বিয়ের প্রথম বছরটা সামলে নেবেন যেভাবে
শালিক চৌধুরী আর জীবন আহমেদ এখন কানাডাপ্রবাসী। বিয়েটা হয়েছিল ভালোবেসে, পদ্মায় ভেসে ভেসে। শালিক তাঁর মায়ের জামদানিতে সেজে কাজি আর কাছের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে উঠে পড়েছিলেন নৌকায়। বিয়ের পর দেখা গেল, যে রকম ভেবেছিলেন, কিছুই সে রকম নয়। শালিকের ভাষায়, ‘জীবন আমার ক্যাম্পাসের বন্ধু, পাঁচ বছর ধরে আমরা দুজন দুজনকে চিনি। বিয়ের পর যেন একটা অচেনা মানুষের সঙ্গে সংসার শুরু করলাম। আমাদের খাওয়া, পরা, রুচি, পছন্দ-অপছন্দ, প্রত্যাশা—কোনো কিছুরই কোনো মিল নেই। নদীর বুকে বিয়ে করেছিলাম, বিয়ের পর মনে হলো অথই সাগরে পড়লাম।’
এ রকম দীর্ঘদিনের চেনাজানা দুজন মানুষও এক ঘরে বাস শুরু করলে বুঝতে পারেন, চেনাটা পুরোনো হলেও জানাটা নতুন। আর বিয়ের আগে চেনাজানা না থাকলে তো কথাই নেই। একটু একটু করে চিনতে–জানতেই চলে যায় অনেকটা সময়। এর মধ্যে কখনো সম্পর্ক টিকে যায়, কখনো আবার মাঝপথেই হয় ছন্দপতন। তবে নতুন জীবনে প্রবেশের শুরুতেই দুজন কিছু বিষয় আলোচনা করে ঠিক করে নিলে সমস্যা অনেকটাই এড়ানো যায়।
বিয়ে ও সম্পর্কবিষয়ক পরামর্শক হুরায়রা শিশির বলেন, বিয়ে নিয়ে অনেকেই ঘোরে থাকেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাস্তবতার মুখোমুখি হন। তখন হতাশা ভর করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি দিতে চান কম, পেতে চান বেশি। সঙ্গীকে দাঁড় করান ব্যক্তিগত কাঠগড়ায়। তখন হয়তো কেউ একজন জিতে যান। কিন্তু হেরে যায় সম্পর্ক।
নতুন দাম্পত্যে যে কটি চেনাজানা বিষয় পর্বত হয়ে সামনে দাঁড়ায়, সেগুলো জয় করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন কিছু নয়। তবে দক্ষ পর্বতারোহী হতে প্রশিক্ষণটা শুরুতেই নিতে হবে।
নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া
বিয়ের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশটা দুজনের জন্যই নতুন। ভিন্ন দুজন পরিণত মানুষ এক ছাদের নিচে থাকা সহজ কর্ম নয়। শুরুর সময়টা সত্যিই কঠিন। হুট করে কোনো পরিবর্তন আশা করবেন না। সময়ের হাতে ছেড়ে দিন কিছু বিষয়। মনে রাখবেন, সময়ের চেয়ে বড় শিক্ষক আর নেই। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি অনেকটাই থিতু হয়ে আসবে। সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরে উদারতা আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামাল দিতে হবে। ‘পারফেক্ট সম্পর্ক’ কেবলই মিথ। কোনো সম্পর্কই সমান্তরালে, সমানুপাতে এগোয় না। সম্পর্কে একজন বেশি দেয়, আরেকজন বেশি পায়। এটাই অলিখিত নিয়ম। তবে সেটা যেন সীমার ভেতরে থাকে। বিয়ের সম্পর্ক আর ‘আপস করা’ অনেকটাই সমার্থক, সেটা সব পক্ষ থেকেই।
