মনে আছে কি সেই বেলা বিস্কুটের কথা...
কলেজ রোডের ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে সেদিন বাতিঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। চট্টগ্রাম আমার নিজের শহর। মহসিন কলেজে পড়ার সুবাদে এদিকের রাস্তাঘাট আমার নখদর্পণে আর এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত স্মৃতি। হঠাৎ মহসিন স্কুল পার হতে রাস্তার অপর প্রান্তে চোখে পড়ল গণি বেকারী। কলেজে থাকার সময় বন্ধুদের সঙ্গে কতবার যে এটা-সেটা কিনতে গণি বেকারীতে এসেছি। বেলা বিস্কুটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণি বেকারীর নাম। চট্টগ্রামে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বেলা বিস্কুট তৈরি বা বেকারিশিল্পের যাত্রা শুরু হয় শত বছর পুরোনো এই গণি বেকারীর হাত ধরে। অন্যান্য বিস্কুট থেকে বেলা বিস্কুটের পার্থক্য হলো এতে মিষ্টি কিছুটা কম। তবে পুরু থাকে অনেক বেশি এবং হয়ও বেশ মচমচে। তাই আদতে শক্ত হলেও গরম চায়ে ডোবানোর পর আস্তে আস্তে নরম হতে থাকা বেলা বিস্কুটের আসল স্বাদ যেন বের হয়ে আসে। ফলে সব বয়সের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এই বিস্কুট। সকালে-বিকেলে নাশতায় দুধ-চায়ে ডোবানো বেলা বিস্কুট যেন সোনায় সোহাগা। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে কাচ বা প্লাস্টিকের বয়ামে মিলবে এই বেলা। আর এখন তো বেলার কদর চাটগাঁর আঙিনা পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র।
বেলা বিস্কুটের উৎপত্তির ইতিহাস কিন্তু বেশ ঘোলাটে। চট্টগ্রামের সন্তান সাহিত্যিক আবুল ফজলের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রেখাচিত্র থেকে জানা যায়, চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালার নাম থেকে বেলা বিস্কুটের নাম করা হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলেই ছিল বেশির ভাগ পর্তুগিজের বাস। তাঁদের হাত ধরেই এ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে বেকারিপণ্য। বেকারিপণ্যে অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ। ধারণা করা হয়, তখনকার উদ্যোক্তারা বেলা বিস্কুট নামে বিশেষায়িত বিস্কুট তৈরি করেন। মোগল আমলের শেষভাগে ও ব্রিটিশ আমলের শুরুতে এ বিস্কুটের সুখ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ হিসাবে বেলা বিস্কুট তৈরির ইতিহাস ২০০ বছরের বেশি। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বিভিন্ন বেকারিতে তৈরি বেলা বিস্কুট তুমুল জনপ্রিয় ছিল। এখনকার ক্রেতারাও বংশপরম্পরায় বেলা বিস্কুটের গ্রাহক।
ঠিক কখন থেকে গণি বেকারীতে বেলা বিস্কুট তৈরি হয়, তার সঠিক তথ্য নেই। গণি বেকারীতে গিয়ে জানা গেল, ১৮৭০ সালে গণি বেকারীর নাম ছড়ায় আবদুল গণি সওদাগরের হাত ধরে। আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রি বেকারিপণ্য তৈরি করতেন। শুরুতে এই বেকারিতে রুটি তৈরি হতো। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় পাউরুটি, কেক, বেলা বিস্কুট। প্রচলিত রয়েছে, পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আবদুল গণি সওদাগর প্রথম বেলা বিস্কুটের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের বেকারি পণ্য তৈরির ব্যবসা থাকলেও বেলা বিস্কুটের ব্যাপক প্রচলন সেই সময় থেকে চলে আসছে। এ হিসাবে গণি বেকারীতে বেলা বিস্কুট তৈরির ইতিহাস প্রায় ১৫৪ বছর। বর্তমানে আবদুল গণি সওদাগরের চতুর্থ বংশধরেরা এই বেকারির দায়িত্বে আছেন। পিতা জামাল উদ্দিনের মৃত্যুর পর থেকে বর্তমানে বেকারির দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম।
বেকারির পেছনেই বিস্কুট তৈরির কারখানা। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ঐতিহ্য ধরে রাখতে সনাতন পদ্ধতিতেই বানানো হচ্ছে বেলা বিস্কুট। ওভেনের পরিবর্তে এখনো ১৫০ বছরের পুরোনো কাদামাটির তন্দুর চুল্লির ভেতরে যাচ্ছে ট্রেতে করে সাজিয়ে রাখা বেলা বিস্কুটের খামি। পুরোনো নিয়ম ধরে রাখায় এই বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরি করতে সময় লাগে অন্তত দুই দিন। প্রথমে ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্যতেল, ডালডা, গুঁড়া দুধ এবং বিশেষ একধরনের মসলা ব্যবহৃত হয়। পানিতে মিশিয়ে তৈরি করা হয় খামি। এই খামিতে ইস্টের পরিবর্তে বিশেষ ধরনের মাওয়া দেওয়া হয়। এই মাওয়ার কারণেই বিস্কুটের