ঢেউ নও, তুমি পানি: মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস
ফোর্বস সাময়িকীর বিচারে একাধিকবার বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস। অথচ এই মানুষটাই ধনকুবের বিল গেটসের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক অবসানের পর ভেঙে পড়েছিলেন। তবে হাল ছাড়েননি। নিজের মতো করে নানা রকম মানবকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত হয়েছেন। খারাপ সময়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সেই প্রসঙ্গেই ১৬ জুন সমাবর্তন বক্তা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে দারুণ এক বক্তৃতা দিয়েছেন মেলিন্ডা।
আধ্যাত্মিক নেতা রাম দাস একটি গল্প বলেন। সমুদ্রতীরের দিকে ছুটতে থাকা দুটি ঢেউয়ের গল্প। একটি বড়, একটি ছোট। বড় ঢেউটি দেখতে পায়, একটু দূরেই তীর। সে দেখে, সামনের বড় ঢেউগুলো কীভাবে তীরে আছড়ে পড়ছে।
ছোট ঢেউটিকে সে সতর্ক করে। কিন্তু ছোট ঢেউ বড়র কথা আমলে নেয় না। বলে, ‘ভেবো না। আমাদের কিচ্ছু হবে না।’
বড় ঢেউ বোঝায়, ‘তুমি বুঝতে পারছ না। আমাদের দিন শেষ হয়ে আসছে।’ ছোট ঢেউ ঠান্ডা গলায় বলে, ‘না। কখনোই নয়। কেন জানো? কারণ, তুমি ঢেউ নও, তুমি পানি।’
গল্পটি আমার খুব পছন্দ। এই গল্পের শিক্ষা হলো, অনেক বদলের মধ্য দিয়ে গেলেও ভুলে যেয়ো না, তুমি আদতে কে? আমার বয়স ৬০। এ পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তোমরাও অনেক বদলের মধ্য দিয়ে যাবে।
কিছু বদলকে তুমি সাদরে গ্রহণ করবে, কিছু হবে অপ্রত্যাশিত। আমার বেলায় যেমন মাইক্রোসফটে পেশাজীবন শুরু করা, ক্যানসারের আঘাতে সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারানো, প্রেমে পড়া, মা হওয়া, মেয়ে ও নারীদের জন্য কাজ শুরু করা, ৩০ বছরের একটা সম্পর্কের ইতি টানা, এই সবই একেকটা বদলের ধাপ।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই ভীতসন্ত্রস্ত বড় ঢেউয়ের মতো আমারও মনে হয়েছে, দিন শেষ হতে চলল। কিন্তু পরদিন আবারও উঠে দাঁড়িয়েছি। পরের দিনটায় তুমি কী করছ, সেটাই বলে দেয়, তুমি আসলে কে?
