স্বামী–সন্তান রেখে শুধু প্রেমের টানেই কি দেশ ছেড়েছিলেন সোনালী দাশগুপ্ত
১৯৫৭ সালে স্বামী, সন্তান, দেশ ছেড়ে গোপনে ফ্রান্সে পালিয়ে যান সোনালী দাশগুপ্ত, পদবি পাল্টে হয়ে যান সোনালী রসেলিনি। কিসের টানে সব ছেড়েছিলেন এই বাঙালি নারী? ৬৮ বছর আগে হলিউড–বলিউড তোলপাড় করা সেই প্রেমকাহিনিই ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে পাঠকদের শোনাচ্ছেন হাসান ইমাম।
তিন পর্বের লেখার প্রথম পর্ব পড়ুন আজ।
নয়াবাস্তববাদী সিনেমার কল্যাণে দুনিয়াজুড়ে তখন পরিচিত এক নাম রবের্তো রসেলিনি। একই সঙ্গে তিনি হলিউড অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যানের স্বামী, যাঁর অভিনয় আর রূপে মুগ্ধ সারা বিশ্ব। সেই রবের্তোই ভারতে একটা ছবির কাজ করতে এসে এক বাঙালি গৃহবধূর প্রেমে পড়লেন! ২৭ বছর বয়সী এই তরুণীর নাম সোনালী দাশগুপ্ত, স্বামী চিত্রপরিচালক হরিসাধন দাশগুপ্ত। তাঁদের দুই শিশুসন্তান—রাজা ও অর্জুন। সেই সময়ে কলকাতা থেকে রোম, হলিউড থেকে বলিউড—সর্বত্র দারুণ আলোড়ন তুলেছিল এই সাহসী প্রেম। ১৯৫৭ সালে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রায় নিয়মিত ছাপা হতো এই ‘নিষিদ্ধ’ প্রেমাখ্যান। যে ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত।
রবের্তোর ভারতযোগ
জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারত তখন ব্রিটিশ বিদায়ের এক দশক পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ভারত নিয়ে ছবি বানাতে ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে ভারতে আসেন রবের্তো রসেলিনি। রবের্তোর নয়াবাস্তববাদী (নিওরিয়েলিজম) সিনেমা তখন সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধ নিয়ে তাঁর ট্রিলজি ‘রোম, ওপেন সিটি,’ ‘পায়সান’ ও ‘জার্মানি, ইয়ার জিরো’র কল্যাণে তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের একজন বলা হচ্ছে। আর রসেলিনি ভারতে আসার কয়েক বছর আগেই ১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবও হয়ে গেছে। এই প্রথম ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীরা এক নতুন ধারার সিনেমা দেখলেন। যেখানে রবের্তো রসেলিনির ট্রিলজি ছাড়াও ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’–এর মতো সিনেমা দেখার সুযোগ পান ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীরা।
শুধু দেখা নয়, এই চলচ্চিত্র উৎসবের পর থেকে ভারতীয় অনেক পরিচালক, সমালোচক নতুন করে সিনেমা নিয়ে ভাবতে থাকেন। আর এই নতুন ভাবনার ফলাফল তো পরের বছর থেকেই ভারতীয় সিনেমায় দেখা দিতে থাকে। বাঙালি পরিচালক বিমল রায় পরের বছরই রিলিজ করলেন ‘দো বিঘা জমিন’, যা মূলত নিওরিয়েলিস্টিক সিনেমার আরেক পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকার অনুপ্রেরণায় তৈরি। ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’ সত্যজিৎ রায়কেও প্রভাবিত করেছিল। পরে ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেন সত্যজিৎ রায়।
ভারতের সঙ্গে রবের্তোর সম্পর্ক অবশ্য আরও পুরোনো, উপলক্ষ ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। রবের্তো তখন ২৫ বছরের টগবগে যুবক, বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে। রবের্তোদের একটা বাড়িঘর নির্মাণের প্রতিষ্ঠান ছিল, আর ছিল সিনেমা হল। তবে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় তাঁদের অবস্থা পড়ে যায়। ১৯৩১ সালের মাঝামাঝি রবের্তোরা তাঁদের বাড়িটি বেঁচে দেন কাউন্ট কার্নেভালি ব্রেইদার ভিয়ার কাছে। লন্ডন থেকে ফেরার পথে সে বছরই এই বাড়িতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। আর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গান্ধীর সংগ্রাম তখন ইতালির শিক্ষিত সমাজেরও জানা। তাই কাউন্টের বাড়িতে গান্ধী আসছেন শুনে আগেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন রবের্তো।
সোনালী-হরির সংসার