স্বাদে আসে ভিন্নতা। খামিতে মাওয়া মিশিয়ে এক দিন রাখার পর তন্দুরে প্রথম এক দফায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সেঁকা হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় আবারও সেঁকে তৈরি করা হয় বেলা বিস্কুট। তন্দুরে আগে কাঠ ব্যবহার করলেও এখন গ্যাসের পাশাপাশি কয়লাও ব্যবহৃত হয়। গড়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ প্যাকেট বা ৬ থেকে ৮ হাজার পিছ বেলা বিস্কুট তৈরি হয়। এখানে দুই ধরনের বেলা পাওয়া যায়। মাখন বেলা ও রোজ বেলা। এদের মধ্যে মাখন বেলার দাম বেশি। ৩০ পিসের দাম ১৫০ টাকা আর ৪৫০ গ্রামের সাধারণ রোজ বেলার দাম ১১০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
প্রতিদিন এই বেকারিতে আসে নানা বয়সী ক্রেতা। প্রায় ৩০ ধরনের পণ্যের মধ্যে ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে থাকে বেলা বিস্কুট। প্রবর্তক থেকে গণি বেকারীতে বেলা বিস্কুট নিতে আসেন গৃহবধূ মালিহা ইসলাম। তিনি জানান, পরিবারের সবাই গণি বেকারীর বিস্কুট পছন্দ করে। তাঁর দাদার সময় থেকে বাসায় এখানের বেলা বিস্কুট নেওয়া হয়। অন্যদিকে বর্ষীয়ান ক্রেতা অমিয় ধর জানান, তিনি অনেক পুরোনো ক্রেতা। প্রতিবার এখান থেকেই বেলা, চানাচুর আর পাউরুটি নিয়ে যান। শুধু তা-ই নয়, আশপাশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও সময় পেলে বেকারিতে ঢুঁ মারছে। বলা যায়, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত গণি বেকারী ক্রেতাদের আস্থার জায়গা।
যেহেতু ময়দা মেশানো ছাড়া বিস্কুট তৈরির বাকি প্রক্রিয়া হাতেই করা হয়, স্বাস্থ্যবিধি কতটা মানা হয়, জিজ্ঞেস করা হলে নুরুল আমিন জানান, বিস্কুটের উপাদানে তাঁরা কোনো রকম রাসায়নিক পদার্থ বা সংরক্ষণকারী উপাদান মেশান না। বেশ পুরোনো রান্নাঘরে খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি সব সময় তাঁরা তদারকিতে রাখেন। ময়দা মাখা থেকে শুরু করে মোড়কজাত করা পর্যন্ত সব কাজ প্রায় ১৫ জন কারিগর দক্ষ হাতে সামাল দেন। যেহেতু একক বেকারিতে সব খাদ্যপণ্য তৈরি হয়, তাই পূর্বপুরুষেরা পণ্যের যে মানদণ্ড সৃষ্টি করে গেছেন, সেটায় বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ কর্তৃপক্ষ, জানান এই বেকারির ম্যানেজার।
চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি ছোটখাটো মুদিদোকান থেকে শুরু করে সব বেকারির দোকানে বর্তমানে বেলা বিস্কুট কিনতে পাওয়া যায়। তা ছাড়া নগরীর বেশ কিছু বেকারি দোকানের তৈরি বেলা বিস্কুট দীর্ঘদিন ধরে এতটাই পরিচিতি পেয়েছে যে কেবল বেলা বিস্কুটের জন্যই সেখানে ভিড় জমায় মানুষ। এর মধ্যে অন্যতম পূর্ব মাদারবাড়ির পানাহার বেকারি, মুরাদপুরের হাসিনা বেকারি, বহদ্দারহাটের জান্নাত বেকারি, চকবাজারের হাজী ফয়েজ বেকারি, পাঁচলাইশের প্রবাসী বেকারি। এসব বেকারিরও অন্য কোনো শাখা নেই। অন্যদিকে হাইওয়ে সুইট, ইস্পাহানি ওয়েল ফুড, আম্মান ফুড, চট্টলা বেকারিসহ বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করছে বেলা বিস্কুট। এসব বেকারির বিভিন্ন শাখায় পাওয়া যায় এই বিস্কুট। তা ছাড়া বিদেশে নিয়মিত বেলা বিস্কুট রপ্তানি করে আসছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
তাই ক্রেতারা এখন শুধু গণি বেকারীর বেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। নগরীর প্রায় সব বেকারি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের গ্রামগঞ্জ পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের বানানো বেলা বিস্কুটও লাভের মুখ দেখছে। সাধ্যের মধ্যে দাম এবং উদরপূর্তিতেও সহায়ক হওয়ার চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশব্যাপী এ বেলা বিস্কুটের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। বলতেই হবে চাটগাঁর ঐতিহ্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বেলা বিস্কুট।
কলেজের পাট চুকিয়েছি বহুদিন, কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। তবে চট্টগ্রামে গেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম দুধ-চায়ে ডুবিয়ে কিংবা বিকেলের চায়ের আড্ডায় বেলা বিস্কুট খাওয়ার অভ্যাস বদলায়নি। নানা কাজের চাপে বহুদিন গণি বেকারী যাওয়া হয়নি। তাই এবার যখন গেলাম, তা-ও বেলা বিস্কুটের কল্যাণে, ফেরার সময় দুহাতভর্তি করে বিস্কুট না কিনে কি বাসায় ফেরা যায়!