আজ তোমাদের জীবনের এক বড় বদলের দিন। তাই অনুরোধ করব, কাল ঘুম থেকে উঠে দিনটা শুরুর আগে কয়েকটা ব্যাপার ভেবো। তিনটি শিক্ষার কথা আজ বলব, যা আমি আমার জীবনের রূপান্তরের অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছি।
প্রথম শিক্ষা: প্রগতিশীল, খোলা হৃদয়
জীবনের বেশির ভাগ সময় আমাদের পথচলা হয় অনেকটা রুটিনমাফিক, গতানুগতিক। কিন্তু রূপান্তরের সময় চেনা বলয় থেকে বের হয়ে আমরা একটি বিশাল জায়গায় পা রাখি।
এখন এই বিশাল জায়গা পার হওয়ার দুটি উপায় আছে। সবচেয়ে ছোট পথটি বেছে নেওয়া এবং দ্রুত পরের ধাপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা। অথবা এই নতুন জায়গাকে আবিষ্কার করা। বোঝার চেষ্টা করা, এ থেকে তোমার কী শেখার আছে। আমিও শুরুতে প্রথম উপায়টাই বেছে নিতাম। কিন্তু যত বয়স হয়েছে, অনিশ্চয়তাকে স্বাগত জানানোর গুরুত্ব বুঝেছি।
মনে রেখো, ঢেউ যখন বুঝতে পারে, সে শুধু ঢেউ নয়, সে আদতে পানি, তখনই যেকোনো আকার ধারণ করার মতো স্বাধীনতা সে পায়। একই কথা তোমার বেলায়ও প্রযোজ্য।
দ্বিতীয় শিক্ষা: তোমার ছোট ঢেউটি খুঁজে বের করো
গল্পের নায়ক কিন্তু সেই ছোট ঢেউ। কারণ, সে–ই বড় ঢেউকে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। ক্যারিয়ারের শুরু দিকে আমার জীবনে যেমন ‘ছোট ঢেউ’ হয়ে এসেছিল শার্লট, এক সহকর্মী। মাইক্রোসফটে শুরুর দিন থেকেই কাজটি ভীষণ ভালোবেসে করছিলাম। কিন্তু দিনে দিনে বুঝতে পারি, অফিসের সংস্কৃতিটা ঠিক আমার পছন্দ নয়।
সবাই কেমন যেন উদ্ধত, আমি যা নই। আমার ব্যাচে আমিই ছিলাম একমাত্র নারী। বাকি পুরুষদের ছাপিয়ে যেতে সব সময় একরকম চাপ বোধ করতাম। একসময় চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলাম। বড় ঢেউয়ের মতো আমারও মনে হচ্ছিল, শেষটা বোধ হয় চলেই এল।
সে সময় শার্লটই আমাকে ভিন্নভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। শার্লট বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়। অভিজ্ঞতাও বেশি। সে বুঝে ফেলেছিল, কীভাবে নিজস্বতা ধরে রেখে অফিসের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। শার্লট ছিল বলেই আমি মাইক্রোসফটে টিকে গেছি। স্নাতকেরা, নিশ্চয়তা দিতে পারি, তোমাদের জীবনেও এমন ‘ছোট ঢেউ’ আসবে। আবার তোমাকেও কারও কারও জীবনে ছোট ঢেউয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
তৃতীয় শিক্ষা: আস্থার জাল গড়ে তোলো
পাশের মানুষটির প্রতি একধরনের দায়িত্ব বোধ করা, এমনটা আমাদের বেলায় সব সময় হয় না। সে যদি আমার বিপক্ষ দলের হয়, তাঁর সঙ্গে যদি আমার মতের অমিল থাকে, তাহলে তো নয়ই। কিন্তু আমাদের একে অপরকে প্রয়োজন।
তুমি যে-ই হও না কেন, এমন সময় আসবেই, যখন তোমাকে অন্য কারও কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হবে। আবার তুমিও কারও না কারও জন্য কাঁধ পেতে দেবে। আমার বন্ধু জন যখন ৩৭ বছর বয়সে মারা যায়, তার স্ত্রী এমির পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, যেন এই অবর্ণনীয় কষ্টের সময়টায় সে কিছুটা ভরসা পায়। তিন বছর আগে যখন আমার বৈবাহিক জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নিই, তখন সেই এমিই এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। আমরা দুজনই কিন্তু যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন। আমাদেরও ভেঙে পড়ার মতো সময় এসেছে।
এটা খুব ছোট্ট উদাহরণ। ‘আস্থার জাল’ বিষয়টা আরও অনেক বড়। এর অর্থ হলো পুরো সমাজেই একটা আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
আমার বিশ্বাস, নিজেকে ঢেউ না ভেবে পানি ভাবার সাহস তোমরা পাবে। মনে রাখবে, সাগরের তীরেই তোমার শেষ নয়, বরং তোমার ধাক্কাই সাগরের তীরকে আকৃতি দেয়। কী ভীষণ শক্তি তোমার! (সংক্ষেপিত)
সূত্র: স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট