কথায় আছে, ফ্রান্সের প্রতিটি গ্রামই যেন একেকটি বেকারি।
কথাটা মিথ্যা নয়, তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ ফ্রান্সের সেন্ট ডেনিসের ‘অলিম্পিক ভিলেজ’। ভিলেজ দিয়ে প্রবেশ করতেই প্রথম যে ঘ্রাণ নাকে এসে লাগবে, তা ফ্রান্সের বিখ্যাত খাবার ব্যাগেটের।
অলিম্পিকে অংশ নিতে প্যারিসে পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় সাড়ে ১০ হাজার অ্যাথলেট। কলাকুশলী মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ১৫ হাজারের কাছাকাছি। এই সুবিশাল আয়োজনে খেলোয়াড়দের যেমন প্রয়োজন বিশ্রাম, তেমনই বিশেষ নজর রাখা হয় খেলোয়াড়দের ডায়েটের দিকে। প্যারিস অলিম্পিকও তাই অলিম্পিক ভিলেজের রেস্টুরেন্ট সাজিয়েছে মহাসমারোহে। যাতে শুধু ফরাসি নয়, খেলোয়াড়েরা চাইলে চেখে দেখতে পারবেন পুরো বিশ্বের খাবারের স্বাদ।
ফিল্ম স্টুডিওকে বানানো হলো ডাইনিং হল
এবারের অলিম্পিক ভিলেজের মূল আকর্ষণ হচ্ছে অলিম্পিক রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট না বলে এটাকে ডাইনিং হল বললেই ভালো হবে। কারণ, একই ছাদের নিচে একটি-দুটি নয়, রয়েছে মোট ছয়টি আলাদা আলাদা রেস্টুরেন্ট। ছয়টি রেস্টুরেন্ট মিলে তৈরি করা হয়েছে একটি হাব। যেখানে খেলোয়াড়দের জন্য রয়েছে ২৪ ঘণ্টা বিরতিহীন সেবার ব্যবস্থা।
সেন্ট ডেনিসের পুরোনো এক ফিল্ম স্টুডিওকে বদলে ফেলা হয়েছে বিশাল ডাইনিং হলে। প্রায় ৪৬ হাজার বর্গমিটার আয়তনের ডাইনিং হলে একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করতে পারবেন প্রায় তিন হাজার লোক। শুধু তা–ই নয়, ডাইনিং হলের বিশাল জানালা দিয়ে তাকালে উপভোগ করা যাবে সিন নদীর সৌন্দর্যও।
বাইরে থেকে বিশাল আয়োজন মনে হলেও ভেতরটা বেশ সাধারণ। যেন দামি কোনো রেস্টুরেন্টের বুফে এরিয়া। সারি সারি করে সাজানো খাবারের পদ, সেখান থেকে বেছে বেছে যেটা পছন্দ, সেটাই পাতে তুলে নিচ্ছেন অ্যাথলেটরা।
৬টি রেস্তোরাঁয় কী আছে
অলিম্পিকজুড়ে ক্রীড়াবিদদের খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে বিখ্যাত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি সুডেক্সু লাইভ। পুরো ডাইনিং হলকে তারা ভাগ করেছে আলাদা আলাদা ছয়টি আলাদা রেস্তোরাঁয়।
প্রথমটি আন্তর্জাতিক, যেখানে পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সব খাবার।
দুটি ফরাসি রেস্তোরাঁ, যেখানে ফ্রান্সের বিখ্যাত খাবারগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে সবাইকে।
দুটি এশিয়ান, যেখানে এশিয়ার বিখ্যাত খাবারগুলো থাকবে অ্যাথলেটদের জন্য।
শেষটি হালাল রেস্টুরেন্ট, যেখানে মুসলিম অ্যাথলেটদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে হালাল খাবারের।
রেস্টুরেন্টের বাইরেও পুরো এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে ২০০টি পানি ও জুসের ফাউন্টেইন। সেখান থেকে রিইউজেবল কাপ দিয়ে পছন্দসই জুস খেতে পারবেন অ্যাথলেটরা।
পরিবেশন করা হবে ১ কোটি ৩০ লাখ খাবার
বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সফল করতে প্যারিসে জমায়েত হয়েছেন প্রায় ২০০ শেফ। পুরো আয়োজনের দেখাশোনা করছেন সুডেক্সু লাইভের প্রধান শেফ চার্লস গিলয়। তাঁর অধীনে রয়েছেন আরও তিন জনপ্রিয় শেফ—আমাদিন চেগনট, অ্যালেকজেন্দ্রে মাৎসিয়া ও আকরাম বেনালাল। চার ফ্রেঞ্চ শেফের প্রত্যক্ষ নির্দেশনাতেই তৈরি হচ্ছে অলিম্পিয়ানদের জন্য সুস্বাদু খাবার।
অলিম্পিক রেস্টুরেন্টে অ্যাথলেটদের জন্য প্রতিদিন পরিবেশন করা হচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার খাবার। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক মিলিয়ে মোট ১ কোটি ৩০ লাখ প্লেট খাবার পরিবেশন করা হবে খেলোয়াড় ও কলাকুশলীদের।