শিল্পকলা ও সংগীতের ছাত্রী ছিলেন সোনালী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে তাঁকে পড়িয়েছেন মা–বাবা। শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সখ্য। যে সখ্য পরে অনেক বৈতরণি পেরোতে তাঁকে সাহায্য করে। শান্তিনিকেতন থেকে পাস করার পর বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সোনালীর বাবাও চেয়েছিলেন প্যারিস বা সরবোনে পড়তে যাক মেয়ে। কিন্তু দেশেই থাকবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন সোনালী।
হলিউডে কাজ শিখে সদ্যই তখন দেশে ফিরেছেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। সত্যজিৎ রায়সহ সমমনা কয়েকজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন কলকাতার প্রথম ফিল্ম সোসাইটি। ছবি দেখতে দেখতেই একসময় ঠিক হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে–বাইরে’কে সিনেমায় রূপ দেবেন। পরিচালনা করবেন হরিসাধন আর চিত্রনাট্য লিখবেন সত্যজিৎ রায়। সিনেমার নায়িকা হিসেবে ‘সুন্দরী ও ট্যালেন্টেড’ সোনালীকে বাছাই করা হলো। শান্তিনিকেতনের ছাত্র সত্যজিতের মাধ্যমে সোনালীর সঙ্গে হরিসাধনের পরিচয়। ছবির সূত্রেই সোনালী ও হরিসাধনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। সোনালীর চিকিৎসক বাবারও তাতে অমত ছিল না। প্রযোজক না পাওয়ায় সেই সিনেমা শেষ পর্যন্ত আর হলো না। তবে মনের মানুষ পেয়ে গেলেন হরিসাধন। সোনালী-হরিসাধনের বিয়ে হয়ে গেল, তাঁদের বিয়ের কার্ডের নকশা করে দিলেন বন্ধু সত্যজিৎ রায়।
আরও বড় পরিসরে কাজ করতে কলকাতা ছেড়ে বোম্বেতে চলে যান হরিসাধন। ভারতের চলচ্চিত্র বিভাগ ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হয়ে তথ্যচিত্র বানাতে থাকেন। পরে তিনি বাণিজ্যিক সিনেমাতেও জড়িয়ে পড়েন। বোম্বেতে হরিসাধন যখন একের পর এক প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত, পাঁচ বছরের ছেলে রাজা দাশগুপ্তের পরে সোনালীর কোলে তখন কয়েক মাসের দুধের শিশু অর্জুন দাশগুপ্ত।
ফরাসি পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া এরও দুই দশক পর আবার রবের্তোকে ভারত বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন। ‘দ্য রিভার’ সিনেমার শুটিং করতে ১৯৪৯ সালে ভারতে এসেছিলেন রেনোয়া। এই সিনেমার লোকেশন খুঁজতে গিয়েই সত্যজিৎ রায়, হরিসাধনের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে তাঁর। শুটিংয়ে রেনোয়ার সহকারী ছিলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। ‘দ্য রিভার’–এর পর হলিউডের অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যানকে নিয়ে পরবর্তী ছবি করেন জ্যঁ রেনোয়া। রবের্তোকে বিয়ে করে ইনগ্রিড তখন রোমে বাস করছেন। প্রায় দেড় বছর ধরে ইতালিতে সেই সিনেমার শুটিং চলাকালে রবের্তো আর রেনোয়ার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই সময়ই রেনোয়ার মুখে ভারতের গল্প শুনে শুনে মনে মনে ভারত নিয়ে পরের প্রজেক্ট সাজাতে থাকেন রবের্তো। তবে গান্ধীর চেয়ে স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে দেখে আরও বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন রবের্তো। আর তাই ১৯৫৫ সালে নেহরুর বিদেশ সফরের সময় স্ত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যানের সহায়তায় তাঁর সঙ্গে দেখা করেন রবের্তো রসেলিনি। প্রথম সাক্ষাতেই নেহরুকে স্বাধীন ভারত নিয়ে ছবি বানানোর ইচ্ছার কথা জানান রবের্তো, যে ছবিতে এক অন্য রকম ভারতকে দেখবে পৃথিবী। রবের্তোর এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান নেহরু।
রবের্তোর ভারত অভিযান
ভারতের সাধারণ পাঠকের কাছে ইতালিয়ান পরিচালক রবের্তো রসেলিনির প্রধান পরিচয় তিনি ইনগ্রিড বার্গম্যানের স্বামী। আর তাই ভারতের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে খবর বের হলো—হলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গম্যান স্বামীর সঙ্গে ভারতে আসছেন। এই শুনে নির্ধারিত দিনে এয়ারপোর্টে হাজির হয়েছিলেন অনেক সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে বিমান থেকে নেমে এলেন রবের্তো রসেলিনি একা। ঠিক একাও নয়, বলা ভালো স্ত্রীকে ছাড়া (সঙ্গে লাটবহর তো এসেছিল)।
