার একটা একটা করে সব করে ফেলুন। আমরা অন্যের শখ পূরণে এত ব্যস্ত থাকি যে নিজের শখ পূরণের সময় করে উঠতে পারি না। নিজেকে সময় দিন। সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করুন।
নিজেকে অতীতমুক্ত করুন
নিজেকে নিজের অতীতের বোতলে আটকে রাখবেন না। প্রাক্তনের সঙ্গে সব যোগাযোগ মুছে ফেলুন। মনে রাখবেন, অতীতে আপনি যত দিন আটকে থাকবেন, সুন্দর ভবিষ্যতের স্টেশনটাও আপনার থেকে তত বেশি দূরে সরে যেতে থাকবে। যেটা ঘটে গেছে, সেখানে আপনার আর কিছুই করার নেই। এটা যত দ্রুত মেনে নেবেন, তত সহজে বিষয়টি ঝেড়ে ফেলতে সুবিধা হবে।
এই পুরো সময়ে সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটা, জানেন? নিজেকে ভালোবাসা, নিজের প্রতি মায়া করা। এ সময়ে মানুষ এমনকি নিজের ছায়াকেও সহ্য করতে পারে না, সবকিছুকেই কেমন যেন অবাস্তব মনে হয়, বৃথা মনে হয় বেঁচে থাকাও। কিন্তু একবার যদি আপনি দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য আর শক্তি দিয়ে সময়টা পার করে ফেলতে পারেন, দেখবেন, আপনি আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, বুঝদার মানুষে পরিণত হয়েছেন।
জীবন আপনাকে এমন কোথাও নিয়ে যেতে পারে, যেটা আপনি সুখস্বপ্নেও ভাবেননি। আপনাকে এমন কিছু উপহার দিতে পারে, যেটার কথা আপনি কল্পনাও করেননি। আপনি এতটা সুখী হতে পারেন, যতটা আপনি কোনদিন ছিলেন না।কেবল ওই সময়টা ‘সারভাইভ’ করে যান, যেভাবে হোক কেবল টিকে যান! একটা সময় মনে হবে, এই কষ্টের সময়টা ছিল জীবনেরও একটা ছোট অংশ, যা আপনাকে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিণত করেছে। পারস্যের কবি জালালউদ্দীন রুমি বলেছেন, ক্ষতস্থান দিয়েই আলো তোমার ভেতরে প্রবেশ করে। সেই আলোর জন্য অপেক্ষা করুন, বেঁচে থাকুন। আলো আসবেই।
সোর্স: টুডে ডট কম, হেলথলাইন