নতুন মানুষটাকে আপন করে, পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের দায়িত্বই বেশি। দুই পক্ষ থেকেই আন্তরিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বরের জন্য শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নেওয়া অনেকটা সহজ, তাই স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে আসার পর স্বামীকে একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয়। তাঁর পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ‘বাস্তব চরিত্র’ সম্বন্ধে নতুন বউকে ধারণা দিয়ে রাখুন। তাহলে নতুন বউয়েরও তাঁদের বুঝতে সুবিধা হবে। অঞ্চলভেদে খাবার নিয়েও নানা রকম ভিন্নতা আছে। তাই কাঁচা মাছ সরাসরি ঝোলে যাবে, নাকি আলাদা করে ভেজে নিতে হবে, সেটা বুঝে নিতে হবে। বেশির ভাগ লোক যেদিকে, সেই মতো চলাই ভালো, তবে নিজের জন্য আলাদা কিছু করতে চাইলে সেটাতেও বাধা দেওয়া যাবে না।
ইগো পাশে রেখে কথা বলুন
ম্যারেজ ডটকমের গবেষণা অনুসারে, বিয়ের প্রথম বছরটা সবচেয়ে কঠিন। শুরুর দুই বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যত বিচ্ছেদ, এর ৬০ শতাংশই ঘটে প্রথম দুই বছরের ভেতরে। ২৫ শতাংশ ঘটে ৩ থেকে ৫ বছরের ভেতর। আর বিবাহিত জীবনে ৫ বছর পার করে ফেলার পর বিচ্ছেদ ঘটে মাত্র ১৫ শতাংশ। এর মানে আপনি যদি ৫ বছর বিবাহিত জীবন পার করে ফেলেন, তাহলে সেটা টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮৫ শতাংশ।
মার্কিন কাপল থেরাপিস্ট জন গটম্যান বলেন, দুজন মানুষকেই ‘অসীম ধৈর্য’ রাখার মানসিকতা নিয়ে শুরু করতে হবে। খোলামেলা আলাপ করতে হবে। আর সেখানে অহংয়ের কোনো স্থান নেই। কখনো ভাববেন না যে আরেকজন তো বুঝে নেবে! রাগ, অভিমান পুষে রাখবেন না। ক্ষমা করে দেবেন। ভুলেও যাবেন। তাতে আপনার নিজের ওপর থেকেই ভার কমবে। পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আপসের মানসিকতা রাখতেই হবে।
এই বিয়ে পরামর্শক আরও বলেন, সবার আগে দায়িত্বটা নিজের প্রতি। নিজেকে খুশি রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। কেবল অন্যের মন রক্ষা করার জন্য আপনি নিজে যেটা মন থেকে চাইছেন না, জোর করে করবেন না। কেননা এর ফলে আপনি অন্যকেও খুশি করতে পারবেন না। আর নিজেকে তো না-ই! যেকোনো বিষয় যৌক্তিকভাবে বুঝিয়ে বলুন। বলতে না পারলে লিখে প্রকাশ করুন।
একেক মানুষের একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য। তাই কারও ক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি থাকলে আপনিই উষ্ণ সম্পর্কের হাত বাড়িয়ে দেন, ক্ষতি কী!