তত দিনে ইনগ্রিডের সঙ্গে রবের্তোর একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। হলিউডে তুঙ্গে থাকা ক্যারিয়ার ছেড়ে ইনগ্রিডের ইতালিতে এসে থাকা, রবের্তোর একাধিক ছবির বাণিজ্যিক ব্যর্থতা—ইত্যাদি কারণে দুজনের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ইতালির এক সাংবাদিককে পরে রবের্তো বলেছিলেন, ‘ভারতে যাওয়ার আগে ইনগ্রিড আর আমার সম্পর্ক একদম তলানিতে এসে ঠেকে।’ রসেলিনির জীবনে ইনগ্রিডের আগেও একাধিক নারী এসেছেন, কখনো প্রেমিকা হয়ে, কখনো স্ত্রী হিসেবে। এর মধ্যে অন্তত পাঁচজনের নাম রবের্তোর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও আত্মজীবনীতেই আছে। ইনগ্রিডের সঙ্গে মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেই রবের্তোর এই ভারত–যাত্রা। রসেলিনি ভারতে যাচ্ছেন শুনে পরিচালক জ্যঁ রেনোয়া তাঁকে হরিসাধন দাশগুপ্তের নাম–ঠিকানা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হরিই হবে তোমার সবচেয়ে ভালো সঙ্গী। ওখানকার সব শ্রেণির মানুষকে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করতে পারবে। এই সূত্র ধরেই পরে হরির জীবনে অভিশাপ হয়ে আসেন রবের্তো।
সোনালী–রবের্তোর প্রথম দেখা
মুম্বাই শহরের তাজ হোটেলে এসে ওঠেন রবের্তো রসেলিনি। রবের্তোর ভারতীয় সহযোগীদের একজন ছিলেন তরুণ কিট্টু। ইউরোপে রবের্তোর সঙ্গে আগে কিছুদিন কাজও করেছিলেন এই কিট্টু। দক্ষিণ মুম্বাইয়ের বসুন্ধরা নামক এক বহুতল ভবনে থাকতেন কিট্টু, হরিসাধনও তাঁর পরিবার নিয়ে এই বহুতল ভবনেই থাকতেন। দুজনের বন্ধুত্বও ছিল। হরিসাধনই কিট্টুকে গিয়ে ধরেন যে তিনি রবের্তোর সঙ্গে দেখা করতে চান। কিট্টুই তাঁকে তাজ হোটেলে নিয়ে যান, সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী সোনালী দাশগুপ্ত। প্রাথমিক আলাপের পরই রবের্তো বুঝতে পারেন, এই হরিসাধনের কথাই তাঁকে বলেছিলেন রেনোয়া। তবে হরিসাধন শুরুতেই জানান, টাটার একটি প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রবের্তোর সঙ্গে কাজ করতে পারছেন না। ততক্ষণে সোনালীতে আটকে গেছে রবের্তোর চোখ। নিজের লেখা কিছু কাগজ (চিত্রনাট্যের খসড়া) সোনালীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেগুলো পড়ে এক সপ্তাহ পর মতামত জানাতে বলেন।
এই অজুহাতে আবারও তাঁদের দেখা হয়। এই সময় রবের্তোর একাধিক সহকারীর চোখে পড়ে, সোনালীকে মুগ্ধ করতে নানা চেষ্টা চালাতে থাকেন রবের্তো। সোনালীকে এই সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাবও দেন রসেলিনি, সোনালী রাজি হননি। ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় সাংবাদিক ও রাজনীতিবিশ্লেষক রমেশ থাপারের জন্মদিনের পার্টিতে দাশগুপ্ত দম্পতির সঙ্গে রসেলিনির আবার দেখা হয়। এই রাতেই রসেলিনির সঙ্গে সোনালীর প্রেমের সম্পর্কের শুরু, হরিসাধনের এমনটাই ধারণা। তবে সেই রাতে হরিসাধনই বরং স্ত্রীর চাকরির কথা তুলেছিলেন রসেলিনির কাছে। আর সেখান থেকেই পরে ঠিক হয়েছিল, সোনালী চিত্রনাট্য লেখার কাজে সাহায্য করবেন। কিছু একটা বুঝতে পেরেই হয়তো কাজটা করতে রাজি হচ্ছিলেন না সোনালী। বিশেষ করে রসেলিনি যে তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেটা না বোঝার মতো নারী সোনালী ছিলেন না। কিন্তু হরিসাধন জোরাজুরি করতে থাকলে একসময় রাজি হয়ে যান সোনালী। এভাবে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিখ্যাত রবের্তো রসেলিনির ভারতীয় প্রজেক্টের চিত্রনাট্য লেখার দলে যুক্ত হয়ে গেলেন সোনালী দাশগুপ্ত। এর পর থেকেই নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে ঘটনা।
সূত্র:
দিলীপ পদগাঁওকরের বই ‘আন্ডার হার স্পেল: রবের্তো রসেলিনি ইন ইন্ডিয়া’
‘সোনালী মায়ায় ভারতে রবের্তো রসেলিনি’ (গৌরী চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ)
রবের্তো রসেলিনির আত্মজীবনী
ইনগ্রিড বার্গম্যানের ‘মাই স্টোরি’
আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ম্যাজিক লন্ঠন ইত্যাদি