কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে এক বিকেল
এই দিনেই গত বছর প্রয়াত হয়েছেন গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরী। প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’র জনপ্রিয় এক বিভাগ ছিল তাঁর ‘আপনার রাশি’। রাশিফল শ্রুতলিখনের কাজেই একদিন তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন কবীর হোসাইন
প্রদায়ক হিসেবে প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে লিখছি কয়েক বছর। নানা বিষয়ে বিভাগীয় সম্পাদকের দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টও করেছি। কিন্তু সেদিন আর বিষয়টিকে অ্যাসাইনমেন্ট মনে হলো না! রাশিফলের শ্রুতলিখনের জন্য কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কাছে বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে গিয়েছেন। একদিন ভার পড়ল আমার ওপর। তাঁর ফোন নম্বর নিয়ে প্রথমেই মুঠোফোনে সেভ করে নিলাম। রওনা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফোন করলাম। সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময়ের পর বাসার ঠিকানা দিলেন। ঠিকানা দিলেন—এইটুকু বললে ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাবে না। বরং বলা ভালো, ভূগোল না জানা আনাড়ি পথিককে যেন দক্ষ মানচিত্রবিদের মতো পথঘাট এঁকে দিলেন।
মনে আছে, বাসে সেদিন জানালার পাশে বসেছিলাম। আধভাঙা জানালা দিয়ে ধুলো ভরা শহুরে বাতাস এসে লাগছিল নাকেমুখে। কিন্তু সেসবে খেয়াল ছিল না এতটুকু। আমার মাথায় তখন বেজে চলেছে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্চু কিংবা কুমার বিশ্বজিৎ। মনে পড়ছে, গানপাগল সেই ছেলেবেলার কথা। রেডিওর নব ঘুরিয়ে হালকা ভলিউমে শোনা গানের ঘোষণা—এখন শুনবেন…, গানটির কথা লিখেছেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তখন তো নয়ই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার আগে অবধি তিনি আমার কাছে রাশিফলের জাদুকর না, বরং গানের কবি।
বাসায় ঢুকতেই সরাসরি তাঁর কক্ষে যেতে বললেন তত্ত্বাবধায়ক। সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। অসুস্থতা নিয়ে শুয়ে ছিলেন তিনি। আমি আমার পুরো কৈশোর-তারুণ্যের মুগ্ধতা নিয়ে তাঁর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। খাটের পাশে মাথার কাছে রাখা চেয়ারে বসতে বললেন। বসলাম। তিনি চোখ বুজে রইলেন, নিশ্চুপ। আমার কিছু বলা উচিত কি না, বুঝতে পারছি না।
‘তোমার নম্বরটা সেভ করে নিয়েছি। এখন থেকে কি নিয়মিত তুমিই আসবে?’ নীরবতা ভেঙে জানতে চাইলেন। জবাব দেওয়ার আগেই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাশিফল পড়ো নিয়মিত?’
‘জি, পড়ি, বললাম।’
‘বিশ্বাস করো?’
‘ঠিক বিশ্বাস করি বলা যায় না। তবে পড়তে ভালো লাগে। হয়তো আপনার ক্যারিশমাটিক লেখার জন্য।’ মনে আছে, ‘ক্যারিশমাটিক’ শব্দটিই ব্যবহার করেছিলাম।
তিনি ফের চোখ বুজলেন। ফের নীরবতা। এই ফাঁকে আমি খাতা-কলম বের করে নিলাম।
কিছুক্ষণ পর চোখ বুজেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাশিফল ছাড়া আমার আর কোনো লেখা পড়েছ?’
বললাম, ‘আপনার কিছু কবিতা পড়েছি।’
এবার চোখ খুললেন। বেশ আনন্দিত মনে হলো তাঁকে। বললেন, ‘ভালো লেগেছে তোমার?’
তাঁর জিজ্ঞাসাটিই যেন মুহূর্তে আমার সব জড়তা কাটিয়ে দিল, যা এতক্ষণ ধরে আমায় জড়সড় করে রেখেছিল। বললাম, ‘আপনাকে তো আসলে চিনেছিলাম সেই ছেলেবেলায়, গানের কবি হিসেবে। ‘রূপালি গিটার’, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’, ‘সখি চলো না’, ‘আমায় ডেকো না’—এসব গানের সঙ্গে সঙ্গে আপনার নামটাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আপনার রাশিফল আর কবিতার সঙ্গে পরিচয়।’
এই জবাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। তবে পরক্ষণেই একখণ্ড বিষাদ নেমে এল তাঁর কথায়। বললেন, ‘মন খারাপ লাগে, জানো! আরও কত কবিতা লেখার ছিল!’
এভাবেই কথার পিঠে কথা চলতে থাকল। তিনিই বলছেন। আমি বিমুগ্ধ শ্রোতা। উঠে এল ঋত্বিক ঘটক, লাকী আখান্দ্ এবং আরও অনেক নাম। গান-কবিতার কথা হলো। শুনলেন আমারও দুয়েকটা লেখা। প্রশংসা করলেন। উৎসাহ ও পরামর্শ দিলেন।
‘তোমার খাতা-কলম রেডি তো? তাহলে শুরু করো।’
তিনি বলছেন, খুব ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে। একটা বা দুটো বাক্য বলে চোখ বুজছেন। সময় নিচ্ছেন। আবার বলছেন। একটা অংশ শেষ হওয়ার পর পড়ে শোনাতে বলছেন। যেসব বানানে সচরাচর ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেগুলো বানানসহ শুনে নিচ্ছেন। বাংলা ভাষা ও বানানের প্রতি তাঁর এই বিপুল যত্ন আমাকে মুগ্ধ করে। লেখা হয়ে গেলে অনুমতি নিয়ে বের হওয়ার জন্য উঠে পড়ি।
মৃদু হাত নেড়ে বলেন, ‘আবার এসো।’