শুধু অলিম্পিকেই খাবার দেওয়া হবে এক কোটি প্লেট। তবে অ্যাথলেটদের জন্য তো আর যে সে খাবার বানালে চলবে না, তা হতে হবে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। আবার পেট পূজা করতে গিয়ে যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন, সেদিকেও থাকছে আলাদা নজর।
সুডেক্সু লাইভের পুষ্টিবিশেষজ্ঞ ক্রস্তেলে লেমোতের মতে, ‘২০৬টি দেশের অ্যাথলেটদের জন্য মেনু তৈরি করা মানে প্রতিটি সংস্কৃতি, প্রত্যেক মানুষের অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দের দিকে আলাদা আলাদা করে নজর দেওয়া। আমরা চেষ্টা করছি এমন মেনু তৈরি করার, যাতে প্রত্যেকেই তাঁদের “কমফোর্ট ফুড” খুঁজে পান।’ এ কারণেই অলিম্পিক ডাইনিং হলে অ্যাথলেটদের জন্য রয়েছে ৫০০ পদের খাবার।
প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই রয়েছে সালাদের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে থিম অনুযায়ী বিভিন্ন পদের খাবার। তবে বিশাল মুভি স্টুডিওকে রেস্তোরাঁয় বদলে ফেলায় সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে তাঁদের। কিচেনে ফ্রায়ার ইনস্টটল করতে না পারায় পুরো ডাইনিং হলে নেই কোনো ফ্রায়েড ফুড।
পরিবেশবান্ধব ডাইনিং
ডাইনিং হলে নেই কোনো প্লাস্টিকের ছোঁয়া। শুধু অলিম্পিকের জন্য তৈরি করা হয়েছে ৩৫ হাজার প্লেট। ব্যবহার করা হচ্ছে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এরকম ক্রোকারিজ এবং কাপ। প্লাস্টিক বর্জ্য পরিহারের সব ব্যবস্থাই নিয়েছেন আয়োজকেরা। শুধু প্লাস্টিক বর্জ্য নয়, পুরো আয়োজনের ৮০ ভাগ উপকরণই এসেছে প্যারিসের আশপাশের গ্রাম থেকে। অলিম্পিক ভিলেজের ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যাবে খাবার তৈরির প্রায় সব উপাদান।
তবে অলিম্পিক ভিলেজে যে শুধু আয়োজকদের রান্না করা খাবার খেতে হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। অনেক দেশই তাদের অ্যাথলেটদের সঙ্গে নিজেদের শেফ ও খাবার নিয়ে আসে। খেলোয়াড়দের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজালেও বেঁধে দেওয়া হয় খেলোয়াড়দের। যেমন মার্কিন খেলোয়াড়েরা তাঁদের খেলা শেষ হওয়ার আগে অলিম্পিক ভিলেজের কোনো পানীয় পান করতে পারবেন না। আবার দক্ষিণ কোরীয় অ্যাথলেটদের জন্য রয়েছে আলাদা পুষ্টিবিদ। তাঁর বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী খাওয়াদাওয়া করছেন অ্যাথলেটরা।
রয়েছে সমালোচনাও
এত কিছুর পরও সমালোচনা এড়াতে পারেননি আয়োজকেরা। অলিম্পিক শুরুর দুই দিনের মাথায় ডাইনিং হলজুড়ে দেখা যায় ডিম ও মাংসের সংকট। এ ছাড়া মাংসের রান্না নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের অ্যাথলেটরা। যে কারণে অলিম্পিকের মাঝপথেই নতুন ক্যাটারিং সার্ভিসের সঙ্গে চুক্তি করেছে গ্রেট ব্রিটেনের অলিম্পিক কমিটি। এ ছাড়া নিরামিষ খাবারের আধিক্য নিয়েও কথা উঠেছে কিছু জায়গায়।
যদিও আয়োজকেরা দাবি করেছেন, খেলোয়াড়দের সব অভিযোগই আমলে নিচ্ছেন তাঁরা। ডিম ও মাংসের জোগান ইতিমধ্যে দ্বিগুণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সেটাও বিবেচনায় নেবেন আর যত দ্রুত সম্ভব সাধ্যমতো তার সমাধানও করবেন।
গত দুই অলিম্পিকেই খেলোয়াড়দের খাবার নিয়ে বেশ বড়সড় অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে ৩২তম টোকিও অলিম্পিকে জাপানিজ খাবারকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, সে তুলনায় বাকি ডিশের পরিমাণ ছিল উল্লেখযোগ্য হারে কম। খেলোয়াড়েরা তাঁদের পছন্দসই খাবার খেতে পারেননি বলেও অভিযোগ ছিল আয়োজকদের ওপরে। সেদিক থেকে প্যারিস অবশ্য এগিয়েই আছে। প্রায় ৫০০ পদের আয়োজন, সেই সঙ্গে পুরো ডাইনিংকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা। সব মিলিয়ে খাবারের বৈচিত্র্যে কমতি রাখেননি আয়োজকেরা। ভোজনরসিকেরা ফ্রান্সে এসে খাবারের স্বাদ নিয়ে সমালোচনা করলে কী বেইজ্জতিই না হতে হতো বলুন!
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, পিপল