টাকাপয়সার হিসাব–নিকাশ
অর্থ ব্যবস্থাপনা বিয়ের সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বেশির ভাগ সময় ‘পরিস্থিতি’ বলে দেয়, সংসারের কোন খরচ কার পকেট থেকে যাবে। তবে অর্থের হিসাব মানেই যে পুরো টাকার হিসাব নিয়ে বসবেন, সেটা নয়। সংসারটা যদি শুধুই দুজনের হয়, তাহলে হয়তো এই হিসাব কিছুটা সহজ। তবে যৌথ পরিবার হলে সেখানেও সরাসরি অর্থিক বিষয়ে কথা বলে নেওয়া ভালো। কর্মজীবী নতুন বউ যদি বিয়ের পর স্বামীর যৌথ পরিবারে এসে বসবাস শুরু করেন, তাহলে তাঁর টাকাপয়সা নিয়ে পরিবারের অন্য কেউ কথা বলার চেয়ে স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মধ্যেই আলাপ করা ভালো। বিয়ের পর স্বামীরও হয়তো খরচের হাত কমানোর দরকার পড়তে পারে। আবার নতুন নতুন খরচের জায়গা তৈরি হবে, সেটাও দুজন মিলে আলোচনা করে খরচ করা ভালো। তা ছাড়া বিয়ের পর সংসারের কোন খরচ কে করবেন, তা যদি দুজন মিলে আলাপ করে নেন, তাহলে এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিক্ততার শঙ্কা কমে যায়।
ঘরের কাজ করবেন কে
ঘরের কাজ, রান্নাবান্না একা নারীর কাঁধে ফেলে রাখার দিন শেষ। বরং এসব কাজ দুজনের ভাগ করে নিতে হবে। অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী, তাই ঘরের কাজ দুজনকেই ভাগাভাগি করে নিতে হবে। অফিস থেকে ফিরে একজন রান্নাঘরে চাল-ডালের হিসাব মেলাবেন, আরেকজন সোফায় বসে টিভি দেখবেন, কোনোভাবেই সেটা কাম্য নয়। দিনের পর দিন এভাবে চললে সংসারের ছন্দ কেটে যাবে। যিনি রান্না পারেন না, তিনি কাটাকুটির দায়িত্ব নিন। বিয়ের শুরু থেকেই থালাবাসন ধোয়া, খাওয়া শেষে সেগুলো গুছিয়ে রাখা, ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়ার মতো কাজগুলো দুজন মিলে সামলানোর অভ্যাস করুন। ছুটির দিনে দুজন মিলে একসঙ্গে কাঁচাবাজারে যেতে পারেন। মাসের বাজারটাও করতে পারেন একসঙ্গে।
ব্যাংক কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানা জানান, তিনি তাঁর জীবনসঙ্গীকে কিছুতেই ঘরের কাজে আগ্রহী করাতে পারছিলেন না। এতে নিজের ওপর বাড়তি চাপ পড়ত। তাই এখন গৃহকর্মী রেখেছেন।
দুজন মানুষের দুই রকম প্রত্যাশা, দ্বিমত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবেন না। উত্তেজনার মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিন। প্রয়োজনে বাইরে চলে যান। হেঁটে আসুন। সিদ্ধান্তটা মনে মনে রাখুন। বাস্তবায়নে ২৪ ঘণ্টা সময় নিন। মনে রাখবেন, একবার আপনি কথাটা বলে ফেলেছেন তো মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন পরামর্শ দিচ্ছেন সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
ভুলে যাওয়া আর উদাসীনতা এক নয়
আপনার যদি বিশেষ দিনগুলো উদ্যাপনে আগ্রহ থাকে আর অন্যজন হন অনাগ্রহী, তাহলে বিরোধ হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। তাই কিছু কিছু সময়ে সঙ্গীর ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিতে শেখা জরুরি। যাঁর ভুলে যাওয়ার সমসা আছে, বিশেষ দিন বা কোনো দাওয়াতে যাওয়ার কথা থাকলে সেটা বরং ফোনে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখুন। সঙ্গী একটা বিষয় নিয়ে অনেক পরিকল্পনার পর আপনার উদাসীনতায় সেটা ভেস্তে গেলে এর প্রভাব দাম্পত্য সম্পর্কে পড়তে পারে। আর যদি কখনো ভুলে গিয়েও থাকেন, সেটা ভণিতা ছাড়াই জানিয়ে দিন সঙ্গীকে। তবে আপনার আচরণ যদি এমন হয়, ‘এটা মনে রাখার কী আছে’, তাহলে দাম্পত্য জটিল পরিস্থিতে পড়তে পারে। দিনের পর দিন যখন আপনি সঙ্গীর পরিকল্পনায় উদাসী হবেন, তিনি আপনাকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করবেন। তাই দাম্পত্য ভালো রাখতে শুরু থেকেই দুজন দুজনের পাশে থেকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ভালো।