যখন দ্বিতীয় বিয়েতেও সমস্যা

দ্বিতীয়বার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই দুজন মিলে বােঝাপড়া করে নেওয়া ভালো।
ছবি : সুমন ইউসুফ

রিশাদ আর নীলার পরিচয় হয়েছিল পারিবারিকভাবেই। দুজন কিছুদিন একে অপরকে জানার চেষ্টা করেছিলেন, তারপরই বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন ভালোই চলছিল, ধীরে ধীরে দুজনের পছন্দ-অপছন্দে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করে। শুরুতে সংসারের কাজ ভাগাভাগি নিয়ে ছিল দ্বন্দ্ব, মতানৈক্য হয় যৌথ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও।

সেই ছোট ছোট দ্বন্দ্ব একসময় তীব্র দাম্পত্যকলহে রূপ নেয়, ফলাফল বিচ্ছেদ। দুই পরিবারের শত মধ্যস্থতায় নীলা বা রিশাদ কেউই নিজেদের দাম্পত্যে আর সময় দিতে চাননি।

বিচ্ছেদের বছরখানেক পর দীর্ঘদিনের সহকর্মী জাফরকে বিয়ে করেন নীলা। জাফর যেহেতু সব জেনেশুনে বিয়ে করতে আগ্রহী হয়েছিলেন, তাই নীলাও চেয়েছিলেন নতুন করে শুরু করতে।

নতুন সর্ম্পকের সঙ্গে কখনো আগের সর্ম্পকের তুলনা করা যাবে না।
ছবি : কবির হোসেন

কিন্তু এবারও বছর না ঘুরতেই যেন আগের সংসারেরই ফ্ল্যাশব্যাক দেখতে পাচ্ছিলেন নীলা। যে জাফরকে তিনি সহকর্মী হিসেবে দেখে এসেছেন অত্যন্ত সংবেদনশীল, সেই জাফরকেই স্বামী হিসেবে অন্য স্বভাবের আবিষ্কার করছিলেন। বারবারই রিশাদের সঙ্গে জাফরের তুলনা করে ফেলছিলেন নীলা। সেই একই স্বভাব, একই আচরণ, একই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আবার বিচ্ছেদের কথা ভাবতেও সাহস পাচ্ছিলেন না। পরিবার-সমাজ কী বলবে, সে ভয় তো ছিলই, তিনি নিজেও আবার একা পথ চলার সাহস দেখাতে পারবেন কি না ভাবছিলেন।

সব ভেবে নীলার বারবার মনে হচ্ছিল, সমস্যা বোধ হয় তারই। না হলে কোথাও মানিয়ে নিতে পারেন না কেন?

ফ্রিল্যান্সার রাইনা অবশ্য দ্বিতীয় বিয়ে কেন করলেন, সেটা ভেবেই আজকাল ভীষণ আফসোস করেন। কারণ, প্রথম বা দ্বিতীয়; কোনো বিয়েতেই নিজের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।

রাইনা প্রথমে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আফজালকে। শুরুতে পরিবার রাজি ছিল না, কারণ দুই পরিবারের মধ্যে ছিল বিস্তর সামাজিক ফারাক। কিন্তু রাইনার জেদের কাছে হার মানেন বাবা, ধুমধাম করেই বিয়ের আয়োজন করেন।

কিন্তু ছয় মাস যেতেই রাইনা বুঝতে পারেন, তার আর আফজালের বেড়ে ওঠার মধ্যে যে সামাজিক ও আর্থিক ব্যবধান, তা দূর হওয়ার নয়। রাইনা ভীষণ পরিশ্রমী, ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে ভালোবাসেন। অন্যদিকে আফজালের জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।

দ্বিতীয় বিয়ের সময় নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ না হলে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
ছবি : প্রথম আলো

খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পর্ক বেশি দিন টানতে পারেননি রাইনা। বিচ্ছেদ শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান ঢাকার বাইরে। এরপর তার জীবনে আসেন সাঈফ। যিনি পেশাগত ও পারিবারিক মর্যাদার দিক দিয়ে রাইনার সমকক্ষ। ফলে আবারও গাঁটছড়া বাঁধেন রাইনা।

বিয়ের পর আবারও ধাক্কা খেতে হয় রাইনাকে। সাঈফ মায়ের হুকুম ছাড়া এক পা-ও নড়েন না। মায়ের অনুমতি না নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুরতেও যান না তিনি।

কী রান্না হবে থেকে শুরু করে কে কখন কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে, কী খাবে, কখন বাড়ি ফিরবে; সবকিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হয়। নতুন এই পরিবারে এসে হাঁসফাঁস করতে থাকেন রাইনা। আবার বিচ্ছেদ হলে সমাজকে কী জবাব দেবেন, পরিবারের মুখোমুখি কীভাবে হবেন, সে ভাবনাই পোড়াচ্ছে তাকে।

দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে এই সমস্যা কেবল নীলা বা রাইনার নয়। বিশ্বের সবখানেই নারী-পুরুষ এই সংকটে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের শতবর্ষী ম্যাগাজিন গুড হাউজকিপিংয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে ২০২২ সালে দ্বিতীয় বিবাহের বিচ্ছেদের হার প্রথম বিবাহে বিচ্ছেদের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি।

প্রথম সংসারের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা দ্বিতীয় সংসারে বয়ে নিয়ে এলে তা ক্ষতির কারণ হয় বলে মনে করেন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডা. শেরিল ফ্রাসার। তিনি বলেন, কেবল ভালো উদ্দেশ্য বা সম্পর্ক চালিয়ে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেই বিবাহিত জীবনকে দীর্ঘমেয়াদি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন আত্মসচেতনতা ও আন্তব্যক্তিক দক্ষতা।

সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করা গেলে জীবনের সবকিছু সহজ হয়ে যায়, এই ধারণাকেও খারিজ করেন তিনি। বলেন, ‘আমরা যদি দ্বিতীয়বার বিয়ের পর সব সময় মনে করি যে সঙ্গী আমাকে সব সময় সুখী করার চেষ্টা করবে, আর সেটা করতে না পারলেই মনে করি যে ভুল মানুষকে বিয়ে করেছি; তাহলে আমাদের ভাবনাটাই ভুল। কারণ “আদর্শ সঙ্গী” বলে আসলে কিছু হয় না।’

ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় বিয়েতে অবাস্তব কোনো প্রত্যাশা রাখা যাবে না।
ছবি : কবির হোসেন

প্রতিবেদনটিতে দ্বিতীয় বিয়েতে সুখী হওয়ার কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়, দ্বিতীয় বিয়েতে অবাস্তব কোনো প্রত্যাশা রাখা যাবে না। প্রত্যেকের ভাগের দায়িত্বটুকু ঠিকঠাক পালন করতে হবে। সম্পর্কে ভাঙা–গড়া শুরু হলেই আপনি আবারও ভুল মানুষকে বিয়ে করেছেন, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, সত্যিকার সম্পর্ক ভালো-মন্দ মিলিয়েই এগিয়ে যায়।

প্রথম সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণগুলো খুঁজতে হবে, নিজের মধ্যে কোনো বদল আনা প্রয়োজন হলে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দুজনের মধ্যে ভালোবাসা বাড়ে, এমন কাজে মনোযোগী হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাউফুন নাহার বলেন, সাধারণত দ্বিতীয় বিয়ের সময় একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে যে আগের বিয়েতে যা পাওয়া যায়নি, এবার তা পাওয়া যাবে। আগেরটা ছিল নরক, এখন স্বর্গ মিলবে। কিন্তু আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। সে কারণেই সংকটটা শুরু হয়।

সম্পর্কে ভাঙা–গড়া শুরু হলে আবারও ভুল মানুষকে বিয়ে করেছেন, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ছবি : সুমন ইউসুফ

বাংলাদেশে যেকোনো সম্পর্কে সীমারেখার চর্চা করা হয় না উল্লেখ করে রাউফুন নাহার বলেন, সঙ্গীর ওপর কতটুকু অধিকার দেখালে সেটা অনধিকারচর্চা হয়ে উঠবে না, সেটা সবারই জানা উচিত। অনেকেই আছেন, আগের সংসারে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ফলে নতুন সংসারে এসে স্বামীকে মুঠোফোনে কথা বলতে দেখলেই সন্দেহ থেকে তার ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করেন। এটা আসলে একধরনের অনধিকারচর্চা। সন্দেহ হলে দুজন মিলে বসে খোলামেলা কথা বলে তা মিটিয়ে নিতে হবে। তা না হলে সমস্যা বাড়বেই, কমবে না।

দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কাপল কাউন্সেলিং নেওয়ার পরামর্শ দেন রাউফুন নাহার। এতে দুজন দুজনকে বুঝতে ও নতুন সম্পর্কে যাওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সুবিধা হয়। আপনি আসলেই দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রস্তুত কি না, সেটাও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।